ধর্ষকের চরিত্র বদলায় না
রিনি গঙ্গোপাধ্যায়
চর্যাপদের কবি বহুকাল আগে বলেছিলেন, “আপনা মাংসে হরিণা বৈরী।” আর এ যুগে কবিকে লিখতে হয়, “তুমি তো নারী নও, তুমি শুধু মাংসল দেহ।” তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের বাসিন্দা হয়ে আজও এমন সব পংক্তি শ্মরণে থেকে যায়, থেকে যায় কারণ আমি নারী। আমি কেবলই নারী। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, লেখক, বিপ্লবী, কর্মী-ঘরোয়া, পুলিশ, ডাক্তার, ম্যাডিস্ট, স্যাটায়ারিস্ট, অধ্যাপক, পরিচারিকা-কিছুই নই। মানুষ তো নই-ই; আমি শুধুই নারী। দেশ-কাল নির্বিশেষে আমি শুধুই নারী, শুধুই ভোগ্য, তাই আমি পণ্য; শরীর দিয়ে পুরুষকে তৃপ্ত করাই আমার কাজ; আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ও পরিণতি। সে কাজে যদি আমি অস্বীকৃত হই, তবে আমি পাপী। তাই জোর করো, শক্তি লাগাও, ছিন্নভিন্ন করে দাও শরীর, ক্ষতবিক্ষত করে দাও সমস্ত সত্তা-যদি আদৌ কোনও পৃথক সত্তার অস্তিত্ব থেকে থাকে আমার! কারণ আমি তো শুধুই নারী! এভাবেই নারী চিরকাল ধর্ষিত হয়! রাতের অন্ধকারে, পথে-ঘাটে, অফিসে-বাড়িতে, অপরিচিত-পরিচিত, বন্ধু- আত্মীয়, এমনকি নিজের জন্মদাতার কাছ থেকেও রেহাই নেই নারীর।
মানুষ নামের জীবটি যখন পৃথিবীর মাটিতে বিকশিত হয়, তখন পুরুষ-নারীর পৃথকীকরণ ছিল কি না, তা তর্কের বিষয়! গোষ্ঠীবদ্ধতার যুগেও তো শোনা যায় নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলার কাজে লেগেছিল। তবে পুরুষের লোভে যখন জমি দখলের লড়াই শুরু হল, তখন থেকেই নারীকে অন্য গোত্র বলে দূরে ঠেলে দেওয়া হল। যুক্তি নানারকম- নারীর শরীরী গঠন পৃথক, নারী দূর্বল, নারী জননী। পুরুষ, তুমি যে নারীর থেকে শরীরী গঠনে পৃথক সে কথা কিন্তু তুমি আজও বোঝোনি। যাই হোক, তখন থেকেই নারী সম্পত্তি, নিজস্ব অধিকারের বস্তু; তাই মাথায় রক্ত-চিহ্ন এঁকে, হাতে-পায়ে লোহার শিকল পড়িয়ে তাকে বন্দি করে রাখা শুরু। নারী সে অবস্থার প্রতিবাদ করেছিল কি না ইতিহাস তা জানায় না৷ তবে মঙ্গলময় ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে, ধর্মের পতাকা উড়িয়ে দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে পুরুষ-নারীর মনে এ অত্যাচারকে সংস্কারের মতো গেঁথে দিতে পেরেছে৷ শিক্ষার সুযোগহীন, ঘরবন্দি, অবিকশিত নারী সেই সংস্কারকে, বলা ভালো কুসংস্কারকে ছড়িয়ে দিয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। প্রতিবাদের ভাষাটুকুও খুঁজে পায়নি।
মনে পড়ছে অহল্যার কথা। স্বামী গৌতমের ছদ্মবেশ ধারণ করে যাকে ভোগ করেছিলেন স্বয়ং ইন্দ্রদেব। সত্য প্রকাশিত হলে গৌতম শাস্তিস্বরূপ অহল্যাকে পাথরে পরিণত করলেন। তারপর অবতার রামচন্দ্রের পাদস্পর্শে তার শাপমুক্তি ঘটল। রবীন্দ্রনাথ ‘অহল্যার প্রতি’ কবিতায় এই ঘটনাকে ভিন্ন তাৎপর্যে, কৃষি সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে জড়িত করে যতই মহিমান্বিত করুন না কেন, তাতে কী প্রতারণা ও ধর্ষণকে মুছে ফেলা যায়! অন্যায় না করেও অন্যের অন্যায়ের শাস্তি পেতে হয়েছে অহল্যাকে৷ অপমানিতকে আরও বেশি অপমান করে তার অস্তিত্বকেই নিশ্চল পাথর বানিয়ে ফেলা হয়েছে। অহল্যা মাথা পেতে নিয়েছে সে শাস্তি৷ কারণ সে তো ধর্ষিত, নষ্ট, অসতী। তাই শাস্তিটা তারই প্রাপ্য। অন্যদিকে রামচন্দ্র যে নাকি রাজ্যলোভে কলঙ্কের বোঝা চাপিয়ে নিজের স্ত্রীকেই সন্তানসম্ভবা অবস্থায় পরিত্যাগ করলেন, তিনিই উদ্ধার করলেন অহল্যাকে! মহানুভবতা! নাকি ভোগ্যবস্তুকে পাথর বানিয়ে রেখে দিলে পুরুষেরই যে বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা, সে কথা শ্মরণ করিয়ে দিলেন গৌতমকে! আজ এই একুশ শতকেও মহিলা পুলিশ অফিসার ধর্ষিত মেয়েটিকে ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে নিতে বলে। নইলে বদনাম হবে, কলঙ্ক রটবে; তাই মুখ ঢেকে, নাম লুকিয়ে অস্তিত্বকেই মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়।
এই অবস্থা চলেছিল দীর্ঘ দীর্ঘ যুগ। ধর্ষক পুরুষ শাস্তি পেল বা না পেল, ধর্ষিত নারী সমাজ সংসারে ব্রাত্য হয়ে গেল। স্বাভাবিক পরিবেশ তো তার জন্য নয়ই, একটা গোটা জীবন অন্ধকার ঘরে সে শুধু মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করবে। ১৯৩০ সালে ধর্ষণকে যৌন অপরাধরূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৩৫-৬৫ পর্যন্ত ধর্ষকদের মানসিকভাবে অসুস্থ মনে করা হত এবং তাদের শাস্তি দেওয়ার বদলে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হত। ১৯৭০-এ দ্বিতীয় স্তরের নারীবাদীরা প্রথম 'Rape Culture' শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন এবং তৎকালীন আমেরিকার একটি পরিচিত অথচ অবহেলিত ও উপেক্ষিত সত্য বলে দাবি করেন। আইন প্রণয়নের পরেও দেখা যায় ধর্ষক ৭ বছর কারাদণ্ডের পর সসম্মানে মুক্তি পায় এবং বুক ফুলিয়ে জীবন কাটায়৷ এখন বোধহয় শাস্তির মেয়াদ কিছু বেড়েছে৷ ধন্য বিচারব্যবস্থা!
ধর্ষিত হতে হতে নারী একসময় নিজেও নিজেকে ধর্ষণের উপাদান ভাবতে শুরু করেছে। হারমেইন গ্রিয়ার-এর মতে, “Historically, the crime of rape is not an offence against women, but an offence committed against men by other men.” দেশত্যাগের প্রেক্ষিতে মান্টোর একটি গল্প মনে পড়ছে- ‘খোল দো’, বাংলা অনুবাদ ‘খুলে দাও’ বা ‘প্রত্যাবর্তন’। দাঙ্গার সময় অমৃতসর থেকে লাহোরগামী ট্রেনে হাতছুট হয়ে যায় সিরাজউদ্দিনের সদ্য মাতৃহারা মেয়ে সাকিনা। যার মা মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রক্ষা করতে চেয়েছিল মেয়েকে। মেয়েটিও মৃত্যুভয় পেরিয়ে ওড়না দিয়ে নিজেকে আবৃত রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওড়নাটা দলা পাকানো রয়ে গেছে বাবার পকেটে৷ অনেকটা সাকিনার দলা পাকানো সম্মানের মতই৷ জ্ঞান ফিরতেই সিরাজউদ্দিন খুঁজতে শুরু করে মেয়েকে। কিন্তু “চারিদিকে একটা তুমুল বিশৃঙ্খলা। কেউ নিজের বাচ্চাকে খুঁজছে, কেউ মাকে, কেউ বউ অথবা মেয়েকে খুঁজে বেড়াচ্ছে” -কী অদ্ভুত! দাঙ্গায় কেবল নারী ও শিশুই দলছুট হয়; আর এই দলছুটরা পরিবারের খোঁজ করার মতো পরিস্থিতিতে আর থাকে না৷ কারণ তারা ততক্ষণে ধর্ষিত হয়ে গেছে৷ সাকিনা যে ধর্ষিত হবে সচেতন পাঠক তা জানে৷ কিন্তু যারা তাকে ধর্ষণ করল তাদের পরিচয় পেয়ে পাঠক চমকায়৷
কয়েকদিন ধরে সাকিনাকে খুঁজে না পাওয়া গেলে সিরাজউদ্দিন কয়েকজন রাজাকারদের কাছে পৌঁছায়; যারা ওপার থেকে নারী ও শিশুদের এপারে নিয়ে আসছিল। তাদের কাছে বন্দুক আর লরি আছে৷ সিরাজ তাদের কাছে মেয়ের বর্ণনা দেয় - সাকিনা তার আদরের একমাত্র কন্যা, ফর্সা, সুন্দর, বাবার মতো নয়; মেয়ে তার মায়ের মতোই সুন্দর; বড়ো বড়ো চোখ, কালো চুল,বাঁ গালে তিল....বর্ণনার মধ্য দিয়ে মেয়ের প্রতি বাবার স্নেহ, তার জন্য উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা ফুটে উঠছিল৷ রাজাকাররা অমৃতসর যাওয়ার পথে সাকিনার খোঁজ পায়৷ তাদের বর্ণনায়- “মেয়েটি খুব সুন্দরী ছিল, তার বাঁ গালে একটা তিলও ছিল।... দোপাট্টা না থাকায় সাকিনার অসুবিধা হচ্ছিল, বারবার সে হাত দুটিকে বুকের কাছে জড়ো করে রাখছিল।” প্রথমে রাজাকার ছেলেগুলো তার বিশ্বস্ততা অর্জন করে, তার বাবার নাম বলে, তাকে খাতির করে, খেতে দেয়, লরিতে বসতে দেয়। এমনকি ওড়না না থাকায় জ্যাকেট খুলে তাকে পরতে দেয়৷ অনেকটা ছদ্মবেশী ইন্দ্রের মতোই, অহল্যার স্বামী তথা তার রক্ষকের ভূমিকাই তো নিয়েছিল ইন্দ্র। তারপর তাকে ধর্ষণ করে। Andriea Rita Dworlin - এর মতে, “Man use women's bodies in prostitution and in gang rape to communicate with each other, to express what they have in common. And what they have in common is that they are not here.” রাজাকাররা সাকিনার সঙ্গে কী করেছিল তার কোনও বর্ণনা নেই গল্পে। কয়েকদিন পর সিরাজউদ্দিন দেখে একটি অল্পবয়সী মেয়ের দেহ রাজাকার ছেলেগুলি রেললাইনের ধার থেকে বয়ে নিয়ে হাসপাতালে রেখে এল। সিরাজউদ্দিন ওদের অনুসরণ করে; হাসপাতালের ঘরে ডাক্তার আলো জ্বালতেই আবিষ্কার করে লাশের মতো শুয়ে থাকা বাঁ গালে তিল, সাকিনাকে৷ হাসপাতালের অন্ধকার অপ্রশস্ত ঘরে আরও আলোর প্রয়োজন বলে ডাক্তার রুগির নাড়ি ধরেই অন্যমনস্ক ভাবে জানালার দিকে ইঙ্গিত করে সিরাজকে বলে, “খুলে দাও”। অর্ধমৃত মেয়েটি এবার নড়ে ওঠে, দুর্বল হাতে খুলতে থাকে তার সালোয়ারের দড়ি। মেয়ের দেহে প্রাণের ইশারা পেয়ে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে সিরাজউদ্দিন। আর ডাক্তার ঠান্ডা ঘামে ভিজে যেতে থাকে৷ মেয়েটির ওপর ঘটে যাওয়া পাশবিক অত্যাচারের ভয়ংকরতা ডাক্তারকে ভীত করে তোলে। এমন ভাবেই কি ঠান্ডা ঘামে ভিজে গিয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত!! পুরাণে বৃহস্পতি-পত্নী তারার কথা পড়তে পড়তে! যাকে তিনদিন ধরে লাগাতার ধর্ষণ করেছিল সোমদেব; তারপর অবৈধ সন্তানের ভাবী জননীরূপে ফিরিয়ে দিয়েছিল। পুরুষসত্তার এমন বীভৎস বিকৃতি বোধহয় মধুসূদনও সহ্য করতে পারেননি। তাই পুরাণের নবনির্মান করে তারাকেই করে তুললেন বিশ্বাসঘাতিনী; সোমের অবৈধ প্রণয়ী।
এই পর্যন্ত নারীকে কেবল সহ্য করতেই দেখেছি৷ আত্মহত্যা করে এই নিষ্ঠুর অবমাননা থেকে পালাতে দেখেছি৷ সেই পলায়নের প্রতিবাদ নেই৷ এমনকি সাকিনার সালোয়ারের দড়ি খোলার মধ্যেও যে ব্যঞ্জিত প্রতিবাদটুকু আছে তা সোচ্চার নয়, সে প্রতিবাদ বড় ক্ষীণ, বড় দুর্বল। Swan Brownmiller তাঁর Against Ours Will : Men, Women and Rape বইতে এ সম্পর্কে লিখেছেন- নারী কখনোই ধর্ষণ বিষয়ে প্রতিবাদী হয় না, “because women would never want to be open about a 'crime against their physical integrity' which explained the general public ignorance over how often rape was occuring and to when.” Swan T.Bell, J. Kurlioff Peter এবং Iisa Lottes একটি প্রবন্ধে জানান, ধর্ষিত মেয়েরাও নিজেদের ‘Slutty’, ‘used or damaged goods’ মনে করে। তারা মনে করে তারা আর ‘pure and virginal’ নয়, যা সাধারণ পুরুষেরা চেয়ে থাকে। এই লজ্জা থেকেও তারা অনেকসময় প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারে না৷ Dianne. F. Herman তাঁর ‘Rape Culture’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ধর্ষণ সম্পর্কিত প্রাচীন মিথগুলিতে দেখানো হয়েছে শুধুমাত্র ‘Bad or misbehaved’ মেয়েরাই ধর্ষিত হয়৷ এর ফলে সাধারণ মেয়েদের থেকে ধর্ষিতদের থেকে পৃথক করতে সুবিধা হয়। এখনও ধর্ষণের কোনও ঘটনা ঘটলেই বুদ্ধিজীবীদের একাংশ মেয়েদের পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলে ধরেন। কামদুনির কলেজ পড়ুয়া, মধ্যমগ্রামের স্কুল পড়ুয়া নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরা কোনও বিশেষ পোশাক ও আচরণের কারণে ধর্ষিত হয়, যথেষ্ট সভ্য পোশাক না থাকা সত্বেও রাস্তাঘাটে পুরুষরাই বা কেন গণধর্ষণের শিকার হয় না? এসব প্রশ্নের কোনও সদুত্তর নেই আমাদের সমাজে৷ সমাজ শুধু নারীকে সহ্য করতে শিখিয়েছে। প্রতিবাদ করতে চাইলেও তার কণ্ঠরোধ করা হয়েছে৷ কারণ সে নারী৷ সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ‘দহন’ উপন্যাসে টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের কাছে রমিতার প্রতি কিছু যুবকের অশালীন আচরণের প্রতিবাদ করায় ঝিনুককে বারবার শুনতে হয়, ‘আফটার অল তুমি মেয়ে’ কিংবা ‘লেখাপড়া শেখানো হয়েছে, চাকরি করতে দেওয়া হচ্ছে, তাতেই কি তুমি পুরুষমানুষের সমান হয়ে গেলে নাকি?’ অর্থাৎ প্রতিবাদের অধিকারও একমাত্র পুরুষেরই। সহনশীলতাই তো নারীর ধর্ম। তাই সমীক্ষায় পাওয়া যায় গত শতাব্দী জুড়ে অধিকাংশ ধর্ষণ বা ধর্ষণের প্রচেষ্টা বিচারের আওতায় আনাই হয়নি।
এইরকম পরিস্থিতিতে খুব মেয়েরা খুব গোপনে, নিজস্ব পরিসরে নিজেদের মতো করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে৷ বাণী বসুর ‘কাঁটাচুয়া’ গল্পটি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। গল্পটিতে দেখা যায় শহরে সজারুর মতো এক অদ্ভুত পশুর আবির্ভাব ঘটেছে; যাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ কলকাতা শহর জুড়ে, এমনকি গ্রামে গঞ্জেও তার আক্রমণে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ৷ সঠিক ভাবে বলতে গেলে পুরুষরাই তার আক্রমণের লক্ষ্য। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে ফ্রি- ল্যান্স জার্নালিস্ট নন্দনা৷ সে একে একে ইনটারভিউ করে নয়নপুর গ্রামের কাসি মাঝির বউ রানীকে, শহরতলির দশম শ্রেণির ছাত্রী রুণাকে-এরা কাঁটাচুয়ার আক্রমণের প্রত্যক্ষদর্শী। তবে বিশেষ কিছুই এদের থেকে জানা যায় না। কারণ যখন প্রাণিটি এদের সামনে থাকা যথাক্রমে বন্ধু গগন পাড়ুই ও বিজ্ঞানের মাস্টার শশাঙ্ক পুরকায়স্থকে আক্রমণ করেছিল তখন এরা নিজেরাও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। একটা বিশ্রী বুনো গন্ধ তারা পেয়েছিল; আর অবিশ্রান্ত মাথা ঘুরছিল, গা বমি বমি করছিল, চোখের সামনে যেন একটা ধূসর কুয়াশার পর্দা দুলছিল; সেভাবে তারা কিছুই দেখতে পায়নি৷ ঘোরটা কেটে যেতে ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা চোখে চোখে পড়েছিল। শজারুর মতো ‘কাঁটাওলা’ জন্তুটাকে কেউ চোখেই দেখেনি, তার অস্তিত্ব নিয়েও নানা সংশয়। অথচ তার আক্রমণে মৃত্যু ঘটছে-এমন ভাবতে ভাবতেই নিজের বাড়িতে পৌঁছে নন্দনা দেখে তার বাবা বিশিষ্ট ডাক্তার জওহর দাশও কাঁটাচুয়ার আক্রমণে আক্রান্ত। বাঁচার আশা নেই৷ কারণ এখনও পর্যন্ত একজনও এই পশুর আক্রমণ থেকে বেঁচে ফেরেনি। ভেঙে পড়ে নন্দনা৷ তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে জ্যাঠতুতো দাদা অবনীশ। কিন্তু সান্ত্বনার হাত সীমা অতিক্রম করে চলে যায় প্যান্টের জিপারে। ঠোঁট গেঁথে যায় নন্দনার দুই বুকের মাঝখানে। আর ঠিক তখনই বুনো জন্তুর গন্ধে ঘর ভরে ওঠে। প্রবল বমি পেতে থাকে নন্দনার। তার বাহ্যসংজ্ঞা লোপ পায়। চোখের সামনে দুলতে থাকে কুয়াশার পর্দা। শরীরের প্রতিটি রোমকূপ থেকে ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে চকচকে মসৃণ তীক্ষ্ণ দৃঢ় শলাকা৷ গুটিয়ে বর্তুলাকার হয়ে যায় শরীর। দু-চার মিনিট পরেই শলাকা ত্বরিতে গুটিয়ে যায় ত্বকের মধ্যে। এত চিকণ যে কোনও ক্লেদ থাকে না। বর্তুলাকার শরীর সটান হয়। ঘোর কেটে তাকিয়ে নন্দনা দেখে সামনে অবনীশের কাঁটা ফোটা রক্তাক্ত দেহ। নন্দনা কিছু মনে করতে পারে না৷ লেখক জানান, “গিরগিটি যখন রং বদলায়-লাল, হলুদ, সবুজ-সে কি বুঝতে পারে? জানে? প্রকৃতি জানে৷ গিরগিটি জানে না।”
এই গল্পটির মধ্যে অতিলৌকিকতা আছে। যে নারীশরীর দুর্বল বলে তার ওপর এত আক্রমণ, তার সবল হয়ে ওঠার, আক্রমণ ফিরিয়ে দেওয়ার গল্প শোনান লেখক। যে রক্তচিহ্ন পুরুষ এঁকে দিয়েছে নারীর সিঁথিতে, নারীর যোণিদেশে, সেই রক্তচিহ্নটি নারী ফিরিয়ে দেয় পুরুষের সমস্ত শরীর জুড়ে। কিন্তু এত কিছুর পরেও প্রতিবাদ ও আক্রমণ গোপনই থেকে যায়। ‘যেমন হঠাৎ একদিন আবির্ভূত হয়েছে তেমনই হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে যাবে শজারুর আতঙ্ক’। কিন্তু ধর্ষণ চলতেই থাকে। আর নারী নিজের অপমান, অবমাননা, লাঞ্ছনা থেকে ধীরে ধীরে শিক্ষা নেয়, জীবনের শিক্ষা। সে বুঝতে পারে পালাতে পালাতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। পালাতে পালাতে সে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছে। তাই ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। বুঝিয়ে দিতে হবে ‘না’ শব্দের অর্থ ‘না’-ই। পরিচিত মনে হল বাক্যটিকে! কিছুদিন আগেই এই সংলাপ নিয়ে বেশ উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনা চলেছে এদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী পরিচালিত ‘পিঙ্ক’ সিনেমার কথাই বলছি। যেখানে তিনটি মেয়ে পেশার তাগিদে দিল্লিতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকে। এখনও পর্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়ার কারণে বা অন্যান্য আর্থিক প্রয়োজনে তারা কখনও কখনও নিজেদের শরীরের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করে। আমাদের সমাজে এককথায় তাদের ‘বেশ্যা’ বলে। তবে এই তথাকথিত ‘বেশ্যা’রাই যখন চার মদ্যপকে প্রত্যাখ্যান করে, তখনই সম্ভ্রান্ত পরিবারের সেই সব পুরুষদের রক্ত চলকে ওঠে। ‘বেশ্যা’র প্রত্যাখ্যান তাদের সম্ভ্রমে আঘাত করে। তারা শক্তি প্রয়োগ করে। মেয়ে তিনটি পালটা শক্তিতে তাদের পরাজিত করে। এরপর থেকেই শুরু হয় রাজনীতি ও বিচারব্যবস্থাকে তুরুপের তাস করে পুরুষতন্ত্রের তাণ্ডব। বহু বিরুদ্ধ পরিস্থিতি অতিক্রম করে চলচ্চিত্রটিতে শেষ পর্যন্ত একথা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় যে, যদি কোনও মেয়ে, এমনকি সে যদি দেহপোজীবীও হয়, তবু তার ‘না’ বলার অধিকার আছে। গ্রাহক পুরুষটি তা মেনে নিতে বাধ্য। তাকে জোর করার কোনও অধিকার গ্রাহকটির নেই।
মনে পড়ছে সুজান জর্ডনের কথা? পার্ক স্ট্রিটের ফাঁকা রাস্তার ধারে অন্ধকারে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর অপমান সহ্য করার পরও পাবে গিয়ে মদ্যপান করার জন্য বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ করার জন্য যাকে আরও অনেক বেশি অপমানিত হতে হয়েছিল। কিন্তু তাকে দমানো যায়নি। তার ধর্ষকদের গ্রেপ্তার করে প্রশাসনের কুনজরে পড়ে যায় আর এক মহিলা পুলিশ আধিকারিক। কলকাতার মেয়ে সুজান, দিল্লির মেয়ে নির্ভয়া-এদের আর দমিয়ে রাখা যাবে না। পুরুষ তুমি যত অত্যাচার করবে, নারী ততই তা অতিক্রম করে মাথা তুলে দাঁড়াবে। একটি ধর্ষণ আর পারবে না মেয়ের মানুষজন্মটাকেই ব্যর্থ করে দিতে। নারী একদিন সহ্য করেছে, তারপর সে খুব গোপনে প্রতিবাদ করেছে, আর আজ সে সর্বসমক্ষে নিজের অধিকার বুঝে নিতে সক্ষম হয়েছে। নারী প্রগতির এও এক দলিল। তাই ঝিনুকের দুঃসাহসিক প্রতিবাদের ঘটনায় একটুও উচ্ছ্বসিত না হয়ে তার ঠাকুমা বলতে পারে, ‘কী এমন বাহাদুরির কাজ করেছে ঝিনুক?....একটা স্বাভাবিক মানুষের যা করা উচিত, ঝিনুক তো তাই করেছে।....অন্যায়টা চোখের সামনে দেখাটাই স্বাভাবিক? মেরুদণ্ড না থাকাটাই স্বাভাবিক?’
কিন্তু এসবের হদিশ জানে না ধর্ষক। তার চরিত্র বদলায়নি। বদলায়নি তার পুরুষত্বের মিথ্যা গরিমা। বদলায়নি নারীকে পণ্য, ভোগ্য ভাবার মতো সংকীর্ণ মানসিকতা। তাই ধর্ষকের পরিবর্তন নেই। ধর্ষকের চরিত্র বদলায় না। আর নারী, পুরুষতান্ত্রিক সম্ভোধন - মেয়ে, বউ, মা, বোন, বেশ্যা, ধর্ষিতা - সমস্ত বিশেষণ অতিক্রম করে হয়ে উঠেছে পরিপূর্ণ মানুষ।
“আমরা তো জানি পৃথিবী রমণী আকাশ আদিম পুরুষ
তবে কেন তুমি আমার দু'হাতে শেকল পরিয়ে রেখেছ
হাজার বছর ধরে কেন তুমি সূর্য দেখতে দাওনি? ....
যে মাটিতে তুমি দাঁড়িয়ে রয়েছ তার অপমান করো না
পুরুষ, আমি তো কখনও তোমার বিরুদ্ধে হাত তুলিনি।”
(‘রক্তচিহ্ন’/ মল্লিকা সেনগুপ্ত)
……………….
No comments:
Post a Comment