কয়েক পশলা বৃষ্টির পর আকাশটা এখন জলদ মেঘের ভারে থইথই করছে। সঙ্গে ঝিকি-মিকি বিদ্যুতের ঝলক আকাশটাকে চিরে দিচ্ছে বারবার। জোলো হাওয়া বইছে বেশ। এমন দিনে কাজের জন্যে বাইরে বেরোবার ইচ্ছেটা বিধুর একেবারেই করে না। ঘরে বসে গরম চা, মুড়ি আর তার সঙ্গে আসলামের দোকানের আলুর চপ খেতে মন চায়। কিন্তু এ-তো শখের আকাশকুসুম চিন্তা। আসল খিদে পেট জানে, যে খিদে দু’মুঠো ভাতের গরাসের খিদে, আর সে বড় বালাই। তাই আজ একটুও ইচ্ছে না থাকলেও শেষমেশ ওর রুজি-রুটির দোসর ভ্যান-রিক্সাটা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েই পড়ে সে। যেটুকু রোজগার হয়, তাই লাভ! দুদিনের অন্ন-সংস্থান নিশ্চয়ই হয়ে যাবে তাতে। আসলে রাস্তায় তিন-চাকাওয়ালা টোটো রিক্সাগুলোর বাড়-বাড়ন্ত হওয়ার পর থেকে তার রোজগারেও টান পড়েছে। সওয়ারিরা সবাই চায় হালফ্যাশন-এর টোটোতে চড়তে। কিছুদিন আগে অবধিও যে এই ভ্যান-রিক্সাগুলোই তাদের যাতায়াতের মুশকিল আসান করার চাবিকাঠি ছিল, এখন সে কথা সবাই ভুলে গেছে। সাধে কী আর মানুষকে বেইমান বলে বিধু? নিজের মনেই খানিক গজগজ করে সে। বাদল বাতাসে সেকথা চাপা পড়ে যায়।
দু-বছর বয়সে বাপ আর সাতে মাকে খোয়ানোর পর ঠাকুমার কাছেই এতটুকু বড় হয়েছে বিধু। এখন সে উনিশ বছরের হাট্টাকাট্টা জোয়ান। গায়ের শ্যামলা রঙে চিকন ঘামতেল। কাঁধ ছোঁওয়া কোঁকড়ানো চুল। কাজে বেরোলে মাথায় একটা লাল ফেট্টি জড়িয়ে রাখে, শীত গ্রীষ্ম বারোমাস।
“এটা আমার জন্য খুব পয়া। এটা খুললে রোজগারও বন্ধ হয়ে যাবে।” বলেছিল বিধু ওর বন্ধু রফিককে সেদিন।
“কেন রে, কেউ বলেছে বুঝি?” রফিক শুধিয়েছিল অবাক হয়ে।
“না মানে, অন্য কেউনা, আমার মনই বলে এটা। মন সত্যি বলে। আমি জানি।”
বিধুর রুজিরুটির কাজটাও বড় অদ্ভুত। রোজ সন্ধের পর হাসপাতালের লাগোয়া মর্গের বেওয়ারিশ লাশগুলোকে তার তিনচাকার ভ্যানে চাপিয়ে রাতারাতি ভাগাড়ে চালান করে বিধু। শহরের প্রায় লাগোয়া এই আধা-গ্রাম জায়গাটায় এরকমই কারবার চলে। শহরের নীতি-নিয়মের ধার কেউই ধারে না এখানে। ভাগাড় থেকে সেই লাশগুলো নিয়ে যায় অন্য আরেক দল। নানান পন্থায় ধোলাই-সাফাই করার পর সেই কঙ্কালগুলো বিক্রি করে মোটা দামে। শুনতে অদ্ভুত হলেও কথাটা সত্যি। তার একটা পেট দিব্যি চলে যায় আরামে। ঠাকুমা স্বর্গগত হওয়ার পর সে তো একাই। নিজেই হাত পুড়িয়ে সকালে দু-মুঠো চাল রান্না করে। রাতে ফেরার পথে আসলামের দোকানেই খেয়ে নেয়। জীবন এরকমই চলে তার।
আজ বস্তি থেকে বেরোতেই এই দৃশ্যটা চোখে পড়লো। বড়রাস্তার ধারে রোজ “আল্লা কে নাম...” বলে বলে ভিক্ষে চাওয়া কুষ্ঠরুগি বুড়োটাকে ভিজে ফুটপাতে শোয়ানো দেখে অবাক হল খানিক। গলা অবধি একটা আধা নোংরা চাদরে ঢাকা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্রাণবায়ু নেই। মূর্দার পাশেই একটা বছর চোদ্দর মেয়ে হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে। কাঁদছে মনে হয়। বৃষ্টির ছোঁওয়ায় তারও ভিজে গা। রাস্তায় হাজারো লোকের যাওয়া আসা চলছে, কেউ দেখেও দেখেনা। কারও আবার এসবে ভ্রুক্ষেপও নেই। কেউকেউ মেয়েটাকে জরিপ করে নিচ্ছে একবার। কিন্তু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি।
“তোর নাম কী?” ভ্যান থামিয়ে মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করে বিধু। মেয়েটাকে দেখে কেমন মায়া হতে ভ্যান দাঁড় করিয়েছে সে।
“পরিবানু।”
“পরিবানু? বাব্বাহ্, নামের বাহার নেহাৎ কম না দেখছি। তা বুড়োটা কে হয় তোর? কবে মরেছে?”
“দাদু হয়। আজই মরিছে। আমার ঘরে আর কেউ নাই। দাদুরে দাফনাবার পয়সাও নাই। পাড়ার মানষি ভাগাড়ে ফেলে দিতি বলিছে দাদুরে, আমি কিছুতে ফেলবনি। দাফন দিব দাদুরে।” হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে মেয়েটা।
বিধুর কাজটা করতে শক্ত দুটো হাতের দরকার হলেও মনটা বড় নরম। মেয়েটার কথা শুনে কী ভেবে পকেটে হাত ঢোকায়। সেখানে গত দুদিনের রোজগার শ’পাঁচেকের মত টাকা পড়ে আছে। একটু দোনামনা করে পুরো টাকাটাই মেয়েটার হাতে দিয়ে দেয়।
“রাখ টাকাটা, কাজে দেবে। নে, এবার ধর দিকি ওপাশে, লাশটা তুলি।” তারপর দুজনে মিলে টেনে-হিঁচড়ে বুড়োটার লাশ কোনও রকমে ভ্যানে তোলে তারা।
“এবার, তুইও বসে পড় দাদুর পাশেই।” বিধু নিজেই নিজের গলা চিনতে পারে না যেন।
নিজের বাবাকে আর মনে পড়ে না বিধুর। শুনেছে খারাপ অসুখ হয়েছিল বলে কেউ লাশ ছোঁয়নি। হাসপাতাল থেকেই ফেলে দিয়েছিল ভাগাড়ে।
না, আজ আর কিছুতেই তা হতে দেবে না বিধু।
প্যাডেলের গায়ে তার পায়ের চাপে ভ্যান আবার সচল হয়। ভাগাড়ের রাস্তা ওপাশে ফেলে ভ্যানের তিনটে চাকা গড়িয়ে চলে কবরখানার দিকে।
...........................
অলঙ্করণঃ- সায়ন্ন্যা দাশদত্ত
No comments:
Post a Comment