ভ্রমণঃ দিনান্তে দিনান্ত-এঃ সাবর্ণ্য চৌধুরী

    দিনান্তে দিনান্ত-এ


সাবর্ণ্য চৌধুরী



বিফোর সানরাইজ দেখে যদি এরকম ধারণা হয় ইউরোপের সামার ওই সিনেমার মত হয়ে থাকে তাহলে কিছুটা মুখ থুবড়ে পড়তেই হয়। আমার তো অন্তত পড়তে হয়েছিল। আমার মত উপমহাদেশ থেকে আসা সবারই হবে বলেই মনে হয়। সে কথায় পরে আসছি। আমি ইউরোপে থাকতে আসি অক্টোবর নাগাদ। ঠান্ডাটা সবে সবে পড়তে শুরু করেছে। কালিপুজোর পরে মাঠে বসে পাড়ার ক্লাবের আয়োজন করা খিচুড়ি ফিস্টের সময় যে রকম ফিলিং হয় ঠান্ডার; এদের কাছে অক্টোবর সেরকমই। কিন্তু আমার কাছে তো বিষ! দিল্লির ২৮ ডিগ্রি থেকে হঠাৎ ৬ ডিগ্রিতে নেমে গেলে আর কী ফিল হবে বলুন। সে যা হোক, মাসখানেক এখানে মানে জার্মানিতে কাটানোর পরে বুঝলাম আরও চাপের দিন আসছে। কারণ এই ঠান্ডা বেশ বেগ দেবে, এদের ভাষা বলি না আর একটা চাপা রেসিজম। ভাষা বলতে পারলে এই রেসিজম কিছুটা কাটানো যায় যদিও, কিন্তু খুব ডিপ্রেসিভ জাতি এই জার্মানরা। কথা বলে না বেশি, ধুর। 

এসবের মধ্যেও কিছুটা মুক্তির বাতাস ছিল আইরিশ পাব। ইংল্যান্ডের পরিত্যক্ত কিছু সেনাবাহিনীর মানুষজন এখানে এখনও আছে। তাদেরই পরবর্তী প্রজন্ম এখানে আসত। তাদের জার্মান খুব ভাঙা ভাঙা, বা আদপেই জানে না। তাই একটু স্বস্তির জায়গা আছে। মুশকিল হল আমার সুরাসক্তি নেই, তাই মাঝে মাঝে যাওয়াটা একটু কেমন আর কী! বুঝতেই পারছেন আপনারা। তবুও যেতাম ইংরাজি শব্দগুলো দিয়ে কানটাকে একটু স্বস্তি দিতে। এরকম ভাবেই একদিন আলাপ হলো গ্রেগরীর সাথে। গ্রেগরী কেন্টের বাসিন্দা, তবে ১৯৮২ থেকে এখানেই থাকে, বছর ৭৫-৭৮ এর নিজেকে যুবক হিসাবে দাবি করা মানুষ। বেশ নেশাগ্রস্থ থাকাবস্থায় একদিন আমায় বলল,

“ইউ নো স্যাবি (আমার নাম উচ্চারণ করতে যা সময় লাগে তার মধ্যে কালকা মেল হাওড়া স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে যায়। তাই ছোট করে নেওয়া নাম) লিভ দিস কান্ট্রি বাডি। জার্মানি ইজ কাপুট (জার্মানে কাপুট মানে খারাপ)।”

“ওকে আই আণ্ডারস্ট্যান্ড, বাট হোয়াই?”

“দিস ব্যাগারস থিঙ্কস দে আর সুপিরিওর। ব্লাডি কান্টস।”

“ওকে গট ইট। নাও স্টপ ড্রিংকিং এন্ড গো হোম।”

“ওহ কাম অন স্যাবি, নাইট ইজ স্টিল ইয়ং। টেক মাই ওয়ার্ড এন্ড গো টু বেলজিয়াম। গুড ফুড, ডাচ এন্ড ফ্রেঞ্চ গার্লস, অনলি ইংলিশ, ইয়োর লাইফ উইল বি সো কালারফুল। টেক মাই ওয়ার্ড ইয়ং ম্যান।”

“ওকে আই উইল থিংক।”

সেদিন ওকে গাড়িতে তুলে বাড়ি ফিরে আসার পথে একবারও ভাবিনি যে জার্মানি ছেড়ে যাব, তবে বেলজিয়াম বেড়াতে যাব ভেবেছি, আর সুযোগটাও এসে গেল ক’দিনের মধ্যেই। মার্চ মাসের মাঝামাঝি এক দাদা কলকাতা ছেড়ে ব্রাসেলস আসছে শুনেই মনে মনে ইটেনারি সেট করে নিয়েছি। বেলজিয়ামে আসার পরেই একরাতে দেখি হঠাৎ ফোন,

“সাবু (আমার বহুল প্রচলিত ডাকনাম) মার্চ এন্ডে প্ল্যান হোক নাকি?”   

“একদম। সাথে বিদিদিও থাকবে নাকি?”

“বিদিদির ব্যাপারটা ঠিক জানি না, তবে তুই আমি আছি।”

“আমি ডেটটা ফাইনাল করে জানাচ্ছি।”

“ওকে।”

দিনক্ষণ ঠিক হলো মার্চের শেষে। ইউরোপে সামার তখনও শুরু হয় না। তখন মূলত বসন্ত, বাতাসে বহিছে প্রেম ফিলিংটা না এলেও বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে প্রেম বইছে বলা চলে। কিছুটা সিনেমার মতই বলা চলে। ঠিক সময় মতো আমি প্ল্যান করে চলে গেলাম সপ্তর্ষি-দা ওরফে সপা-দার বাড়ি। সেখান থেকেই একদিন প্ল্যান হল দিনান্ত যাব। সপাদা একদম প্রপার ব্রাসেলসে থাকে না, ব্রাসেলস থেকে একটু দূরে মেকেলেন নামে একটা জায়গায়। ট্রেনে ব্রাসেলস আসতে মিনিট পঁচিশ মতো লাগে। আর দিনান্ত আবার মেকেলেন থেকে ট্রেনে প্রায় এক ঘন্টা মত লাগে, মাঝে দুটো বদল; মেকেলেন থেকে ব্রাসেলস নর্ড, সেখান থেকে ওটিগিন্স বলে একটা জায়গা, সেখান থেকে দিনান্ত। বেশ সময় লাগে। 

ইউরোপে যারা বাইরে থেকে আসে তাদের দেহঘড়ি মূলত সূর্য ওঠার ওপর নির্ভর করেই চলে। এখানে শীতে দেরিতে সূর্য ওঠে, তাই আমাদেরও লেট। আর ছুটি তার ওপর এক্সট্রা টপিং। যথারীতি স্বভাবসিদ্ধ বাঙালি ধারায় আমরাও নির্ধারিত টাইমের থেকে লেটে শুরু করলাম। যেমন হয় আর কী!

“সাবু, খিদে পাচ্ছে?”

“না এখনও না, এই তো এত খেয়ে এলাম।”

“কই আর এত! ওইটুকু দুধ কর্নফ্লেক্সে কী আর হয়। এখানে ট্রেনে কিছুই ওঠে না ধুর।”

“সপাদা এটা কালনা লোকাল না, আই সি।”

“জানি, স্টিল!”

ফ্রেঞ্চদের ব্যবহার নিয়ে বিশ্বজোড়া বদনাম থাকলেও খাওয়াটা জাস্ট সেরা! কোনও কথাই হবে না। ওটিগিন্স স্টেশনে আমাদের ট্রেন বদলের মধ্যে মিনিট পঁচিশ মত সময় ছিল। স্টেশন লাগোয়া একটা ক্যাফে দেখে সপাদা ঢুকে গেল আর সাথে একটা করে ক্রোঁসো আর ব্ল্যাক কফি নিয়ে বেরিয়ে এলো।

“সাবু টপাটপ খেয়ে নে। ক্রোঁসোকে অপেক্ষা করাতে নেই কখনও।”

প্রথম কামড় দেওয়ার পরেই যেন মনে হল মোক্ষ লাভ হল। এত ভালো ক্রোঁসো আমি আগে খাইনি; কারণ আমি প্যারিস যাইনি। জলদি বললেও বেশ রসিয়ে রসিয়ে খেলাম সময় নিয়ে। সাথে কফি। আহা। 

“কী রে কেমন লাগল?”

“আলাদাই, জাস্ট আলাদাই!”

“আর কিছু খাবি?”

“দাঁড়াও আমি দেখে আসি। আনছি সেরম কিছু মনে ধরলে।”

“ওকে যা, কিন্তু জলদি যা আর মিনিট দশ মতো আছে।”

“ওকে।”

আমি ফ্রেঞ্চের ফ-ও জানি না, এত ঁ -এর প্রাধান্য যে কিছু বুঝতে না পেরে আঙ্গুল দিয়ে দেখালাম। পরে ওরা নামটা বলে দিল। শুনে মনে হল ১৯৮৯ সালের আশিকির কোনও একটা গানকে আমার গুরু শানুদার মত করে গেয়ে দিলেই এরা বুঝে যেত। যাই হোক, যেটা নিলাম সেটা একটা পেস্ট্রি টাইপ জিনিস। ঠিক পেস্ট্রি না, আবার চিজকেকও না। আলাদা টাইপের একটা জিনিস, নামটা মনে নেই। ধরে নিন না ‘বাঁস এঁক সঁনম চাঁহিয়ে’।

“ভালো লাগল?”

“কোনটা তুই যেটা আনলি?”

“হুঁ।”

“বেশ খেতে রে। আমি এত মিষ্টি ভালোবাসি না, কিন্তু আমার বেশ লাগল।”

“হ্যাঁ, হালকা মিষ্টি।”

“হুঁ হুঁ বাওয়া, ফেঞ্চ কুইজিন!” 

“হ্যাঁ সেই!!”

“জানিস যেখানে যাচ্ছি সেখানে আমার যাওয়ার অনেক দিনে ইচ্ছা ছিল। আর হয়ে ওঠেনি।”

“আরে এই তো এলে দিন পনেরো, একটু পিঠের ব্যথাটা মরুক, তারপর না হয়…”

“তুই এলি বলে তবু হল, নাহলে আবার ল্যাদ খেতাম। এই বিদিদিটাও ল্যাদের চক্করে আর এলো না!”

“বাঙালি আর ল্যাদ, ও মা গো! টুরু লাভ!”

“সেই! যেখানে যাচ্ছি নামটা জানিস? বা ডিটেলস?”

“হ্যাঁ, দিনান্ত তো। তুমিই তো কাল বললে, আমি আর টাইম পাইনি, পড়ার। তাই নো ডিটেলস!”

“তুই কাল শুয়ে পড়ার পরে আমি দেখলাম কিছুটা।”

“তো শুনি কী দেখলে তুমি।”

“ওই যে ওটিগিন্স দেখলি ওটা আগে ফ্রেঞ্চ এলাকা ছিল। শুধু ওটাই না, ফ্রান্স বর্ডার লাগোয়া সময় জায়গাই এক কালে ফরাসি অধীনে ছিল। তাই জন্যেই বেলজিয়ামে বেশির ভাগ মানুষই ফরাসি বা ডাচ বলে। আর ওই আখেনের দিক মানে জার্মান বর্ডারের কিছু মানুষজন জার্মান বলে। কিন্তু সে পারসেন্টেজ খুব একটা বেশি না।”

এতক্ষণে আমি গ্রেগরীর কথাটা বুঝতে পেরেছি, কেন বলছিল ফ্রেঞ্চ আর ডাচ মেয়ে। কিছুক্ষণের জন্যে মন সরেছে তো সপাদা ঠিক ধরেছে।

“কী রে? শুনছিস?”

“না মানে হ্যাঁ বলো। ওই একটু ভাবছিলাম।” 

“নিশ্চয়ই কোনও কেচ্ছা!”

“আরে না না হ্যাট। বলো না তারপর…”

“গল্প বলছি, কিন্তু আগে দুটো ট্রিভিয়া দিয়ে রাখি তোকে। অ্যাজ ইউ নো আমার কথাবার্তা বা লেখাতে ট্রিভিয়াটাই মেন আকর্ষণ। দিনান্ত নামটা এসেছে একটা সেল্টিক শব্দ থেকে। সেল্টিক শব্দ ‘দিভো-নান্টো’ থেকে, এর অর্থ হলো ‘সেক্রেড ভ্যালি’ বা পবিত্র উপত্যকা। এণ্ড অ্যাজ দ্যা নেম সাজেস্ট এটা একটা পাহাড়ি উপত্যকা, ক্লিফ বলাটা বেশি ভালো বলে মনে হয়। ক্লিফের নিচে মিউসে আর লিস নদীর সংগমের কাছেই বসেছে শহরটা। এই দেখ ছবি।”

ছবি দেখেই বুঝলাম অসাধারণ সুন্দর এই শহর আর এর প্রধান আকর্ষণ এই দিনান্ত সিটাডেল বা ফোর্ট। আর সাথে নোত্রে ডাম কলেজিয়েট চার্চ। নাম শুনেই কেমন প্যারিস প্যারিস ফিল হয় না? 

“এই তোমার ট্রিভিয়া? ধুস!”

“আরে দাঁড়া না, শেষ তো করতে দে! অ্যাডলফ স্যাক্স এর নাম শুনেছিস?”

“অন্য সারনেম দিয়ে শুনেছি, এটা শুনিনি।”

“গাধা! স্যাক্সোফোনের ইনভেন্টার রে।”

“ওহ আচ্ছা। জানতাম না আসলে। এটা একটা হলো, আর একটা কী?”

“জীবনে কী ধৈর্য বলে বস্তু নেই?”

“আরে তুমি এরম হাইপ দিয়ে হাল্কা করে ছাড়লে হবে? তেল গরম আছে ফটাফট চপ ছাড়ো।”

“হা হা। আর একটা হল লেফে, যেটা সারা বিশ্বে বিখ্যাত বা বেলজিয়ামের বেস্ট বিয়ার বলেও মানা হয় সেই লেফের নামকরণ হয়েছে আবে অফ লেফে থেকে। এই দিনান্তেই।”

“এটা সত্যিই একটা ভালো ট্রিভিয়া। ইন্ডিড।”

“ইউ মিন আগেরটা ভালো ছিল না?”

“না মানে সেটা না, বাট ইটস বেটার ইউ নো!”

“ওকে। এটা নিয়ে পরে কথা বলছি। এখন স্টেশান এসে গেছে। নামতে হবে।”

ট্রেন থেকে নেমে বাইরের দিকে তাকিয়ে আমি কিছুটা হতবাক হয়ে গেছি। পাহাড়ের ধার ধরে একটা ছোট্ট নদী বয়ে চলছে অনবরত আর তার পাশেই বসেছে একটা ছোট শহর। পাহাড়ের উপর দিনান্ত সিটাডেল দাঁড়িয়ে আছে বহু ইতিহাসের ভার বহন করে। সিটাডেলের নিচেই রয়েছে কলেজিয়েট চার্চ। আর তারই পাশে বেশ কিছ খাওয়ার জায়গা আর মনোহারী জিনিসের দোকান। আর নদীর দুপাশকে যোগ করতে একটা ছোট ব্রিজ। কিন্তু ব্রিজের বৈশিষ্ট্য হল পুরো ব্রিজটা স্যাক্সোফোনের ডিজাইন দিয়ে সাজানো।




হাঁ করে আমি চারপাশ দেখছি ঠিক তখনই কানের কাছে ফিসফিস করে একটা কথা এলো, “কী রে কেমন লাগছে? ছবির থেকেও বেটার না?”

“একদমই তাই! জাস্ট আলাদাই।”

“হুঁ!”

ব্রিজ ধরে সামনের দিকে এগিয়ে এসে যখন চার্চে ঢুকতে যাব তখন আমাদের পিছু হটতে হল। চার্চ বন্ধ। ভিতরে মেরামতির কাজ চলছে। মন খারাপ হয়ে গেল! আর মন খারাপ হলে বাঙালিদের আবার বেশি বেশি খিদে পায়, আমাদের তো আরওই পায়। চিড়িয়াখানা গিয়ে লুচি তরকারি খাওয়ার কথা ভুলে গেলেন? 

পেট ভর্তি করে পিৎজা খাওয়ার পরে সিটাডেলের দিকে তাকিয়েই গায়ে জ্বর এলো। একেবারে গোটা পাঁচশ সিঁড়ি চড়া কী মুখের কথা নাকি? তাও আবার এই ভরা পেটে। করুণ মুখে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেলাম কেবল কারের দিকে। দেশে থাকাকালীন একবার দুবার চড়েছি কেবল কার বা রোপ-ওয়েতে। এখানে এসে এই প্রথম। রোপ-ওয়ে করে উপরে যাওয়ার সময় নদীর বিপরীতে যা সব নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখলাম সে ভাষায় প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব না। 

“সপাদা ওপাশটা দেখলে?”

“একদম, দেখব না মানে! ছবি তুলেছিস?”

“অফকোর্স। কিন্তু চোখে দেখার মতো কি আর হয়!”

“সে তো বটেই।”

“কিছু ট্রিভিয়া বিফোর গোয়িং ইন?”

“উম্ম, সেরম কিছু না। কিছু পয়েন্টার। ওই ধর ১০৪০ সালে লিজ-এর প্রিন্স-বিশপ এই ফোর্ট বানান, কারণ দিনান্ত ছিল পড়শি রাজ্য নামুরের সীমান্তে। আর বুঝতেই পারছিস এদের মধ্যে বনিবনা ছিল না। ওটা ছিল প্রথম ফোর্ট। নামুরের বার্গ অফ ক্রাভাকোঁ এই সময়ের আশেপাশেই মিউসে নদীর অন্যদিকে, মানে ওই নামুরের দিকেও একটা ফোর্ট বানান। হাড়ি আর কলসি পাশাপাশি থাকলে আওয়াজ যে হবেই সেটা তো বলতে হবে না আর তোকে।”

“আচ্ছা।”

“এর পরে ১৪৬৬ সালে দিনান্ত শহর পুরো ধূলিসাৎ হয়ে যায়। মানে সব কিছু। বহু মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয় এই সময়ে। এর পরে আর ডিটেল আমি পাইনি ইনটারনেটে। ১৬০০ শতকে এভেরার্ড অফ দ্যা মার্ক আবার নতুন করে এই ফোর্ট বানান। আর পাকেচক্রে তিনিও এই সময়ে লিজ-এর প্রিন্স-বিশপ ছিলেন। এর পরে বারে বারে হাত ফেরত হয় এই ক্যাসেল আর ফোর্টের মালিকানা। ১৬৭৫ সালেই লুই-১৪ এর সেনা এই ক্যাসেল দখল করে নেয়। তারপর থেকে প্রায় ১৭০০ শতকের শুরু অবধি এরা থাকে এখানে। বাট ছেড়ে যাওয়ার আগে, মানে অ্যারাউন্ড ১৬৯৫-৯৬ সালে কী আর একটু পরে; শালারা সব ভেঙ্গে দেয়। আই মিন, যেগুলো নিজেরা বানিয়েছিল সব…”

“ওহ। ইউ নো, টিপিকাল ‘ফ্রেঞ্চ’।”

“সিরিয়াসলি।”

“এর পরে ১৮১৮-২১ সাল নাগাদ ডাচরা যখন এই শহরের শাহেনশাহ হয়ে আসে তখন এই ফোর্ট আবার নতুন করে বানানো হয়। সেই থেকেই এখনও চলছে এটা। মানে আর কেউ বানায়নি নতুন করে। আর সব থেকে বড় কথা হল এরা কিন্তু পাথ ব্রেকিং কিছু করতে যায়নি। পাথর যেভাবে সাজিয়ে দিয়েছে সেটাকেই কাজে লাগিয়েছে। আর এই জন্যেই এই সিটাডেল ঘোড়ার ক্ষুরের মত।”

“আচ্ছা! নাও ইটস ইন্ডিড এ গুড ট্রিভিয়া।”

“আবার!”

“হা হা..”“তুই খালি ইঞ্জিনিয়ারিংটা দেখ। এখানে কিছু কিছু ছোট জানলা মত করা আছে আর যার পিছনে একটা করে কামান বসানো। ওপরে আসার সময় মিউশ ভ্যালিটা দেখলি তো?”

“ওই উলটোদিকেরটা তো?”

“হুঁ। এই কামানগুলো ওই ভ্যালিটা মোটামুটি কভার করে নিত। একটাই চাপ হল যদি উপত্যকার দিক থেকে কেউ ফোর্টকে আক্রমণ করে। সেই জন্যেই একটা পরিখা বানানো হয় সিটাডেলের চারপাশে, শুকনো পরিখা। এর পরেও একটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে!”

“কেন?”

“সিঁড়িগুলো কিন্তু সামনের দিকে। মানে ফোর্টে কিছু হলে, ভেতরের সেনাবাহিনী যদি সিঁড়ি দিয়ে পালাতে চায় তাহলেও মরবে যদি মিউশ ভ্যালির দিক থেকে গুলি ছোঁড়া হয় তো।”

“আরে হ্যাঁ! তাই তো! এটা তো ভাবিনি আগে।”

“হুঁ বেশ চাপের ব্যাপার ছিল।”

এইভাবে কথা বলতে বলতে আমরা যে কখন ফোর্টের ভিতর চলে গেছি খেয়ালই করিনি। এখানের একটা খুব ভালো ব্যাপার হল প্রতিটা জিনিসের পাশে তার ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা লিখে রাখা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অডিও গাইডও থাকে। তাই জন্যে আলাদা করে গাইড না নিলেও চলে, সাথে সাথে সেই সময়ের একটা ফিলও পাওয়া যায়। বিভিন্ন উপাদানের সাথে সাথে একটা দারুণ জিনিস দেখেছিলাম এখানে। ১৯১৪ সালে জার্মান আর ফরাসি আক্রমণের সমায়নুসারে বিশ্লেষণ। নদীর এপাশ থেকে ওপাশে কিভাবে যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণ হয়েছিল সেগুলো লাইটের সাহায্যে খুব নিপুণভাবে বোঝানো। সেটা আমায় বেশ টেনেছিল বটে। 

ঘুরতে ঘুরতে একটা জানলার কাছে এসে দাঁড়ালাম, সেখান থেকে বিপরীতে পুরো উপত্যকাটাই দেখা যায়। আর এটাও খেয়াল করলাম যে জানলার ঠিক পিছনেই একটা কামান রাখা। কামানে চোখ রেখে বুঝলাম তাক করা ওই মাঝের ব্রিজের দিকে, মানে কেউ এপাশে আসতে গেলে ব্রিজটাকেই ভেঙ্গে দেওয়া হবে। এগুলোর কথাই যে সপাদা বলছিল সেগুলো বুঝতে সময় লাগে না।

মাঝের ব্রিজ, পিছনে দিনান্ত ক্যাসেল আর মিউশ উপত্যকা

 

সেই সময়ের বিভিন্ন জিনিস সাজানো আছে আনাচে কানাচে, তখনকার সেনাদের জামাকাপড়, অস্ত্র, বন্দুক থেকে শুরু করে নানারকম জিনিস, বিভিন্ন নথিপত্রও আছে ওখানে। কিন্তু সে তো সব জায়গাতেই থাকে। এখানে রয়েছে একটা বিশেষ জিনিস, যেটার হদিশ পাই আমরা একদম সিটাডেলের মাথায় উঠে। বাইরে যাওয়ার রাস্তা খুঁজতে খুঁজতে আমাদের এক ফ্রেঞ্চ ভলান্টিয়ার একটা ঘরে ঢুকিয়ে দেন। ঘরটা মূলত বিশ্বযুদ্ধের সময় বানানো সুড়ঙ্গের আদলে বানানো। খুব স্বাভাবিক ভাবেই এটা সিটাডেলের অংশ না, পরে বানানো একটা ব্যাপার। সে যা হোক ভেতরে তো গেলাম। বেশ নিভু নিভু লাল আলো, বাঁশ কাঠ দিয়ে বানানো কাঠামো; সিনেমাতে যেমন দেখায় আর কী। লুক এন্ড ফিল একদম সেরকমই। আশপাশ থেকে গুলি চলার আওয়াজ আসছে। বেশ ভালোই লাগছিল, খুব থ্রিলড লাগছিল সাথে সাথে। কিন্তু গণ্ডগোল হল নিচের তলায় এসে। ঘরটা দু’তলায় ভাগ করা। ওপর তলা সমতলের মত হলেও নিচের তলাটা কীরকম যেন অন্যরকম বানানো। মেঝেটা বাঁকা, আলাদা রকম ভাবে বানানো। 

কিছুক্ষণ পর থেকেই পা কেমন এলোমেলো হতে শুরু করল, তার সাথে মাথাটাও কেমন ঘুরতে শুরু করল। হাঁক দিলাম,

“সপাদা, ঠিক আছ?”

“না ভাই, কেমন একটা হচ্ছে!”

“তোমারও হচ্ছে?”

“হুঁ, মানে তোরও হচ্ছে?”

“হুঁ।”

“আস্তে আস্তে দেওয়াল ধরে ধরে এগিয়ে যাই তাহলে। আর কী করার আছে!”

“হুঁ। সামনে দরজা দেখা যাচ্ছে তো।”

“হুঁ।”

সে রাস্তা পেরোতে মিনিট তিন লাগার কথা, সেই রাস্তায় মিনিট দশ চক্কর খাওয়ার পরে বাইরে এলাম যখন তখন প্রায় ডিকশনারি উজাড় করে গালাগাল দিয়ে ফেলেছি আমরা দুজনেই। বাইরে এসে বেঞ্চগুলোতে মিনিট পনেরো বসে নিজেদের ধাতস্থ করতে করতে খবর পেলাম যে কেবল-কার বন্ধ, তাই সিঁড়ি আমাদের অপেক্ষা করছে। তবে নামাটা অপেক্ষাকৃত সোজা ওঠার থেকে। 

“ঘরটা কেমন লাগল সপাদা?”

“যেমন তোর লাগল!”

“হা হা হা!”

“তোকে তো বলা হয়নি, বেলজিয়াম যখন সব শাসন থেকে মুক্ত হল, ১৮৭৮ এ; তখন বেলজিয়াম আর্মি এখানে থাকতে শুরু করেছিল কিছুদিন। কিন্তু সেই সময়ে এই ফোর্ট টোর্ট বেশ ওল্ড-ফ্যাশান হয়ে গেছে। তাই বেলজিয়াম সরকার এটা বিভিন্ন প্রাইভেট ওনার ডেকে বেচে দেয়। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনারা এই ফোর্টে নিজেদের ঘাঁটি গেড়েছিল।”

“আচ্ছা! এটা আগে জানতে? নাকি কোথাও পড়লে?”

“হুঁ জানতাম না, নেটে দেখলাম।”

“আরে নেট পাচ্ছিলে? আমায় আগে বলনি তো। বললে তো আমি একটা কাজ করতাম!”

“তোর আর কাজ! সেই তো হোয়াটসঅ্যাপ করবি!”

“হ্যাট!”

নিচে নেমে আসতেই প্রায় বিকাল হয়ে এসেছিল, ততক্ষণে দিনান্ত ক্যাসেল বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়, আর ওই পাশটায় যাওয়া হয়নি। আর পেটের ডাক ফেলে কীভাবে মনের আশা মেটানো যায় বলুন। তাই পেটের ডাক আগে! কী খাব কী খাব এই খোঁজে বেরোলাম আমরা। তবে খোঁজে বেরোনোর আগে কিছু ছবি রেখে গেলাম আপনাদের জন্যে, দেখুন কেমন লাগে…


কেবল কারে করে উপরে যাওয়ার সময় মিউশ উপত্যকা

সিডাটেলের মাথা থেকে পুরো মিউশ উপত্যকা

বাম পাশে মিউশ নদীর উপরের ব্রিজ

সিডাটেলের মধ্যে জানলা। এখানে কামান থাকত।

সিডাটেলের মাথায় আমি (বাম দিকে) আর সপ্তর্ষি বোস( ডান দিকে) ওরফে সপাদা

 




                                                                                                                              

 






No comments:

Post a Comment