প্রবন্ধঃ তথ্যগুপ্তিবিদ্যা, মঙ্গলের দুই চাঁদ ও ইনটারনেটঃ গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

তথ্যগুপ্তিবিদ্যা, মঙ্গলের দুই চাঁদ ও ইনটারনেট


গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


 

SMAISMRMILMEPOETALEUMIBUNENUGTTAUIRAS

উপরের শব্দটা পড়ে ঘাবড়ে গেলেন তো! এটা ছিল এক চিঠিতে, এটা বুঝতে গেলে লাতিন জানা দরকার। অবশ্য শুধু লাতিন জানলেই হবে না। পত্রপ্রাপক ভাষাটা ভালোই জানতেন, কিন্তু তিনিও প্রথমে বুঝে উঠতে পারেননি, কারণ লাতিন ভাষায় এরকম কোনও কথা নেই। যখন বুঝলেন এই অক্ষরগুলোর মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের কথা লুকিয়ে আছে, তখন তিনি তার অর্থ উদ্ধারের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমরা সেই কাহিনিতে ফিরব, কিন্তু তার আগে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যুগে যুগে কেমনভাবে লুকিয়ে রাখা হত, সেদিকে একটু চোখ রাখি।

এক্ষেত্রে না হলেও অনেক সময়েই সমস্যাটা শুধু তথ্য লুকিয়ে রাখা নয়, তা উদ্ধার করারও বটে। আমরা অনেকেই ইনটারনেটের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করি। এটা নিশ্চিত হওয়া দরকার যে মাঝপথে কেউ আমার অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড ইত্যাদি জেনে যাবে না, অথচ ব্যাঙ্কের কম্পিউটার সহজেই তা পড়তে পারবে। এ জন্য আমার পাঠানো সমস্ত তথ্যকে এনক্রিপ্ট অর্থাৎ সংকেতবদ্ধ করে পাঠাতে হয়। একই রকম প্রয়োজন হয় যুদ্ধক্ষেত্রে। ধরা যাক রেডিওর মাধ্যমে কোনও সৈন্যদলের কাছে বার্তা পাঠানো হচ্ছে, স্বাভাবিক ভাবেই বিপক্ষও সেই বার্তা শুনতে পাচ্ছে। তাই আসল খবরটাকে এমনভাবে সংকেতবদ্ধ করে পাঠাতে হবে যে কোড ভাঙার চাবিকাঠি ছাড়া কেউ যেন তার মর্মোদ্ধার করতে না পারে। এই বিষয়কে বলে ক্রিপ্টোলজি বা তথ্যগুপ্তিবিদ্যা।

গোয়েন্দা গল্পে এরকম অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। উদাহরণ স্বরূপ বইয়ের মাধ্যমে সংকেতবদ্ধ করার কথা ভাবা যায়। বার্তাটির শব্দগুলিকে কোনও বইয়ের থেকে বেছে নেওয়া হল, তারপর লিখে দেওয়া হল যে বইয়ের কোন পাতার কোন শব্দ পড়তে হবে। এখানে ওই বিশেষ বইটিই হল চাবিকাঠি; কোন বই না জানা থাকলে সংকেতের অর্থ উদ্ধার শক্ত। দি ভ্যালি অফ ফিয়ার উপন্যাসে শার্লক হোমস কোন বই ব্যবহার করা হয়েছে সে কথা অনুমান করে সহজেই বার্তাটা বুঝতে পেরেছিলেন।

তথ্যগুপ্তিবিদ্যার ইতিহাস বহু প্রাচীন। মিশরের চার হাজার বছরের পুরোনো সমাধির দেয়ালে ক্রিপ্টোগ্রাফির নমুনা পাওয়া গেছে, যদিও তার কারণটা ঠিক পরিষ্কার নয়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে গুপ্তচরদের কাছে সংকেতের মাধ্যমে বার্তা পাঠানোর কথা আছে। তারও আগে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে প্রাচীন গ্রিসে স্পার্টার অধিবাসীরা তাদের সৈন্যদলের কাছে যে পদ্ধতিতে বার্তা পাঠাত তার নাম ছিল Scytale। একটা ফিতে একটা কাঠের বেটনের পাশে জড়ানো হল, এবার ওই জড়ানো ফিতের উপর পাশাপাশি লিখে গেলাম। ফিতেটা খুলে নিলে অক্ষরগুলো আর পাশাপাশি থাকবে না, তখন বার্তাটা পড়া শক্ত। বার্তাপ্রাপকের কাছে একটা একই মাপের বেটন থাকবে, সে আবার ফিতেটা জড়িয়ে নিলো। নিচের ছবিটা থেকে বিষয়টা পরিষ্কার হবে।




এই কোড ভাঙা একেবারেই সহজ, কারণ ফিতের উপর অক্ষরগুলো পরপর না হলেও নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর থাকবে। সেইটা আন্দাজ করতে পারলেই বার্তা উদ্ধার করতে সময় লাগবে না। নিচে দেয়া বর্ণগুলো বিশ্লেষণ করে সহজেই দেখা যাবে নিচের সংকেত বাক্যটার মাধ্যমে কী বোঝানো হল। (`-' চিহ্ন দিয়ে শূন্যস্থান বোঝানো হয়েছে।)

নিসক্যমাকীনোচেঙ্কেটাধ্য--রতরমেবোহ-বা--ঝাল

স্পার্টানদের শত্রুরা অবশ্য অত চিন্তা করত না, ফিতেটা হাতে পেলে বিভিন্ন সাইজের বেটন নিয়ে দেখত কোনটা দিয়ে বার্তাটা পড়া যাচ্ছে।

ইতিহাসে এর পরে যে সংকেতের কথা বিখ্যাত হয়ে আছে, শোনা যায় সেটার আবিষ্কারক হলেন জুলিয়াস সিজার। এটা আরও সোজা, বর্ণমালার অক্ষরগুলোকে তিন ঘর সরিয়ে লিখতে হত, অর্থাৎ A-র জায়গায় D, B-এর জায়গায় E, এই রকম। জুলিয়াসের পরে যিনি রোমের শাসনভার নিয়েছিলেন, সেই অগাস্টাস সংকেতটাকে আরও সোজা করেছিলেন, মাত্র এক ঘর সরিয়ে লিখতে হত। এগুলোর পাঠোদ্ধারও খুবই সহজ।  

উপরের গ্রিক ও রোমান উদাহরণগুলোর মধ্যে একটা মিল আছে। স্পার্টানদের সংকেতে অক্ষরগুলো নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর থাকে, সিজারের কোডে বর্ণগুলোকে বর্ণমালার মধ্যে নির্দিষ্ট দূরত্ব সরানো হয়। সিজারের কোডকে আরও শক্ত করা যায়, যদি কোন বর্ণের জায়গায় কোন বর্ণ লিখেছি তা উলটে-পালটে বসানো হয়। যেমন ধরুন A-র জায়গায় D, কিন্তু B-এর জায়গায় X, আবার C–এর জায়গায় P, এইরকম। সিজারের কোড বা এই ধরনের সংকেত, যেখানে এক বর্ণের জায়গায় আর এক বর্ণ বসানো হয়, তাকে বলে প্রতিস্থাপন সংকেত। প্রাপকের কাছে চাবিকাঠিটা থাকবে, সে তার সাহায্যে সহজেই আসল বার্তাটা উদ্ধার করতে নিতে পারবে।

চাবিকাঠি না থাকলেও এই সংকেতের মর্ম উদ্ধার করা সম্ভব, সেই কথা  আছে এডগার অ্যালান পো-এর ছোট গল্প দি গোল্ড বাগ-এ। প্রথমে কোনও অক্ষর বা অক্ষর সমষ্টি কতবার আসছে দেখতে হবে। যেমন ইংরাজিতে সবথেকে বেশি ব্যবহৃত অক্ষর হল E, তারপরেই A। কাজেই বার্তাটির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে এই দুটি অক্ষরের জন্য কোন চিহ্ন ব্যবহার হয়েছে তা সহজেই বোঝা সম্ভব। এবার যদি দেখা যায় যে তিনটি বর্ণের সমষ্টি বারবার আসছে, এবং তার শেষটা হল E, তাহলে অনুমান করা যায় ওই শব্দটি হল THE; অর্থাৎ T ও H বর্ণগুলিকেও উদ্ধার করা গেল। অবশ্য এভাবে এগোনোর জন্য বার্তাটি যথেষ্ট বড় হতে হবে, যাতে পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ কাজ করে। খুব ছোট বার্তার জন্য অক্ষরের পরিসংখ্যান না মিলতেই পারে। সংকেত উদ্ধারের এই পদ্ধতি উদ্ভাবন হয়েছিল অষ্টম শতাব্দীতে, আরব গণিতবিদ আল-কিন্দি এর স্রষ্টা। মনে রাখতে হবে পরিসংখ্যানবিদ্যার জন্ম কিন্তু তার অনেক পরে।

আমাদের বাংলা বর্ণমালার ক্ষেত্রেও এইরকম প্রতিস্থাপন কোড তৈরি করা যায়, তবে আ-কার ই-কার যুক্তাক্ষর ইত্যাদি থাকার জন্য সেটা এই সমস্ত কোডের থেকে আরও দীর্ঘ হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অবশ্যই উপরের সমস্ত উদাহরণের থেকে অনেক বেশি জটিল কোড ব্যবহার করা হত। তারও উপরে মার্কিন সৈন্যবাহিনীর রেড ইন্ডিয়ান সদস্যরা বার্তাকে সংকেতবদ্ধ করার সময় তাদের নিজেদের ভাষা ব্যবহার করত। সেই ভাষা জানা না থাকলে কোড ভাঙা দুঃসাধ্য, কারণ ইংরাজি ভাষার অক্ষরের পরিসংখ্যান অন্য ভাষার সঙ্গে মিলবে না। নাজেভো ইন্ডিয়ানদের তৈরি করা কোড জাপানিরা কখনোই ভাঙতে পারেনি, ফলে মার্কিন সৈন্যবাহিনীর সংকেত উদ্ধার করা তাদের পক্ষে হয় নি।

আধুনিক যুগের জটিল সংকেতের কথাও আমাদের গল্পে আসবে, তার আগে এই লেখা যেখানে শুরু করেছিলাম সেখানে ফিরে যাই। আজকের দিনে কোনও বিজ্ঞানী নতুন কিছু আবিষ্কার করলে তা গবেষণা পত্রিকা বা জার্নালে ছাপান, কেউ কেউ হয়তো খবরের কাগজ টেলিভিশন বা ইনটারনেটের মাধ্যমেও সেটা প্রকাশ করেন। মধ্যযুগে এরকম কোনও সুযোগ ছিল না, বই ছাপাতে হত, কিন্তু তা ছিল অত্যন্ত খরচসাপেক্ষ। অন্য বিজ্ঞানীদের চিঠি লিখে জানানো যেত, অনেকেই সেই পথ নিতেন।

অনেক সময় কিন্তু বিভিন্ন কারণে বিজ্ঞানী হয়তো তখনি তাঁর আবিষ্কারের কথা প্রচার করতে চাইতেন না, তিনি তার আগে নিশ্চিত হতে চাইতেন বা সে বিষয়টাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইতেন। কিন্তু ইতিমধ্যে যদি অন্য কেউ সেই আবিষ্কার করে ফেলে! সেজন্য চিঠিতে আবিষ্কারের কথা সংকেতের মাধ্যমে পাঠাতেন, পরে ঘোষণা করার সময় সেই সংকেতটা সবাইকে বুঝিয়ে দিতেন। মাঝে অন্য কেউ আবিষ্কারের ঘোষণা করলে বিজ্ঞানী তখনই সংকেতটা ভেঙে দেখাবেন যে তিনি আগেই কাজটা করেছেন।

সপ্তদশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানীদের মধ্যে যে পদ্ধতি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল তা হল অক্ষরগুলোকে উলটে-পালটে লেখা, অর্থাৎ অ্যানাগ্রাম। উদাহরণ স্বরূপ আমরা হুকের সূত্রের কথা জানি, তাতে বলা হয় স্থিতিস্থাপকতার ক্ষেত্রে বল বা পীড়ন (লাতিনে vis) বিকৃতি (লাতিনে tensio)-র সমানানুপাতী। রবার্ট হুক লাতিন ভাষায় এই সূত্রকে লিখলেন, Ut tensio sic vis, তারপর বাক্যটাকে বর্ণানুক্রমিক ভাবে সাজালেন, হল ceiiinosssttuv। এটা তিনি পরিচিতদের সবাইকে পাঠালেন। কয়েক বছর পরে তার মানে সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন, ইতিমধ্যে আরও পরীক্ষানিরীক্ষা করে তিনি তাঁর সূত্র সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছিলেন। 

আধুনিক বিজ্ঞানের স্রষ্টা বললে অনেকের মনেই গ্যালিলিও গ্যালিলির কথা আসে। গ্যালিলিও ১৬০৯ সালে দূরবীন দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন বৃহস্পতির চারটি চাঁদ আছে, তার থেকে তিনি সৌরজগতের কেন্দ্রে আছে সূর্য এবং পৃথিবী তার চারদিকে ঘোরে সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছিলেন। এই নিয়ে রোমান ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে তাঁর বিরোধের ইতিহাস সকলেরই জানা, আমরা সেই প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। তিনি দূরবীন দিয়ে আকাশে আরও অনেক কিছু পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, কিন্তু একটা বিষয় তিনি ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেননি। সেই জন্য সেই সময় তিনি তা প্রকাশ করেন নি। কিন্তু তাঁর অনুসরণে অনেকেই তখন দূরবীন দিয়ে আকাশ দেখছেন, অন্য কেউ তাঁর আগে বিষয়টা দেখেছেন বলে ঘোষণা করে দিতে পারেন। সুতরাং তিনি যা দেখছিলেন, তাকে লাতিন ভাষায় লিখলেন এবং অ্যানাগ্রাম আকারে অনেকের কাছে চিঠিতে লিখে পাঠালেন। সেটা ছিল ১৬১০ সাল। সেই অ্যানাগ্রামই হল SMAISMRMILMEPOETALEUMIBUNENUGTTAUIRA যা দিয়ে এই লেখা শুরু হয়েছে।

প্রাপকদের মধ্যে ছিলেন সেযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ জোহানেস কেপলার। কেপলার ঠিক করলেন যে তিনি গ্যালিলিও কী লিখেছেন তা বার করবেন। ওই বর্ণ সমষ্টি থেকে অনেক রকম বাক্যই গঠন করা যায়। নানা রকম ভাবে সাজিয়ে কেপলার যে বাক্যটা ঠিক বলে সিদ্ধান্ত করলেন, তা হল Salve, umbistineum geminatum Martia proles। লাতিন গ্রামার খুব মেনে চলেনি কথাটা। সে যা হোক, বাংলায় এর মানে দাঁড়ায় মঙ্গল গ্রহের দুই সন্তানকে স্বাগত। কেপলারের মনে হল গ্যালিলিও মঙ্গল গ্রহের দুটি উপগ্রহ আবিষ্কার করেছেন।

মঙ্গলের সত্যিই দুটি উপগ্রহ, ডিমোস আর ফোবোস। তাহলে কি গ্যালিলিও সেগুলো দেখতে পেয়েছিলেন? উত্তর হল না; সে চাঁদ দুটো এতই ছোট যে গ্যালিলিওর দূরবীনে তাদের দেখতে পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ১৮৭৭ সালে তাদের প্রথম সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। গ্যালিলিও আসলে লিখেছিলেন, altissimum planetam tergeminum observavi, এর মানে হল দূরতম গ্রহ (অর্থাৎ শনি) তিনভাগে বিভক্ত। গ্যালিলিও শনির বলয় দেখতে পেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর দূরবীনের শক্তি কম থাকার ফলে কী দেখছেন বুঝতে পারেন নি, তাঁর মনে হয়েছিল শনির দুপাশে ঢিপির মতো কিছু বেরিয়ে আছে। গ্যালিলিও কোনওদিনই শনির বলয়ের কথা জানতে পারেন নি।

কেপলার যে ঐ অ্যানাগ্রাম থেকে মঙ্গলের দুটি চাঁদের কথা ভেবেছিলেন তার কারণ আছে। বৃহস্পতির চাঁদের সংখ্যা চারের অনেক বেশি, কিন্তু সে সময় তা জানা ছিল না। আজ যাকে আমরা প্যাটার্ন রিকগনিশন বলি, কেপলারের সেই ক্ষমতা ছিল অসাধারণ, সে কারণেই তিনি তাঁর গ্রহদের গতিবিধি সংক্রান্ত সূত্র আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। কিন্তু অনেক সময়েই প্যাটার্ন না থাকলেও আমাদের মন সেখানে প্যাটার্ন তৈরি করে নেয়। বুধ বা শুক্রের উপগ্রহ নেই, পৃথিবীর একটা, বৃহস্পতির চারটে, অতএব কেপলারের মনে হল মঙ্গলের দুটো উপগ্রহ থাকবে।

কেপলারের কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের মিলটা নেহাতই সমাপতন, উপগ্রহের সংখ্যা গুণোত্তর প্রগতিতে বাড়ার কোনও কারণ নেই। কেপলারের সমর্থনে বলা যায় যে তখন জ্যোতির্বিদ্যার শৈশব, তাই কোনটা ঠিক কোনটা ভুল বোঝা সহজ ছিল না। জোনাথন সুইফটের গল্পে লাপুটাদের দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গালিভারকে মঙ্গলের দুটি চাঁদের কথাই বলেছিল। সেই গল্প লেখা হয়েছিল ১৭২৬ সালে, আর আমরা আগেই দেখেছি তার দেড়শো বছর পরে চাঁদ দুটি আবিষ্কার হয়েছিল। এক সময় এমন কথাও উঠেছিল যে সুইফটের সঙ্গে মঙ্গলগ্রহের অধিবাসীদের যোগাযোগ ছিল, না হলে তিনি সেই দুই চাঁদের খবর পেলেন কেমন করে। আসল কারণ হল গ্যালিলিওর সেই অ্যানাগ্রাম এবং কেপলারের কল্পনা -- সুইফট কেপলারের লেখার খবর জানতেন।

দেখা যাচ্ছে সংকেত শুধুমাত্র লেখাই যথেষ্ট নয়, তাকে উদ্ধার করার জন্য চাবিকাঠিটাও জরুরি। অথচ সেই চাবিকাঠি অনাকাঙ্ক্ষিত হাতে চলে গেলে বিপদ আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সরকার মেক্সিকোর জার্মান রাষ্ট্রদূতকে সাংকেতিক টেলিগ্রাম করে মেক্সিকোকে তাদের পক্ষে যুদ্ধে যোগদানের জন্য অনু্রোধ জানাতে বলেছিল। ব্রিটিশ পক্ষ সেই বার্তা উদ্ধার করতে সক্ষম হয় এবং মেক্সিকোর ঠিক উত্তরের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দেয়। মার্কিন পক্ষ তার অল্পদিন পরেই জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান করে, তার পিছনে এই বার্তাটির বিশেষ ভূমিকা ছিল। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের জয়ের পিছনেও এই কোড ভাঙার এক ভূমিকা আছে। যদি প্রতিস্থাপন কোডটা বার্তার মধ্যে পালটাতে থাকে, অর্থাৎ প্রথম কিছুটাতে A-র জায়গায় লিখলাম B, তারপর কিছুক্ষণ লিখলাম G, তাহলে পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ কাজ করবে না। জার্মানরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করত, তারা এ জন্য যে মেশিন ব্যবহার করত তার নাম ছিল এনিগ্মা (Enigma) অর্থাৎ হেঁয়ালি। সেই যন্ত্র নিয়ে আলোচনার সুযোগ এই লেখাতে নেই, কিন্তু মিত্রপক্ষ এনিগ্মার কোড ভাঙতে সক্ষম হয়েছিল। ঐতিহাসিকরা অনেকেই মনে করেন যে মিত্রপক্ষের জয় তার ফলে ত্বরান্বিত হয়েছিল। কম্পিউটার বিজ্ঞানের জনক মনে করা হয় অ্যালান টুরিঙকে, তিনি এই কোড ভাঙাতে এক বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন।

তাহলে কি যে কোনও কোডই ভাঙা সম্ভব? ইনটারনেটের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন কি তাহলে নিরাপদ নয়? বার্তাপ্রেরক ও প্রাপকের মাঝখানে কেউ যাতে আড়ি পেতে তথ্য চুরি করতে না পারে তার জন্য ইনটারনেটে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আপনি যখন কোনও ওয়েবসাইটে ঢোকেন, একটু খেয়াল করলে দেখবেন অধিকাংশ সময় সাইটের নামের বাঁদিকে একটা তালার চিহ্ন আছে, ওই চিহ্ন থাকা মানে ওয়েবসাইটটি নিরাপদ। (নিচের ছবিটা দেখুন, তালার চিহ্নকে গোল করে দেখানো আছে।) ওয়েবসাইটে ওই চিহ্নের উপরে ক্লিক করলে দেখতে পাবেন আপনার পাঠানো ক্রেডিট কার্ডের নাম্বার, পাসওয়ার্ড ইত্যাদি তথ্য মাঝে অন্য কেউ জেনে নিতে পারবে না।



এই নিরাপত্তার জন্য একটি খুব পরিচিত পদ্ধতির কথা বলি। এই উদ্ভাবন করেছিলেন রোনাল্ড রিভেস্ট, আদি শামির ও লিওনার্ড অ্যাডলম্যান নামের তিন বিজ্ঞানী, তাঁদের পদবী অনুসারে একে বলে আরএসএ(RSA) অ্যালগরিদম্। গণিতের এমন এক শাখা এখানে ব্যবহার করা হয় কয়েক দশক আগেও যার কোনও ব্যবহারিক প্রয়োগের কথা কেউ কল্পনা করতে পারতেন না। আমরা জানি যে পূর্ণ সংখ্যাকে ১ ও সেই সংখ্যা ছাড়া অপর যে কোনও পূর্ণসংখ্যা দিয়ে ভাগ দিলে ভাগশেষ থাকে তাকে বলে মৌলিক সংখ্যা। যেমন ২, ৩, ৫, ৭, ১১, ১৩ এরা সবাই মৌলিক সংখ্যা। কেমনভাবে আরএসএ অ্যালগরিদম্ কাজ করে তা সহজে লিখতে গেলেও আরও একটা প্রবন্ধ লাগবে, কিন্তু মূল কথাটা হল এখানে দুটি বড় মৌলিক সংখ্যার গুণফলকে ব্যবহার করা হয়। ধরা যাক গুণটা করতে আমার ডেস্কটপ কম্পিউটারের লাগে এক সেকেন্ড, কিন্তু একটা সংখ্যাও জানা না থাকলে আমাদের আধুনিকতম কম্পিউটার লক্ষ লক্ষ কোটি বছরেও ওই বড় গুণফলটাকে উৎপাদকে বিশ্লেষণ করতে পারবে না। বার্তাকে সংকেতবদ্ধ করতে ওই মৌলিক উৎপাদক দুটিকে ব্যবহার করা হয়, ইনটারনেটের মাধ্যমে যায় ওই গুণফলটি। কেউ যদি গুণফল জানতেও পারে, তার পক্ষে উৎপাদক দুটি নির্ণয় করা কার্যত অসম্ভব। মনে পড়ে এই পদ্ধতির কথা প্রথম পড়েছিলাম আর্থার সি ক্লার্কের লেখা টু থাউজ্যান্ড টেনঃ ওডিসি টু বইতে।

ইনটারনেটের মাধ্যমে তথ্য তাহলে সম্পূর্ণ নিরাপদ? এখনও পর্যন্ত এই প্রশ্নের উত্তর হল হ্যাঁ; সাধারণ কম্পিউটার কোনওদিনই ওই সংকেত ভাঙতে পারবে না। কিন্তু সংবাদে মাঝে মাঝে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কথা শোনা যায়। কোয়ান্টাম কম্পিউটার সৃষ্টি এখনও পর্যন্ত খুব বেশি এগোয়নি, কিন্তু তত্ত্ব বলছে যে ঐ ধরনের বড় সংখ্যাকে উৎপাদকে বিশ্লেষণ করতে তার সময় লাগবে কয়েক সেকেন্ড বা তারও কম। একবার কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি হলে তথ্যগুপ্তির নতুন কায়দা ভাবতে হবে। সে বিষয়েও কাজ শুরু হয়েছে; কোয়ান্টাম জগতের বিচিত্র ধর্মকেই কাজে লাগিয়ে এমন পদ্ধতির প্রস্তাব করা হয়েছে যেখানে জানা যাবে মাঝপথে কেউ আড়ি পাতছে কিনা। তথ্যগুপ্তিবিদ্যাতে কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রয়োগ আমাদের আলোচনার পরিধির বাইরে, কিন্তু স্পার্টানদের কাঠের বেটনের যুগ থেকে আমরা অনেকটা এগিয়েছি সন্দেহ নেই।


………………..

 

2 comments:

  1. Very very interesting. Like to watch more on this. Digital currency too.

    ReplyDelete
  2. Very very interesting. Like to watch more on this. Digital currency too.

    ReplyDelete