গল্পঃ ফিফটি-ফিফটিঃ অরিন্দম দেবনাথ

                                                       





“স্যার, পুরো ইনটারভিউটাই কিন্তু ভিডিও করব।” ট্রাইপডে ক্যামেরাটা লাগাতে লাগাতে বলে উঠল রতন দাশ, ফ্রি-ল্যান্স জার্নালিস্ট।  

“কেন! কোনও চ্যানেলে দেবেন নাকি?”

“না স্যার, এখনও কোনও চ্যানেলের সঙ্গে কথা হয়নি, কিন্তু ইনটারভিউটা তো ছাপা হবে...হতে পারে, এই ভিডিওটাও ওদের ডিজিটাল মিডিয়া নিয়ে নেবে। আপনি ব্যস্ত মানুষ, বারবার করে আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া মুশকিল।”

“তা যা বলেছেন, খালি মিডিয়াকেই সময় দিলে লিখব কখন? চন্দন না বললে আমি আপনাকে সময় দিতাম না। বাই দ্য ওয়ে, আপনাদের এই কাগজটা কোথা থেকে যেন বেরোয়?”

“আগরতলা, ত্রিপুরা থেকে স্যার।”

“বেশ বেশ, কত কাগজ আছে! সব ক'টার নামও জানি না, একটা কপি পাঠিয়ে দেবেন কিন্তু।”

“অফকোর্স স্যার।”

“আপনি একটু বসুন, আমি দাড়িটা কেটে আসি, ভিডিও শুট করবেন যে...হা হা হা।”

রণজিৎ দাম দীর্ঘদিনের পেশাদার সাহিত্যিক। একের পর এক চমকে দেওয়া গল্প-উপন্যাস লিখে পাঠকদের একদম মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন। বাজারে কোনও বই আসার আগেই প্রি-বুকড হয়ে যায় হাজার হাজার কপি। ওঁর বই, দোকানের শেলফে আসার আগে না পড়তে পারলে যেন জীবনটাই বৃথা। ইনটারনেটের যুগে এই এক বড় সুবিধা। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে বসে বই পেতে কোনও অসুবিধা হয় না। পাড়ার দোকানদারকে বলে বই আনাতে হয় না। প্রকাশকের ওয়েব-সাইটে ঢোকো, বই পছন্দ করো, টাকা পাঠিয়ে দাও…ব্যস, বই বাড়িতে পৌঁছে যাবে।  

রণজিৎ দাম-এর সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘চাষির লাঙল কথা’ পাঠককুলের মনে ঝড় তুলে দিয়েছে একেবারে। এই উপন্যাসটির জন্য এ বছর দশ লক্ষ টাকা মূল্যের ‘সানন্দ পুরস্কার’ পেয়েছেন উনি। ছ-মাসে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। সিনেমা হচ্ছে উপন্যাসটি নিয়ে। লাঙলের ফলাকে ঘিরে একটা প্রাণঘাতী শিল্পায়নের আগ্রাসন রুখে দেওয়ার এক টানটান কাহিনি। একবার পড়তে শুরু করে শেষ অক্ষরটি না আসা পর্যন্ত বই বন্ধ করতে পারেনি অধিকাংশ পাঠক। একজন শহুরে মানুষ জীবনে কোনোদিন লাঙল না ধরে যে কী করে একটা এরকম টানটান উপন্যাস লিখলেন, তা নিয়ে ফেসবুকে চর্চা চলছে প্রতিদিন। এককথায় সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন, রণজিৎ দামের দূরদৃষ্টি ও বর্ণনা করার ক্ষমতার তুলনা হয় না। পড়তে পড়তে গল্পের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পাঠকদের মনে হয়েছে যেন ভাগচাষি রমাকান্ত নয়, পাঠকই ছুটে চলেছেন লাঙল নিয়ে কয়েকশো চাষির একজন হয়ে।

“স্যার, এবার তা হলে শুরু করা যাক? যাই বলুন, দাড়ি না কাটলেও কিন্তু আপনাকে যথেষ্ট হ্যান্ডসাম লাগত।”

“হ্যাঁ! কী যে বলেন!”

“স্যার, ক্যামেরা অন করে দিচ্ছি…আপনি ক্যামেরার দিকে না তাকালেও চলবে। আপনি স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে যাবেন। আমি মোবাইলে রেকর্ডার অন করে দিচ্ছি, পরে এটা শুনেই লিখব।”

“টেকনো-রিপোর্টার! হা হা হা...”

“ঠিক তা নয় স্যার। তবে এখন কম্পিউটারে লিখে এমন অভ্যেস হয়ে গেছে…তাছাড়া একটা রেকর্ডিং থাকা ভালো, তাতে পরে কোনও কনফিউসান হয় না।”

“ও.কে, শুরু করুন। কিন্তু একঘণ্টার মধ্যে আপনার ইনটারভিউ শেষ করতে হবে। আমি লাঞ্চের পর বেরিয়ে যাব, একটা সংবর্ধনা-অনুষ্ঠান আছে।”

“আপনার লেখালেখির শুরু কবে?”

“সেই ছেলেবেলায় যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। স্কুলে একদিন আমাদের অঙ্কের শিক্ষকের জায়গায় বাংলার স্যার এসেছিলেন। বললেন---আজ অঙ্ক-টঙ্ক থাক। আজ তোদের কাছ থেকে গল্প শুনব। কে বলবে? আমি উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার গল্প বলা শেষ হতে স্যার বললেন---যা বললি লিখে ফেল, স্কুলের ম্যাগাজিনে ছাপব। লিখে ফেললাম। সে বছর স্কুলের ম্যাগাজিনের শ্রেষ্ঠ গল্পকারের পুরস্কার পেয়েছিলাম।”

“স্যার, এগুলো তো সবাই জানে। মানে অনেক পত্র-পত্রিকাতেই বেরিয়েছে। আপনার পেশাদার লেখক-জীবনের এমন কোনও ঘটনা বলুন না, যা আগে কখনও কাউকে বলেননি।”

“হা হা... আমার জীবনের সব গুপ্তকথা ফাঁস করে দেব নাকি?”

“না, মানে ইনটারভিউতে একটু অন্য ফ্লেভার চাইছি।”

“ঠিক আছে, বলছি। এই ঘটনা আগে কোথাও বলিনি।”

“গ্রেট স্যার! থ্যাঙ্ক ইউ।”

“আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি, গরমের ছুটিতে মামার বাড়ি গাইঘাটা গেছি। সাল তারিখটা ভুল না করলে ১৯৮৩ সালের ১২ এপ্রিল। মাঠে বাতাবিলেবু দিয়ে ফুটবল খেলে মাসতুতো ভাইদের সাথে মাঠের ধারে বসে সদ্য গাছ থেকে পেড়ে আনা কাঁচা আম নুন দিয়ে খাচ্ছিলাম। সন্ধে নেমে আসছে। খুব গুমোট ছিল ওয়েদার আর  টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল। আচমকা অনেকগুলো প্লেন ওড়ার শব্দ যেন শুনতে পেলাম। তখন কলাইকুন্ডা থাকতাম। বাবা এয়ারফোর্সে ছিলেন। কাজেই, প্লেনের আওয়াজের সাথে ভালোই পরিচিত ছিলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, একটা আগুনের গোলা যেন ছুটে আসছে। ভাবলাম, প্লেন থেকে বোধহয় বোমা ফেলা হচ্ছে। বাবার কাছেই শুনেছিলাম, কোথাও কোনও গোলাগুলি চলছে দেখলে কাছে কোনও গর্ত পেলে তাতে ঢুকে বসে থাকলে আহত হবার সম্ভাবনা কম থাকে। মাঠের পাশেই ছিল চাষের খেতে জল নিয়ে যাবার গভীর নালা। ভাইদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম তার ভেতরে। খানিক পরে আগুনের গোলাটা মিলিয়ে যাবার পর নালা থেকে উঠে দেখেছিলাম, দূরের গাছগুলো সব ভেঙে পড়ে আছে। পরে শুনেছিলাম, ওটা ছিল টর্নেডো। ভয়াল ঝড়। ঐ ঘটনাটা নিয়ে লেখা গল্পটাই ছিল আমার কমার্শিয়াল ম্যাগাজিনে লেখা প্রথম গল্প। ‘ধ্রুবতারা’ পত্রিকাতে প্রকাশ পেয়েছিল গল্পটি। পত্রিকার সঙ্গে একটা পঁচাত্তর টাকার চেক পেয়েছিলাম। সেই চেক ভাঙাতে বাবার সঙ্গে ব্যাঙ্কে 'জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট' খুলতে হয়েছিল।”

“প্রথম রোজগারের পর আপনার কী মনে হয়েছিল?”

“গল্প লিখেও যে টাকা পাওয়া যায়, এ ধারণাটাই ছিল না। তখনই ঠিক করেছিলাম লেখাটাকে পেশা করব। যদিও বাবা-মা চেয়েছিলেন যে, আমি ইঞ্জিনিয়ার হই, চাইলে হতেও পারতাম। কিন্তু আমি তা না করে...”

“তার মানে তো বাবার চাকরির সূত্রে অনেক ঘুরে বেড়িয়েছেন? নিশ্চয়ই সেন্ট্রাল স্কুলে পড়তেন, নাহলে এত ভালো বাংলা শিখলেন কী করে!”

“ঘুরেছি অনেক, তবে আমি সেন্ট্রাল স্কুলে পড়িনি, গরফাতে কাকার কাছে মানুষ হয়েছি। বাংলা-মাধ্যম স্কুলেই পড়েছি। তবে হ্যাঁ, ঘুরেছি অনেক। স্কুলে ভ্যাকেশন হলেই কাকা-কাকিমা আমাকে নিয়ে বাবার যেখানে পোস্টিং থাকত, সেখানে যেতেন । আবার বাবা-মাও ভাইকে নিয়ে কলকাতা আসতেন।”

“আপনার কাকার কোনও সন্তান...”

“নেই, আমিই তাঁদের সন্তান।”

“পেশাদার লেখক হবার জন্য অনেক লড়াই করতে হয়েছে নিশ্চয়ই?”

“পায়ের তলায় জমি পেতে ---অবশ্যই। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমার কোনও লেখা অমনোনীত হয়নি। আগে অনেক লিখতাম। এখন লেখা কমিয়ে দিয়েছি। বছরে দু-তিনটের বেশি উপন্যাস আর খানকয়েক গল্পের বাইরে কিছু লিখি না। বেশি লিখলে কোয়ালিটি থাকে না।”

“শুনেছি --- আপনি লিখে টাকা রোজগার না করলেও আপনার কিছু যায় আসে না, কারণ আপনার...”

“ঠিকই শুনেছেন। আমি কাকার কোম্পানির একজন ডিরেক্টর। তবে নামেই, আমি ব্যবসার কিছুই দেখি না। কাকাই সব সামলান। শুধু মাসে মাসে বেতন বাবদ কিছু টাকা আমার অ্যাকাউন্টে ঢোকে।”

“স্যার, যে উপন্যাসটি লিখে আপনি পুরস্কার পেলেন, তাতে তো গ্রামের মানুষ আর তাদের অসম লড়াইয়ের কথা লিখেছেন। এটা লিখতে নিশ্চয়ই আপনি গ্রামে অনেকদিন থেকেছেন…মানে উপন্যাস লেখার ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে যদি কিছু বলেন...”

“মাফ করবেন, এই প্রসঙ্গে কোনও কথা বলব না। কারণ, আমি কিছু লোককে কথা দিয়েছি তাদের আসল নাম-ধাম প্রকাশ করব না। তবে, এই উপন্যাস লেখার আগে অনেক রিসার্চ করতে হয়েছে তো বটেই।”

“স্যার, আপনি পুরস্কারের বিপুল অর্থ দিয়ে কী করতে চান? মানে অনেক সময়ই দেখা যায়, লেখকরা কোনও না কোনও ট্রাস্টে টাকা দান করে দেন। সে রকম কিছু কি…?”

“না, আমার সেরকম কোনও প্ল্যান নেই। ভাবছি, একটা 'বি.এম.ডব্লু' নেব। আচ্ছা, এবার যে আমাকে উঠতে হবে…।”

“স্যার শেষ প্রশ্ন, আপনি রত্নেশ সাহাকে চেনেন?”

“কে রত্নেশ সাহা?”

“স্যার, ত্রিপুরায় থাকে…”

“মনে করতে পারছি না। এত লোকের সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকশান হয়, সবাইকে মনে রাখা সম্ভব নয়।”

“স্যার, আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?”

“কেন বলুন তো?”

“না, আপনার কপালে ঘাম!”

“গরমটা দেখুন!”

“স্যার, আপনার এই এসি-ঘরে তো আমার বেশ ঠান্ডাই লাগছে। আসলে...”

“আসলে কী?”

“আসলে, আপনি মিথ্যে বলছেন।”

“কী বলছেন আপনি!” চিৎকার করে উঠলেন রণজিৎ দাম। 

“আপনি মিথ্যে বলছেন মিস্টার রণজিৎ দাম।” শীতল গলায় বলেন সাংবাদিক রতন দাশ।

“আপনি একটি জোচ্চোর মিস্টার রণজিৎ দাম। জোচ্চোর নন চোর। আপনি রত্নেশ সাহাকে খুব ভাল চেনেন।”

“আমাকে জোচ্চোর বলছেন! বেরিয়ে যান এখুনি। না হলে পুলিশ ডাকব, মিডিয়া ডাকব। উফ্! কেন যে এ সব উটকো লোককে ইনটারভিউ দিতে গেলাম!”

“ডাকুন না স্যার। মনে রাখবেন, ক্যামেরা চলছে এবং রেকর্ডার নয়, আমার ফোন অন করা আছে। আপনি টেরও পাচ্ছেন না যে, ফোনের উলটো দিকে একজন কথাগুলো শুনছে এবং সেগুলো অটোমেটিক রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। আপনি মিডিয়া ডাকলে আপনার কীর্তিকলাপ ফাঁস করতে আমার সুবিধা হবে আর আপনার লেখক-জীবন চিরতরে শেষ হয়ে যাবে আজ, এখনই।”

“আপনি প্রলাপ বকছেন। কে পাঠিয়েছে আপনাকে? ব্ল্যাক জার্নালিজম করছেন!”

“মিডিয়াকে ডাকব? না কি স্বীকার করবেন যে, রত্নেশকে আপনি চেনেন?”

“হতে পারে রত্নেশ নামে আমি কাউকে চিনি, তাতে কী প্রমাণ হয়?”

“তার মানে আপনি স্বীকার করছেন আগরতলার রত্নেশকে চেনেন?”

“আমি মনে করতে পারছি না।”

“মুখের ঘামটা মুছুন স্যার। রুমাল আছে, না দেব?”

“আপনি আপনি...”

“এই মেলটা দেখুন স্যার, আজ থেকে ঠিক দু-বছর আগে রত্নেশ সাহার পাঠানো।”

“আমি দেখতে চাই না। শত শত মেল আমার কাছে আসে। আমি সব পড়ি না।”

“গ্রেট, আপনি ঠিক বলেছেন, সব মেল দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু এটা দেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, আপনি অ্যাকনলেজও করেছেন।”

“তাতে কী হল! এক লাইনের উত্তর আমি অনেককেই দিয়ে থাকি।”

“পারফেক্ট, কিন্তু আপনি এক লাইনের উত্তর দেননি। লিখেছিলেন---অসাধারণ লেখা মনে হচ্ছে, পুরোটা পড়ে দেখে জানাব।”

“এরকম উত্তর আমি অনেক দিয়েছি।” 

“নিশ্চয়ই, পাঠককে খুশি করতে এরকম উত্তর আপনাকে লিখতেই হয়। আপনি গুণী লেখক। আপনার এক লাইনের প্রশংসা উঠতি লেখকদের কাছে অনেক। কিন্তু এরপর আপনি রত্নেশের সঙ্গে আর যোগাযোগ করেননি, কিন্তু ওর বিশাল উপন্যাসটি সামান্য বদল করে আপনি নিজের নামে প্রকাশ করেছেন। পঁয়ষট্টি হাজার শব্দের কাজ ২৫২ পাতার বই হয়ে তিনশো পঞ্চাশ টাকায় পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি বিক্রি হয়েছে। রাইট?”

“আপনি কে?”

“স্যার, ঘাবড়াবেন না। আমি একথা কাউকে প্রকাশ করব না যদি আপনি পুরস্কার, সিনেমা কোম্পানি আর রয়্যালটি থেকে পাওয়া অর্থের পঞ্চাশ শতাংশ নগদে দিয়ে দেন। আর টাকাটা দিয়ে দিলে এরকম লেখা আরও পাবেন। পরশু আসি? ওহ্ বলতে ভুলে গেছি, আমিই রত্নেশ সাহা। রতন দাশ নামেই সংবাদমাধ্যমে রিপোর্টিং করি। ভালো মার্কেটিং পারসন নই। মার্কেটিংটা আপনি করুন, লেখা আমিই আপনাকে সাপ্লাই দেব। কেউ জানবে না। তবে শর্ত ওই --- ফিফটি-ফিফটি!”


………………


অলঙ্করণঃ- সায়ন্ন্যা দাশদত্ত


No comments:

Post a Comment