প্রবন্ধঃ চাইলে যেতে পারেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় কিন্তু কেন যাবেনঃ অনুপম হাসান

চাইলে যেতে পারেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, কিন্তু কেন যাবেন


অনুপম হাসান



কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় [১৯৩৩-'৯৫] ইহলোকে কিংবা বলা যায়, বস্তুগত এ জগতে আমাদের মাঝে আর নেই, একথা নিশ্চিতভাবেই আমরা বলতে পারি; কিন্তু তিনি কোথায় আছেন? মৃত্যুর পর তিনি কোথায় আছেন, একথা আমরা কেউ জানি না। শক্তির মতো অন্য যারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন তাদের ঠিকানাও আমাদের অজানা। অতএব একইভাবে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ঠিকানাও আমরা জানি না। কেননা অদ্যাবধি মানুষের চর্চিত জ্ঞানের ভিত্তিতে বলা যায়, মৃত্যুর পর মানুষ হয়তো স্বর্গে নয়তো নরকে যায়। অথচ সেই স্বর্গ কিংবা নরক সম্বন্ধে মানুষের নিকট স্পষ্ট কোনও ধারণা পর্যন্ত নেই; যা আছে তা শুধুই কল্পনার এক জগৎ। প্রকৃতপ্রস্তাবে স্বর্গ-নরক আদৌ আছে কিনা, এখন অবধি মানুষ সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি। মৃত মানুষের ঠিকানা জানা যায় না, তবে একথাও সত্য যে, শক্তির মতো অনেকেই দৈহিকভাবে মৃত্যুবরণ করেও আমাদের আত্মার খুব কাছাকাছি বসবাস করেন। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে প্রাণের ক্ষয় অনিবার্য হলেও প্রতিভা এবং সেই প্রতিভা-বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মির কোনও ক্ষয় নেই! ফলে নিশ্চিত বলা যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় বস্তুজগৎ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগেই স্বীয় সৃজন-প্রতিভার যে আলো ছড়িয়েছিলেন তা কোনোদিনই ম্লান হবে না এবং তাঁর প্রতিভার এই আলো আমাদের ছেড়েও যাবে না! যেমন আমাদের জীবন থেকে এখনও হারিয়ে যাননি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দসহ অসংখ্য কবি ও লেখক। তেমনি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও থেকে যাবে স্বীয় রচনার বিচ্ছুরিত আলোক রশ্মির অদৃশ্য এক শক্তির মধ্যে নিহিত থাকবেন, বহুদিন বহুকাল বহু শতাব্দী। মানুষের মৃত্যু তাকে দৈহিকভাবে জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়; কিন্তু মৃত্যুর আগে মানুষ যদি স্বীয় প্রতিভা বলে এমন কোনও কীর্তি বস্তুজগতে রেখে যেতে পারেন, যা জগতের কিংবা মানুষের কোনও উপকারে অথবা কোনওভাবে কাজে লাগে; তাহলে তিনি দৈহিকভাবে মৃত্যুবরণ করলেও বিদ্যমান বস্তুজগতেই বেঁচে থাকে অন্য মানুষের মনে। আর সেই মানুষের বেঁচে থাকার এ প্রক্রিয়া চলতেই থাকে বছরের পর বছর, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

শক্তি চট্টোপাধ্যায় পঞ্চাশের দশকে কাব্যযাত্রা শুরু করলেও প্রথম গ্রন্থিত হয়েছিলেন ষাটের দশকে। ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’ [১৯৬২] প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় এক রহস্যময়তার অবভাস সৃষ্টি করেন, যা অনেকটাই তিরিশের কবি জীবনানন্দ দাশের [১৮৯৯-১৯৫৪] কবিতার মতো। শক্তির কবিতায় জীবনানন্দীয় অবভাস থাকলেও তিনি কিন্তু সচেতনভাবে তিরিশের সম্প্রসারিত মানসিকতার পরিবর্তে নিজস্ব কাব্যপথ বেছে নিয়েছিলেন এবং ক্রমাগত উত্তরণের দিকে হেঁটেছেন। এর অনিবার্য ফলস্বরূপ একসময় দেখা গেল শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পূর্ণ নিজস্ব এক কাব্যভাষা নির্মাণ করতে সক্ষম হলেন, যা আপাত-অর্থে সহজ-সরল; কিন্তু সেই সারল্যের মোড়কে তিনি চিন্তাসূত্রের রহস্য লুকিয়ে ফেললেন অবলীলায়। প্রসঙ্গত বলা দরকার যে, ভাববাদ প্রভাবিত দর্শনচেতনা শক্তি চট্টোপাধ্যায় পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে। সেই ভাববাদকে তিনি আণবিক যুগের বস্তুবাদের সাথে সংমিশ্রণের অবিচ্ছেদ্যসূত্রে সমন্বিত করে নবতর এক চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন কবিতায়। এরফলে মনে হয়, তাঁর কাব্যভাষা সহজ-সরল, প্রকৃতপ্রস্তাবে তা নয়; যেমনটি জীবনানন্দ দাশের কবিতার কোনও শব্দ পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য না হলেও প্রকৃত অর্থ বা কাব্যার্থ অত্যন্ত দুরূহ। একই ঘটনা শক্তির কবিতার ক্ষেত্রেও ঘটতে দেখা যায়। অর্থাৎ তাঁর কবিতার সরল শব্দ অতিক্রম করে পাঠকের নিকট কাব্যার্থ বা কাব্যচেতনা অপার রহস্যময়তায় আবৃত থাকে। একথা ঠিক প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের পর থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ক্রমাগত সামনের দিকে এগিয়েছেন এবং সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছেন; এ যাত্রায় তাঁকে ষাট থেকে আশির দশক পর্যন্ত সময় অতিক্রম করতে হয়েছে ধৈর্য সহকারে।

আশির দশকে প্রকাশিত হয় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতাগ্রন্থ ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’ [১৯৮২]। তাঁর এ কবিতাগ্রন্থটি যে মহার্ঘ্য রচনা, তা বোঝা যায় পরের বছর ১৯৮৩ সালে যখন গ্রন্থটি ‘পশ্চিমবঙ্গ সাহিত্য আকাদেমি’ পুরস্কার লাভ করে। সামগ্রিক অর্থে বাংলা কবিতায় [পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশ] শক্তি চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্র-জীবনানন্দ উত্তরকালে সত্যিকার অর্থে শক্তিমান কবি। এক্ষেত্রে তাঁর নামের সাথে বাংলাদেশের শামসুর রহমান [১৯২৯-২০০৬] এবং আল মাহমুদের [১৯৩৬-২০১৯] কথা যেমন স্মরণ রাখতে হয়, তেমনি ওপার বাংলার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় [১৯৩৪-২০১২] কিংবা শঙ্খ ঘোষের [জ.১৯৩২] নামও অস্বীকার করার উপায় থাকে না; এঁদের কবিত্ব শক্তিও কোনও অর্থে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের চেয়ে কম নয়! এসব নামের ভিড়েও শক্তি চট্টোপাধ্যায় যে খানিকটা আলাদা ছিলেন, তা বলা বাহুল্য; তাঁর কবিতার বিষয়-বিন্যাস, প্রকরণ বৈচিত্র্য এবং কাব্যগুণের দক্ষতা অসাধারণ অথবা বলা যায় প্রাতিস্বিক।

শক্তি চট্টোপাধ্যায় ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’ কবিতাগ্রন্থটির নামকরণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য ও দ্যোতনার ইঙ্গিত। কবিতার বইয়ের এ জাতীয় নামকরণে আমাদের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয় কবি কি এ সময় খুব বেশি এলিয়েনেটেড হয়ে পড়েছিলেন?

এলিয়েনেশনের কারণে কি কবি আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নিতে চেয়েছিলেন? এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব আজ আর আমাদের জানা সম্ভব না হলেও, কবির টেক্সট থেকে আমাদের বুঝে নিতে হবে— আসলে সে সময় কবির অন্তর্গত চিন্তা-চেতনা কী ছিল? ‘আত্মহত্যার’ প্রকল্পটি যদি সত্যি হয় সেক্ষেত্রে একটি বিষয় কোনওভাবেই অস্বীকার করা যায় না যে, কবি তো পরিণামে আত্মহত্যা করেন নি। বিচ্ছিন্নতা বা একাকীত্বের দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে তিনি যদি আত্মঘাতী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও পরিণামে সেই এলিয়েনেশনের যন্ত্রণাবৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে সদম্ভে ঘোষণা করেছেন : ‘কিন্তু কেন যাবো’। আমাদের ‘আত্মঘাতী’ প্রকল্পিত ধারণার অনেক কারণ তাঁর ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’ কবিতাগ্রন্থের পর্যালোচনায় হয়তো পাওয়া যাবে অথবা উন্মোচিত হবে। এবারে আমরা শক্তির এলিয়েনেশন কিংবা আত্মঘাতী হওয়ার মতো কোনও অবস্থা তিনি টেক্সটে বয়ান করেছেন, সেটা দেখা যাক। যেমন তিনি ‘এখন আমার কোনও অভিমান নেই’ কবিতায় অক্ষরবৃত্তের অসাধারণ গাঁথুনিতে তুলে ধরেছেন নিজের অভিমানহীনতার কথা :

মাটির কলস কেন অভিমান করে?

গা-ভরা জলের ফোঁটা নামে এঁকেবেঁকে—

নিচে যেন নদী পাবে, প্রিয় মুখ পাবে,

বুকের দীঘিটি নোনা জলেই ভাসাবে

আজ। কেন? সুযোগ মিলেছে?

[এখন আমার কোনও অভিমান নেই]

‘মাটির কলস’ অর্থে তো প্রকান্তরারে মাটির তৈরি মানবশরীরকেই বুঝিয়েছেন শক্তি; যে দেহ থেকে নানা কারণে অশ্রুবিন্দু ঝরে, যন্ত্রণায় কাতর হয় এবং সর্বোপরি অভিমান পেয়ে বসে তাকে চরম প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য; মানব মননের এই অভিমানাহত বৃত্তায়িত খাঁচা থেকে যদি ব্যক্তি বের হতে না পারে, তখন সেই বন্দি মানুষের পক্ষে আত্মঘাতী হওয়াটাও অসম্ভব কিছু না! কবির অভিমান সংসারের আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো নয়, কবির থাকে এক নিজস্ব ভুবন; যে ভুবনের অধীশ্বর তিনি নিজেই। কবির নির্মিত সেই কাব্যভুবনে মাত্র দশ বছরে কতটা বদল ঘটেছে তা শক্তির বয়ানে এরকম: ‘মানুষের মুখচোখ মাত্র দশবছরে বদলে গেছে।’—[দশবছর আগে-পরে] কেন এ পরিবর্তন? সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন অবধারিত; জাগতিক প্রক্রিয়ায় সময়প্রবাহের মানবদেহের পরিবর্তন অনস্বীকার্য; একথা কী কবির অজানা! তথাপি এরূপান্তর কিংবা পরিবর্তন কি শক্তির কাম্য ছিল না? হয়তো সে কারণেই তিনি যন্ত্রণাবিদ্ধ ও বেদনাহত হয়েছেন; কিন্তু নিজেকে তাৎক্ষণিক সামলেও নিয়েছেন:

তবে হবে পরে হবে, সবকিছু যখন ছাড়ের

আওতায় এসেছে, একে সবিশেষ ছাড় দিতে হবে।

[সবিশেষ ছাড়]

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় উত্তর-আধুনিক সাহিত্যতত্ত্বের বিতর্কের মধ্যে বসে কবিতা লিখেছেন। সাহিত্য-সমালোচকদের মধ্যে যখন তর্ক-বিতর্ক ওরিয়েন্টালিজম, পোস্ট-কলোনিয়ালিজম কিংবা উত্তরাধুনিক বিষয়ক তত্ত্ব নিয়ে, তখন শক্তি চট্টোপাধ্যায় কবিতায় অবলীলায় ভারতীয় অধ্যাত্মবাদী বা ভাববাদী দর্শনের প্রকাশ করেছেন নিরন্তর নির্বিকারভাবে। কবি তখন মৃত্যুচিন্তায় ডুবে যেতে যেতে কিছু একটা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছেন; কিন্তু আধুনিক বিশ্বের মানুষ বৈজ্ঞানিক চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে মৃত্যুর সামনে বাঁধ দেয়ার শত চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে চলেছে। এক পর্যায়ে বিজ্ঞানও মেনে নিয়েছে মৃত্যু অনিবার্য এবং অবশ্যম্ভাবী সত্য। যদিও সম্প্রতি মানবশরীরের সমগ্র জিন-সিকোয়েন্স আবিষ্কারের ফলে বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন যে, শরীরের যে কোষটি মানুষকে বুড়ো করে দেয়, সেটাকে তাঁরা চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন। বুড়িয়ে যাওয়া কোষটিকে বিজ্ঞানীরা নিয়ন্ত্রণের উপায় খুঁজছেন, সেটি পেয়ে গেলে মানুষ হয়তো বুড়ো হবে না, কিন্তু মরবে না— এমন কথা বিজ্ঞানীর ঘোষণা দিতে পারেন নি। পরিণামে বলতেই হবে মৃত্যুকে প্রতিরোধের কোনও উপায় নেই। একথা জানার পরও শক্তি চট্টোপাধ্যায় এতটা শক্তি [বল অর্থে] কোথায় পান যে, তিনি যাবেন না বলে দৃপ্ত ঘোষণা করেন? কিন্তু যেতে তো হবেই! রবীন্দ্রনাথও [১৮৬১-১৯৪১] স্বীকার করেছেন : ‘যেতে নাহি দিব হায়!/ তবু যেতে দিতে হয়।’ অথচ এই রবীন্দ্রনাথও একসময় দম্ভোক্তি করে লিখেছিলেন : ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে।’ কিন্তু চরম ভাববাদী রবীন্দ্রনাথকেও মৃত্যুর হেমলক পান করতে হয়েছে, তিনিও মৃত্যুবরণ করেছেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় এই আপ্ত বাক্যের ঊর্ধ্বে কেউ নন; যখন তিনি রক্তমাংসে গড়া একজন মানুষ। যতোই দম্ভ করুন না কেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর অনিবার্যতা স্বীকার করে নিতেই হয়েছে এবং তিনি জীবনের পরিণাম সম্পর্কে লিখেছেন ‘এপিটাফ’ কবিতা। বলা বাহুল্য, এই এপিটাফ আর কারো জন্য নয়, একান্তভাবে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নিজের জন্যই রচনা করেছেন তিনি। আট পঙ্ক্তির ‘এপিটাফ’ কবিতায় তিনি নিজের যাপিত জীবনকথা লিখে রাখতে চেয়েছেন এভাবে :

কিছুকাল সুখ ভোগ করে হল মানুষের মতো

মৃত্যু ওর, কবি ছিল, লোকটা কাঙালও ছির খুব।

মারা গেলে মহোৎসব করেছিল প্রকাশকগণ,

কেননা, লোকটা গেছে, বাঁচা গেছে, বিরক্ত করবে না।

[এপিটাফ]

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’ কাব্যগ্রন্থের প্রায় প্রতিটি কবিতায় কবির মৃত্যুবোধ প্রবলভাবে ক্রিয়াশীল। প্রতিনিয়ত মৃত্যুচিন্তা তাঁকে তাড়িতে করেছে ‘সুন্দর ভুবন’ ছেড়ে যাওয়ার বেদনায় আহত হয়েছেন। মৃত্যুভাবনায় কবির অন্তর্জগত ভেঙে তছনছ হয়ে না গেলে তিনি কী বলতে পারতেন:

পুড়তে আমি ভালোবাসি, ভালোই বাসি।

পুড়তে আমি চাচ্ছি কোনও নদীর ধারে।

কারণ একটা সময় আসে, আসতে পারে

যখন আগুন অসহ্য হয় নদীর নদীর ধরে।

[মৃত্যু]

অর্থাৎ এখানে শ্মশানের কথা স্পষ্টভাবেই উঠে এসেছে; কবি শক্তি যেন মৃত্যুকে ধীরে ধীরে সহনীয় করে তুলছেন নিজের কাছে অথবা নিজেকে প্রস্তুত করছেন মৃত্যুর কাছে সমর্পণের জন্য। অথচ কী আশ্চর্য কাব্যগ্রন্থের নামকরণের সময় তিনি বড্ড অহংকার করেছিলেন, তিনি যাবেন না! তিনি তো জানতেন রবীন্দ্রনাথের কথা: ‘তবু যেতে দিতে হয়।’ অবশ্য সময় বয়ে যাওয়ার সাথে সাথে কবি যেন স্থিত হয়েছেন, মেনে নিয়েছেন জাগতিক বাস্তবতাকে। সম্ভবত কবির সহনীয় চেতনা অহংকারের ফাঁপা বেলুন ফুটো করে দিয়েছে, তখন তিনি লিখেছেন:

পশমের অন্তর্গত হয়ে আছে অসুস্থ বিড়াল

খুব কাছে বসে আছে হিতব্রতী অসুস্থ বিড়াল

কাছে বসে আছে কিছু পাবে বলে, অমরতা পাবে। 

[বিড়াল] 

আমরা জানি জাগতিক রঙ্গমঞ্চে অনেক মানুষ আছেন যারা জেনেও না জানা কিংবা দেখেও না দেখার ভাব করেন ব্যক্তিগত স্বভাবের কারণে। পরিণামে কবি শক্তি নিজের জানাকে কিংবা বোঝাকে আর অস্বীকার করেন নি, বরং স্পষ্ট করেই বলেছেন: ‘সুখের অত্যন্ত কাছে বসে আছে অসুখী বিড়াল।’ — [বিড়াল] আসলে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় আজীবন প্রাণপণে এই ‘অসুস্থ’ এবং ‘অসুখী’ বিড়ালটাকে তাড়াতে চেয়েছিলেন; কী ব্যর্থ প্রয়াস! জীবনের সমগ্র অভিজ্ঞতার সাড়ৎসার যখন লিখতে হয়েছে, তখন নিজেকে উপস্থাপন করেছেন ‘এপিটাফ’-এর সামনে। মৃত্যুকে পরিণামে মেনে নিতে হলেও কবি শক্তি লড়াই করেছেন মৃত্যুর বিরুদ্ধে জীবনকে টিকিয়ে রাখতে; দু’হাতে সরিয়ে দিতে চেয়েছেন মৃত্যুভয়কে। অর্থাৎ একটা জেদ ঠিকই ছিল শক্তির মনে-মননে। তাই তিনি লিখেছেন:

সমুদ্র জীবিত আছে, মৌনের উপরে আছে মেঘ,

মেঘের মতন এলোমেলো ঢেউ আছড়ে পড়ে তীরে,

আবার গুটিয়ে যায়, কেন্নোর মতন, ছোঁয়া লেগে।

ফুঁসে ফিরে আসে ফের, ঘা-খাওয়া জন্তুর মতো, তীরে।

[নিচ থেকে আমি ঐ রূপবান]

এখানে কবি ‘সমুদ্র’ প্রতীককে মৃত্যুর বিরুদ্ধে জীবনের লড়াই এবং অহংকার চিত্রিত করেছেন। এখানে কবি সরাসরি নিজের কথাই বলেছেন যেন; কেননা একসময় মানুষ নিজের চিন্তার বিরুদ্ধেও গিয়ে প্রেরণা খোঁজে:

[...] পরিত্রাণ

চাই, বাঁচতে চাই, বেঁচে থাকতে চাই

শুধু বাঁচা, অহরহ মৃত্যুর ওলোটপালোটের

মধ্যে বেঁচে থাকতে চাই, শুধু বাঁচতে চাই। 

[শুধু বাঁচতে চাই]

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় এই যে এলোমেলো পঙ্ক্তি, যার অর্থ খুঁজে খুঁজে হন্যে হয় পাঠক, তার পেছনে ক্রিয়াশীল কবির অন্তর্জগতের অপার রহস্যময়তার আবরণ।

পঞ্চাশের দশকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় যে যাত্রা শুরু করেছিলেন বাংলা কবিতাঙ্গনে ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’ [১৯৬২] কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে, তারপর আর পিছনে ফিরে তাকান নি। তিনি ক্রমাগত নিজেকে ভেঙেগড়ে বাংলা কবিতার চূড়াদেশে পৌঁছে গিয়েছিলেন আশির দশকেই। আর্কিবন্ড ম্যাকলিন-এর ভাষায় ‘কবিতা শুধু হয়ে উঠতে থাকবে।’ আমাদের কাছে মনে হয়েছে, শক্তির কবিতাও এই সূত্রানুসারে হয়ে উঠেছে আর প্রতিনিয়ত জড়িয়ে পড়েছে এক অপার রহস্যময়তার আড়ালে, আবরণের অতল গহ্বরে। কবিতার এই রহস্যময়তা এবং দৃশ্যমান অবচেতনার জগতে প্রবেশ করা সম্বন্ধে সমালোচক মন্তব্য করেছেন :

“জীবনানন্দের কিছু কিছু কবিতা যেমন ‘ঘোড়া’ ‘বিড়াল’ ইত্যাদিতে যে-রহস্যময় অবচেতনার ইশারা স্ফুরিত হয়ে উঠেছিল, শক্তি সেই রহস্যময়তাকেই ষাটের সময়পর্বে আবার গভীরভাবে ফিরিয়ে আনলেন কবিতায়।”

[মাসুদুজ্জামান, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলার কবিতা: তুলনামূলক ধারা, ১ম-প্র, ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯৩] 

কবিতায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় সবটুকু অর্থ উন্মোচন করেন দেন নি; টুকরো টুকরো অথবা বিচ্ছিন্নভাবে এক প্রতীকী প্রতিকল্প নির্মাণ করেছেন, যেখানে পাঠক কখনও কখনও রহস্যের অতল তলে ডুবে যায়। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো’ কাব্যগ্রন্থটিতেও ঠিক অনুরূপ অবভাস রয়েছে মৃত্যুভাবনা সম্বন্ধে। একদিকে তিনি অহংকার করেছেন, অন্যদিকে তিনি ‘এপিটাফ’ রচনা করে অবলীলায় মৃত্যুকে সাদরে গ্রহণ করেছেন। জীবনানন্দীয় রহস্য তাঁর সহজ-সরল কাব্যভাষার আড়ালে গভীর অর্থের দ্যোতনাবাহী হয়ে উঠেছে; বলা যায় পরিণামে সাধারণ অর্থের বাইরে গিয়ে শক্তির কবিতা সুদূরের ইঙ্গিতবাহী। ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’ কাব্যগ্রন্থে শক্তি চট্টোপাধ্যায় সেই রহস্যের মায়াজাল বিস্তার করেছেন অপার কল্পনার সাহায্যে। শক্তির সেই রহস্যের অতলে ডুব দিয়ে খুঁজে নিতে হয় তিনি কতটা মৃত্যুভয়ে ভীত কিংবা মৃত্যু-বিলাসী ছিলেন। এ গ্রন্থের কোনও কোনও কবিতায় মৃত্যু-বিলাস থাকলেও সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে দেখা যায় কবির অন্তর জুড়ে ক্রিয়াশীল ছিল বিভীষিকাময় মৃত্যুভীতি কিংবা মৃত্যুকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবল বাসনা।

শক্তি চট্টোপাধ্যায় ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’ কাব্যগ্রন্থের নাম-কবিতায় কবি মৃত্যুর কথা তুলে ধরেন এবং একইসময় মৃত্যুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও নিজের অহংকার প্রকাশ করেন। এ কবিতায় স্পষ্টতই মৃত্যুর বিরুদ্ধে শক্তির শাণিত উচ্চারণ শোনা যায়। কবিকে মৃত্যু কিভাবে ডাকে, সেকথা কবি লেখেন এভাবে:

চাঁদ ডাকে: আয় আয় আয়

কবিকে মৃত্যু তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে

চিতাকাঠ ডাকে: আয় আয়। 

[যতে পারি কিন্তু কেন যাবো?]

মৃত্যু কবি ডেকে কাছে নিতে চায়, অথচ কবি মৃত্যু নামক অমোঘ নিয়তিকে চ্যালেঞ্জ করেন, তিনি বলেন যাবেন না! এক অবিশ্বাস্য অন্তর্গত শক্তির জোরেই হয়তো কবি বলেন: 

যাবো

কিন্তু এখনি যাবো না

তোমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যাব

একাকী যাবো না অসময়ে। 

[যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো?]

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের হৃদয়ের কোমলতা জুড়ে প্রেম-প্রকৃতির প্রতি অবিশ্বাস্য রকমের আকর্ষণ ও ভালোবাসা। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়েছেন, কিন্তু মনের ভেতরে তিনি আজও চির তরুণ, চির সবুজ। তিনি এখনও চিরকাঙাল ভালোবাসা আর প্রেমের: 

কোলের কাঙাল আমি, পিপাসার্ত আমি,

কেবলই চন্দন-চিতা আমন্ত্রণ করে:

[তুমি একা থেকো]

মৃত্যুর এই আমন্ত্রণকে কবি সব-সময়ই উপেক্ষা করতে চেয়েছেন; জাগতিক জীবনের মোহ ত্যাগ করে তিনি কোথাও যেতে প্রস্তুত নন। এজন্য মৃত্যুর পরোয়ানা উপেক্ষা করেছেন আর বলেছেন:

জল দাও শিকড়ে আমার

জল দাও হৃদয় ভাসায়ে

শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভাসাও

আমার শিকড় দেহখানি। 

[ফিরে আসে] 

অক্টোপাসের মতো মৃত্যু কবিকে টেনে ধরে, তারপর তিনি ‘শিকড়ে’ জল ঢালতে বলেন, শুধু বেঁচে থাকবেন বলে; কোনওভাবে মৃত্যুকে স্বীকার করে নিতে চান না। কিন্তু কবি কী দেখেননি, মৃত্যুর অনিবার্য অথবা প্রাণীর মৃত্যু এক চিরন্তন সত্য? এ সত্য কোনওভাবেই কারো অস্বীকার করার উপায় নেই। সম্ভবত এ কারণেই কবির মনে হয়েছে:

জলে ভেজা, ভাঙা চোরা গুঁড়ো--

জঙ্গলও কিছুটা উড়ো পুড়ো

কী যেন কী হবে মনে হয়। 

[কী যেন কী হবে]

রবীন্দ্রনাথ এক মৃত্যুকে অস্বীকার করে ‘সুন্দর ভুবন’ ছাড়তে চান নি; আবার নিজের বিরুদ্ধে গিয়েই লিখেছেন: ‘মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান।’ এসব সমীকরণ পরিণামে ব্যর্থ হয়ে গেছে এবং তাঁকেও পৃথিবী ছেড়ে যেতে হয়েছে, মৃত্যুর অনিবার্য সত্যকে মেনে নিতেই হয়েছে। এই বাস্তব অভিজ্ঞতা-উপলব্ধি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ছিল না, তা নয়; অবশ্যই তাঁর ছিল এসব বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান। তিনিও জানতেন মৃত্যু অনিবার্য, অনস্বীকার্য এক সত্য। ‘আগুন লেগেছে’ কবির চারপাশে আর তিনি সেই আগুনে পুড়তে পুড়তে লিখছেন:

লেগেছে অসহ্য টান বুকে ও পাথরে।

পুড়েছে কমল, যার প্রান্ত নেই, শুধু ওড়ে ছাই ...। 

[আগুন লেগেছে]

এজন্যই সম্ভবত শক্তি চট্টোপাধ্যায় চিন্তাভাবনা শেষে এবং জীবনের পরিণাম সম্পর্কে সম্যক অবহিত হওয়ার পর নিজেরই মৃত্যুর আয়োজন করেছেন এবং লিখেছেন ‘এপিটাফ’। আর প্রিয়-মানুষ এবং বিরহ-দুঃখে যে প্রিয়তমা তাঁকে বারবার ক্লান্ত করেছে, তার জন্য বিদায়ী প্রার্থনায় কবি লিখেছেন:

যা হয় তা হোক

কিন্তু, তুমি ভালো থেকো

তুমি ভালো থেকো। 

[ভালো থেকো]

সুতরাং ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো’ কাব্যগ্রন্থের শেষের দিকের কবিতাগুলোতে কবি শক্তির মানস-প্রবণতা মৃত্যুকে অনেকটা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে চেয়েছে। অর্থাৎ কবি যে অহংকার দেখিয়ে বলেছিলেন, তিনি কেন যাবেন? সেই অহংকারের জায়গাটা ক্রমশ ছেড়ে দিয়ে নীরবে নিজের ‘এপিটাফ’ রচনা করেছেন। বিজ্ঞান-মনস্ক শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও জানেন কোনও বস্তুই অবিনশ্বর নয়; বস্তু যেমন একদিকে নশ্বর, অন্যদিকে তেমনি পরিবর্তন ও রূপান্তরশীলও বটে। তাই শক্তির কণ্ঠে উচ্চারিত হয় : ‘আগুনে পুড়ে গেল লোকটা— কবি ও কাঙাল।’ সুতরাং কাব্যগ্রন্থের শেষ চরণে মৃত্যুভয়ে ভীত কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় নিজেকে যে মৃত্যুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছেন, তা স্পষ্টত ব্যক্ত করেছেন। তিনি মৃত্যুকে যেন আর ভয় পান না, তবে বস্তু জাগতিক নিয়মকে অস্বীকার করেন না। শক্তি চট্টোপাধ্যায় মৃত্যুর এই ভয়কে জয় করতে পেরেছেন বলেই দৈহিকভাবে মৃত্যুর পরও যথার্থ মর্যাদায় পৃথিবীতে তাঁর পাঠকবৃন্দের হৃদয়ের পদ্মাসনে অধিষ্ঠিত আছেন এবং থাকবেন চিরকাল।


……………………….


 

No comments:

Post a Comment