বহু বছর আগে, এক দেশে এক চোর ছিল। কতদিন আগে, কোন দেশ, বলতে পারব না। চোরেরা তো সদা সর্বত্রই একরকম, নয় কি? যাই হোক, আমি যে চোরের কথা বলব, সে ছিল সেই যুগের সবচেয়ে কুখ্যাত চোর। আজীবন চুরি করে গেছে, অনেকেই জানত সেটা, কিন্তু ধরা পড়েনি। ঠিক পালিয়ে যেত কোনও না কোনওভাবে, চুরির মাল সরিয়ে ফেলত অন্যত্র। কোনও প্রমাণ থাকত না চুরির। কেউ টের পেত না। চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ো ধরা! তবে তাকে মহাবিদ্বান বলে সবাই যে সমীহ করত এমনটাও নয়। কী বলছেন? অমন চোর এখনও আছে কিছু? বহাল তবিয়তে তারা এই সমাজেই ঘুরে বেড়ায়? কেউ কেউ আবার দেশের সম্পদ লুঠ করে বিদেশেও পালিয়ে যায়? থাক, তাদের নাম আর বলছি না। আমাদের এই চোরটি কিন্তু এত বড় কেউকেটা হতে পারেনি। অন্য কাজকর্ম জোটাতে না পেরে পেটের দায়েই চৌর্যবৃত্তি করত। যাকে বলে অভাবে চোর, সেই থেকেই স্বভাব হয়ে যায় ক্রমে। কোনওমতে নিজের অন্নসংস্থানটুকু করতে পারত আর কী। কিন্তু সময় এগিয়ে চলে। স্বাভাবিক নিয়মেই একদিন সেই চোরও বৃদ্ধ হয়। তার কর্মক্ষমতা কমে আসে। ঝুঁকি নেওয়া ছেড়েই দেয় প্রায়। এদিকে সঞ্চিত অর্থ এত নেই যে বসে বসে খেতে পারবে। এমনই একদিন ঘরে খাবার প্রায় ফুরিয়ে এসেছে দেখে জমানো যা টাকাপয়সা ছিল তাই নিয়ে সে বাজারে গেল। ভিড়ে ধাক্কা খেতে খেতে কোনওমতে একটা দোকানে পৌঁছে আনাজপাতি দরাদরি করতে শুরু করল। দাম দেখে তার প্রায় ভির্মি খাওয়ার জোগাড়। সে ভাবে, ‘আমি তো না হয় চুরি করতাম। এ যে দিনে ডাকাতি হচ্ছে! আনাজে হাত ছোঁয়াতেই তো আগুনে দামের ছ্যাঁকা খাচ্ছি।’ শেষমেশ কিছুই কেনার সামর্থ্য নেই দেখে সামান্য এক আঁটি শাক কিনতে মনস্থ করল সে। কিন্তু সেটারও দাম দিতে গিয়ে চমকে গেল সে। ভিড়ের মধ্যে কোন ফাঁকে তার টাকার থলিটি হাতিয়ে নিয়েছে কেউ। কষ্টের মধ্যেও হাসি পেল তার। একেই কি বলে কর্মফল? একদিন সেও এরকম কত লোকের...ভাবতে ভাবতে তার মনে অন্য একটা ফন্দি এল– ‘আচ্ছা, আমি তো নিজেই চোর। আমার আবার পয়সার ভাবনা কেন? যদি আমার কিছু লাগেই, সেটা তো আমি...’
যেমন ভাবা তেমন কাজ। চোরবাবাজি হাতসাফাই করে চোখের নিমেষে শাকের আঁটিটা নিজের পোশাকের ভিতরে চালান করে যেন কিছুই হয়নি এমন মুখ করে দোকান থেকে বেরিয়ে পথে নামল। নাহ, কেউ বিন্দুমাত্র সন্দেহ করার অবকাশ পায়নি। কিন্তু সে বাজারের রাস্তায় নেমেছে কী নামেনি, একটা বলিষ্ঠ হাত এসে তার কাঁধের কাছটা খামচে ধরল পিছন থেকে “কীরে, ভেবেছিলিস চুপচাপ চুরি করে পালাবি? আমি ঐ দোকানের মধ্যেই তোকে দেখে নিয়েছিলাম, কীভাবে শাকের আঁটিটা সরালি। চল এবার তোর বিচার হবে।”
এক বিশালবপু রাজপেয়াদা! বাজারের মধ্যে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে ওরা নিয়মিত টহল দেয়। সব চোর বাটপাড়কেই যে তারা ধরতে পারে, আর ধরতে পারলেই যে তাদের একেবারে রাজসভায় বিচারের জন্য ধরে নিয়ে যায় এমনটা নয়, দুষ্টুলোকে বলে মাঝেসাঝেই রাঘব বোয়ালদের সঙ্গে লেনদেনের রফা হয়ে থাকে পেয়াদাদের। পেয়াদা খুশ তো শাস্তিও ফুস, মানে মকুব। আর না পারলে... এই চোরের মত দশা হবে, আর কী! কী কুক্ষণে বেচারা চোর তার নজরেই পড়ে গেছিল। আজ আর নিস্তার নেই। পেয়াদাটা তার জামার কলার ধরে নিজের মুখের সামনে টেনে এনে ভুরু কুঁচকে কী যেন দেখে। সঙ্গেসঙ্গে চমকে উঠে বলে “একী রে! তুই তো সেই কুখ্যাত চোর! আমার বাবার কাছেও তোর গল্প অনেক শুনেছি। বহুবছর ধরে তুই আমাদের সবাইকে জ্বালাচ্ছিস। আমার সৌভাগ্য তোকে ধরতে পারলাম। রাজামশাই নিশ্চয়ই ইনাম দেবেন আমাকে।”
চোর মনে মনে গজগজ করে, ‘হ্যাঁ সত্যিই তোর পূর্বপুরুষের ভাগ্যি, যে আজ এই বান্দাকে ধরতে পারলি। নেহাত আমার বয়স হয়েছে, ক্ষিপ্রতা কমেছে, তাই পারলি। এতদিন তো আর পারিসনি!’
চোরকে ধরে বেঁধে বিচারসভায় হাজির করা হল। বিচারক মহোদয় একটা উঁচু আসনে বসে আছেন। উকিল, পেয়াদা অনেকেই আছে আশেপাশে। সামনে আসামীকক্ষ, কাঠগড়া। ঘরভর্তি আরও অনেক লোক। তামাশা দেখতে আসে তারা রোজ। দেশে বেশির ভাগ লোক বেকার আর অশিক্ষিত। তাই তাদের অঢেল সময়, অতএব তামাশা দেখেই ভুখা পেটের খিদে অর্ধেক মিটিয়ে নেয় তারা। রাজাও এতে মনে মনে খুশিই হন। শিক্ষিত আর কর্মঠ লোক বেশি হলেই দেশে বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিতে পারে, তাহলে বিপদ। তারচেয়ে এই ভালো।
বিচার শুরু হল।
বিচারক চোরকে দেখেই গর্জন করে উঠলেন “তুই! আরিব্বাস। আমি কত বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছি তোকে জেলে ঢোকাতে। অবশেষে এতদিনে হল। তা পেয়াদা, ও কী চুরি করেছে?”
“আজ্ঞে হুজুর, এক আঁটি শাক। এই যে, হাতেনাতে ধরেছি।”
বিচারক একটু বিষম খেলেন। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “এ-এ-ক আঁ-আ-টি শা-আ-ক? খুব অন্যায় হয়েছে। এর উচিত সাজা হবে।”
চোর সবে ভাবছে এই মামুলি চুরির জন্য আর কীই বা শাস্তি হবে? বড়জোর এক হপ্তার কয়েদ। তখনই বিচারকের গম্ভীর কন্ঠস্বর শোনা যায় “এর শাস্তি পাঁচ হাজার স্বর্ণমুদ্রা জরিমানা।”
চোর আঁতকে উঠে বলে “পাঁচ হাজার! আমি তো সারাজীবনেও এত টাকা দেখিনি হজুর! দয়া করুন।”
“ঠিক আছে। ঐ মুদ্রা অনাদায়ে পাঁচ হাজার দিনের কারাদণ্ড হবে তাহলে।”
“পাঁচ হাজার দিন! হুজুর আমি বুড়ো হয়েছি, দেখতেই তো পাচ্ছেন। আমি হয়তো এত দিন বাঁচবই না। তাহলে তো সেটা আমৃত্যু কারাবাসের সামিল হবে হুজুর!”
“হ্যাঁ। হলে হবে। তাতে আমার কী করার আছে। আমার যা বলার বলে দিয়েছি। মামলা খতম। এই কে আছিস, আসামীকে কারাগারে নিয়ে যা।” খসখস করে কাগজে সই করে বিচার শেষ করলেন তিনি।
চোরকে নিয়ে যাওয়া হল সেই দেশের রাজার সবচেয়ে কুখ্যাত ভয়ানক কারাগারে। দেশের এক প্রান্তসীমায় দুর্গম পাহাড়ের চূড়ায় অরণ্যবেষ্টিত সেই প্রাচীন কয়েদখানা। তার সুউচ্চ পাথুরে দেওয়াল দুর্ভেদ্য। অন্ধকার খুপরিগুলোতে সূর্যেরও যেন প্রবেশ নিষেধ। কয়েদিরা কেউ বেগড়বাঁই করলেই তাদের কপালে জোটে কাঁটাওয়ালা চাবুকের নির্মম মার। তাদের আর্তচিৎকারে কেঁপে ওঠে বনের পশুরাও। চোর সেসব দেখতে দেখতে নিজের জন্য বরাদ্দ একটা অন্ধকার খোপের ভিতর লোহার গরাদের পিছনে ঢুকে বিড়বিড় করে বলল “আমি এখানে বেশিদিন থাকব না। পালাব। ঠিক পালাব।”
স্বগতোক্তির ঢঙে বললেও কারারক্ষীটি সে কথা শুনে ফেলল। বিশ্রীভাবে হেসে সে বলে উঠল, “হা হা হা! কেউ কোনওদিন এই রাজকারাগার থেকে মেয়াদের আগে মুক্তি পায়নি, জেনে রাখ। তাও যদি কোনও বন্দি এখান থেকে পালাতে সফল হয়, তাহলে সেই কুঠুরির দায়িত্বে থাকা পাহারাদারকেই উলটো সারাজীবন বন্দি থাকতে হবে তার পরিবর্তে। আর সেটা আমরা কেউই হতে দিই না। কাজেই কেউ পালাতে চেষ্টা করলে তার একটাই শাস্তি। মৃত্যু!”
কোমরে গোঁজা তরবারিটায় চকিতে একবার হাত বুলিয়ে নেয় রক্ষীটি।
“দেখা যাবে-খন।” চোর বলে।
পরদিন সকালে যখন তাকে একজন কারারাক্ষী খাবার দিতে আসলো, চোর সটান বলে বসল, “আমি দেশের রাজার সঙ্গে দেখা করতে চাই।”
“বলিস কী রে! চুরি করে সাজা পেয়েও আশ মেটেনি? একেবারে রাজার সঙ্গে ... ?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। আসলে আমার কাছে একটা অদ্ভুত সুন্দর জিনিস আছে। আমি সেটা রাজামশাইকে উপহার দিতে চাই।”
“উপহার? তুই দিবি রাজামশাইকে! পাগল না কী! ঠিক আছে আমাকে দে। আমি পাঠিয়ে দেব’খন রাজদরবারে।”
“মাপ করবেন হুজুর। আমি নিজমুখে না বললে জিনিসটার মাহাত্ম্য বোঝানো যাবে না। একটিবার সরাসরি তাঁর কাছে যেতে দিন আমায়।”
“আরে এ তো আচ্ছা ঝামেলা। বলছি না রাজামশাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে না!”
“ওহ্। বেশ। শুধু আমি ভাবছি রাজামশাই যখন জানতে পারবেন, তাঁর এই বোকা কারারক্ষীটির জন্যই তাঁর অমন অভাবনীয় একটি উপহার হাতছাড়া হয়ে গেছে, তখন তিনি কী করবেন!”
এই কথা শুনেই প্রহরী ক্ষেপে গিয়ে চোরটিকে উত্তমধ্যম ধোলাই দিল। তবে মনের মধ্যে কিছু একটা খচখচ করতে লাগল তার। রাজামশাইয়ের লোভ আর মেজাজের কথা সবাই জানে। পরে যদি কখনও জানা যায় সত্যিই চোরটা তাঁকে কিছু একটা দামি জিনিস দিতে চেয়েছিল, আর প্রহরীই তাকে নিরস্ত করেছে, তখন কী হবে?
ভাবনাচিন্তার ফল দেখা গেল পরদিন সকালেই। চোরকে ধরেবেঁধে রাজসভায় আনা হল। মন্ত্রী, সেনাপতি, পুরোহিত সবাই যে যার আসনে। এখানে আর সাধারণ প্রজারা কেউ নেই, এখানকার ‘তামাশা’ শুধু রাজন্যবর্গের জন্যই বরাদ্দ। সবার উৎসুক নজর চোরের দিকেই। না জানি কী উপহার নিয়ে এসেছে সে। দেখা তো যাচ্ছে না কিছু। রাজামশাই একটু অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন, “এই যে শোনো, আমার হাতে বেশি সময় নেই। অনেক কাজ পড়ে আছে। কী একটা দামী জিনিস দেবে বলেছ, সেটা সঙ্গে এনেছ কি? থাকলে ঝটপট দিয়ে দাও।”
“দেব তো হুজুর। এই তো, আপনার জন্যেই যত্ন করে রাখা।”
মলিন চাদরের ভিতর থেকে চোরের হাতে ঝলমল করে ওঠে একটা ছোট্ট ধাতব কৌটো। মনে হয় সোনার। আশ্চর্য! এইটা সঙ্গে নিয়েই কারাগারে বন্দি ছিল? কেউ টেরই পায়নি। পেয়াদাকে ইশারা করতেই সে কৌটোটা তার হাত থেকে ছিনিয়ে রাজার হাতে দিল। সোনারই বটে। তার উপর আবার নানা অপূর্ব কারুকাজ। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেটা দেখে তাচ্ছিল্যভরে মহারাজ বলেন, “এই নাকি তোমার আশ্চর্য উপহার? সামান্য একটা কৌটো? তুমি কি আমার সঙ্গে মস্করা করছ হে?”
জিভ কেটে চোর বলল, “ছি ছি মহারাজ, আমার সে ধৃষ্টতা হবে না কখনও। এটা কৌটোই বটে, তবে সামান্য বলতে পারি না। বহুবছর আগে এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসী আমাকে এটা দিয়ে গেছিলেন, শ্মশান থেকে চুরি করে তাঁর শবসাধনার জন্য উপযুক্ত একটা মড়া চুরি করে এনেছিলাম, তাই। অনুগ্রহ করে যদি একবার ওটা খোলেন জাঁহাপনা।”
কৌতূহলবশত রাজা কৌটোর ঢাকনা খুলে ভিতরে উঁকি মারলেন। ভিতরে একটা ছোট্ট ডালিমের বীজ। আর কিচ্ছু নেই।
“একটা ডালিমের বীজ! শুকনো খটখটে! এর মানে কী?” রাগে দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে রাজামশাইয়ের।
“আজ্ঞে হ্যাঁ, মহারাজ। ডালিমেরই বীজ বটে। কিন্তু যে সে বীজ নয়। ওটা জাদু বীজ আজ্ঞে।”
“জাদু বীজ! কী রকম?”
“আজ্ঞে ঐ বীজ মাটিতে পোঁতার পরদিনই সেটা বেড়ে গাছ হয়ে যাবে।”
“বটে!”
“যে আজ্ঞে। আর গাছ যেদিন হবে তার পরদিনই ওতে ফল ধরবে। ফলে একেবারে গাছ ভরে উঠবে।”
“আচ্ছা!”
“শুধু তাই নয়, ফল ধরার পরের দিন, অর্থাৎ বীজ পোঁতার পর তৃতীয় দিনেই সেই ফল পেকে মাটিতে পড়বে। আর সেই ফল গোটাটাই সোনার, সোনার ডালিম। খোসা থেকে দানা সব খাঁটি সোনার।”
সোনার কথায় রাজার চোখ চকচক করে ওঠে। কিন্তু পরমুহূর্তেই কী মনে হতে তাঁর ভুরু কুঁচকে যায়। তিনি বলেন, “কিন্তু সত্যি যদি তাই হবে, তাহলে তুমি ব্যাটা এতদিন এই গাছ পোঁতোনি কেন হে? তোমার তো বড়লোক হয়ে যাওয়ার কথা ছিল! ঠিক যেমন টাকে চুল গজানোর ওষুধ বিক্রি করা ডাক্তারের মাথায় টাক থাকে কিম্বা লোকের ভূত ভবিষ্যৎ বলে দেওয়া জ্যোতিষীর নিজেরই অপঘাতে মৃত্যু হয়। আমাকে মিছে কথা বলে বোকা বানাচ্ছ অ্যাঁ? শূলে চড়াব তোমায়!”
“আজ্ঞে গরিবের কথাটা আগে পুরোটা শুনুন মহারাজ। আমি বলছি কারণটা। আসলে এই বীজ আমাকে যে সন্ন্যাসী দিয়ে গেছিলেন তিনি একটা শর্তও বলেছিলেন, যেটা না মানলে জাদুটা কাজ করবে না।”
“কী শর্ত?”
“যে এই বীজ পুঁতবে, সে যেন একদম নির্মল হৃদয়ের এক ব্যক্তি হয়। কখনও স্বার্থের বশে মিথ্যে বলেনি, চুরি ডাকাতি করেনি, মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেনি, তাদের ঠকায়নি, কাউকে ইচ্ছাকৃতভাবে শারীরিক বা মানসিক কষ্ট দেয়নি, তেমন মানুষই এর থেকে সোনা ফলাতে পারবে। আর আপনি তো জানেন, আমি সেই কবে থেকেই চুরি করি। কাজেই আমার দ্বারা তো এ কাজ সম্ভব ছিল না। কিন্তু, আপনি, আপনি দেশের রাজা। আমাদের সবার মহারাজ। আমি জানি আপনিই সেই ব্যক্তি যিনি এর যোগ্য। তাই আপনার হাতেই অর্পণ করলাম এটি।”
রাজার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। হাতের উপর রাখা কৌটোর মধ্যে বীজটার দিকে তাকালেন। তারপর মনে মনে ভাবলেন, নিজের স্বার্থে আজ অবধি কত কতবার দেশের মানুষদের তিনি মিথ্যে বলেছেন, একের পর এক প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন, সরল বিশ্বাসী প্রজাদের থেকে নির্মম ভাবে রাজকর আদায় করে গেছেন, বিনিময়ে পরিষেবা নয়, রাজকোষাগার ভরিয়ে গেছেন অবাধে। তাদেরই করের টাকায় কত দেশ বিদেশ ঘুরে বেরিয়েছেন, আমোদ প্রমোদে ভেসে গেছেন, আর দেশ তখন ভেসে গেছে বন্যায়, খেতের ফসল শুকিয়েছে খরায়। অনুচ্চকন্ঠে কৌটোটি চোরের দিকে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, “না হে। আমি সেই ব্যক্তি নই। এটা আমার কাজে লাগবে না।”
“আপনি নন?” হতাশকন্ঠে বলল চোর, “তাহলে মনে হয়, আমাদের প্রধানমন্ত্রী মশাই এর যোগ্য দাবিদার হতে পারেন। তিনিই তো কবে থেকে আমাদের দেশের সমস্ত সরকারি দপ্তর পরিচালনা করেন, দেশের ভালোমন্দ বিষয়ে মহারাজকে সুমন্ত্রণা দেন। আপনিই এটা নিন বরং প্রধানমন্ত্রী মহোদয়।”
প্রধানমন্ত্রী একটা ঢোঁক গিললেন। তাঁর মনে পড়ল এ যাবৎ দেশের অন্যান্য অসাধু মন্ত্রীবর্গ কিম্বা অসৎ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তিনি কতশত ঘুষ নিয়েছেন, কেবল তাদের অন্যায়কে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য। দেশের সাধারণ নাগরিকরা শুধু তাঁর দুর্নীতির কবলে পড়েই আজও দুর্দশাগ্রস্ত। “দুঃখিত, আ- আমিও ঠিক এর যোগ্য নই। বুঝলে? এটা বরং অন্য কাউকে দাও।”
“আপনিও নন? তবে তো ভারি মুশকিল হল। ঠিক আছে, তাহলে সেনাপতি মশাই আপনি? আপনি অন্তত নিন?”
সেনাপতি এতক্ষণ সব দেখছিল শুনছিল। এখন নিজের নাম শুনে একবার কৌটোর দিকে তাকাল। তৎক্ষণাৎ যেন জাদুর মতই তার মনে পড়ে গেল সেইসব হতভাগ্য মায়েদের কথা, যাদের সন্তানদের হত্যা করা হয়েছিল তারই আদেশে। দেশদ্রোহিতার নামে চিরতরে মুছে দেওয়া হয়েছিল যেসব রাজবিদ্রোহীদের নাম, তাদের বিধবা স্ত্রীদের হাহাকার ভরা মুখ ভেসে উঠল তার মনের চোখে। রাজার আদেশে জমি কেড়ে নিতে গিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল যেসব চাষাভুষো, তাদেরও রেয়াত করা হয়নি। সেনাপতির এক নির্দেশে কামানের গোলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছিল দেহগুলো। রক্তমাংসের সেই পিণ্ডের ছবিও আজ হঠাৎ করে মনে পড়ল তার।
“যা যা নিয়ে যা এই কৌটো। দূর হ। আমি এসব পারব না!” রীতিমত ধমকেই ওঠে সেনাপতি।
“কী বলছেন! আপনিও ... কী আর করা যাবে। ওহো, আমি তো খেয়ালই করিনি এতক্ষণ। স্বয়ং মহামান্য রাজপুরোহিত মশাইও তো উপস্থিত এখানে। দেখেছেন কাণ্ড! আপনার চেয়ে নির্মল হৃদয়ের মানুষ আর কেই বা থাকতে পারে। আপনি এটা গ্রহণ করে আমাকে উদ্ধার করুন দয়া করে।”
রাজপুরোহিত তটস্থ। কারণ ততক্ষণে তাঁর মনের পর্দায় ভেসে উঠেছে নিজের যাবতীয় অন্যায়ের কথা। মন্দিরে প্রণামীর বাক্সে যত অর্থ জমা পড়ে, তার সিংহভাগই তো যায় তাঁর হেফাজতে! গরিব দুঃখিদের ভোজন করাতে আর তাদের দুরবস্থায় সাহায্য করতে যে দান ব্যয়িত হওয়ার কথা, তার সদ্ব্যবহার তো তিনি নিজেই করেন। তারপর রইল ধর্মের নামে ভয় দেখিয়ে যাগযজ্ঞ করার অজুহাতে নাগরিকদের সম্পদলুঠ। হ্যাঁ, লুঠ ছাড়া আর কী!
নিশ্চুপে মাথা নেড়ে নতমস্তকে তিনিও চোরকে ফিরিয়ে দেন সোনার কৌটো। সভায় কারও মুখে কোনও শব্দ নেই। রাজা, প্রধানমন্ত্রী, সেনাপতি, রাজপুরোহিত সবার মাথা নিচু। সামান্য এক চোরের সামনে! নীরবতা ভাঙে সেই চোরই।
“কী অদ্ভুত না? দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান আর মান্যগণ্য চারজন লোক, তাঁরা কেউই এই জাদু বীজের যোগ্য নন! সবাই কোনও না কোনও অপরাধে নিজেদেরকেই দোষী বলে মনে করেন। অথচ, আমি, এই বুড়ো এক চোর, আমায় কিনা সারাজীবন ঐ কারাগারের কাল কুঠুরিতে কয়েদ থাকতে হবে? সামান্য এক আঁটি শাক চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ার অপরাধে? আপনারাই বলুন, এটা কি আমি সুবিচার পেলাম?”
এটুকু বলে সে হাঁপাতে লাগল। রাজা মন্ত্রী সবাই পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে রাজা বললেন, “হ্যাঁ, মানছি এটা উচিত হয়নি। তোমার নামে আগেও অনেক অভিযোগ ছিল অবশ্য, কিন্তু তখন তো তোমাকে ধরা যায়নি। হয়তো শুধু এইটুকু চুরির অপরাধে আজীবন কারাদণ্ড তোমার প্রাপ্য নয়। যে কেউ শুনলেই বলবে, আমাদের পবিত্র দেশের সুনামের পক্ষে এটা লজ্জাজনক...”
চোরের চোখেমুখে আশার আলো ফুটে উঠছিল। তবে কি মুক্তি আসন্ন? ভাগ্য কি এতই সুপ্রসন্ন? তখনই বজ্রনিনাদের মত রাজার গলায় শোনা গেল, “তবে এমন একটা ঘটনা এই রাজসভার বাইরে যাওয়াটাও উচিত নয়। বিশেষ করে যেখানে দেশের সম্মান জড়িয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রী, আপনি কী বলেন?”
প্রধানমন্ত্রী চনমনে গলায় বললেন, “আজ্ঞে একদম ঠিক কথা, মহারাজ। দেশের স্বার্থে এসব কথা পাঁচকান হতে দেওয়া যায় না একেবারেই।”
রাজা সন্তুষ্ট মুখে সেনাপতির দিকে ইঙ্গিত করেন, “তাহলে সেনাপতি, কী করা উচিত বুঝতে পারছ তো?”
সেনাপতি তড়িঘড়ি কোমরে বাঁধা তরবারির খাপ খুলতে উদ্যত হয়। হঠাৎ কী মনে হতে রাজা পুরোহিতের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসু হন, “পুরোহিত মশাই, এতে আপনার কোনও আপত্তি নেই তো? শাস্ত্রে কী বলে?”
পুরোহিত প্রত্যয়ীস্বরে জানান, “আজ্ঞে না মহারাজ। কোনও বাধা নেই। দেশের মঙ্গল হয় যাতে, তেমন কাজে কোনও পাপ নেই। বরং এমন বলি পেয়ে ঈশ্বর খুশিই হবেন।”
এরপর আর কালবিলম্ব না করে মহারাজের এক ইশারায় সেনাপতি নিজেই হতভাগ্য চোরের মস্তক ধড় থেকে এক কোপে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। একটু আগে যে অপরাধবোধ তাদের অন্তরকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলছিল, (তাই তো মনে হয়!), এক নিমেষে সেসব উধাও হয়ে গেল। চোরের অবশ্য আর কালকুঠুরিতে ফিরতে হল না। তার দ্বিখণ্ডিত দেহের সঙ্গে সেই ডালিম বীজসহ সোনার কৌটোটি মাটির গভীরে পুঁতে ফেলা হল। আদৌ সেটা জাদু বীজ ছিল কিনা সেটা অবশ্য রহস্যই থেকে গেল, সত্যি হোক বা মিথ্যে, তা মাটির তলাতেই রয়ে গেল। যেভাবে আরও অনেক সত্যি চাপা পড়ে থাকে কালের গর্ভে।
…………………
অলঙ্করণঃ- সায়ন্ন্যা দাশদত্ত
No comments:
Post a Comment