যখন আর এক সপ্তাহও দেরি নেই, তখন সুকন্যা শুটিং শেষে প্রায় মাঝরাত্তিরে ফিরে জুবিনের উদ্দেশে বলল, “আমি ঠিক করেছি, এবার তোমার সঙ্গে যাব।”
“কোথায়?” ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে চোখ না তুলে ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে জানতে চাইল জুবিন।
“মানে! কোথায় যাওয়ার কথা বলছি, বুঝতে পারছ না তুমি?” সুকন্যার কণ্ঠস্বরে বিস্ময় এবং ক্ষোভ ঝরে পড়ে, “একটু তাকাও আমার দিকে জুবিন, “আমি শুধু ঠিকই করিনি, ব্যবস্থাও করে ফেলেছি।” বলতে বলতে ব্যাগের চেন খুলে সুকন্যা ফ্লাইটের টিকিট বের করে খুব উৎসাহের সঙ্গে মেলে ধরল জুবিনের চোখের সামনে।
এবার নড়েচড়ে বসে ল্যাপটপ কোল থেকে নামিয়ে সেন্টার টেবিলের উপর রেখে জুবিন পুরোপুরি মনোনিবেশ করল সুকন্যার হাতে ধরা এয়ার-টিকিটের দিকে, “প্যারিসে যাওয়ার টিকিট?....আশ্চর্য!”
“আশ্চর্যের কী দেখলে বল তো জুবিন, আমি প্যারিস যেতে পারি না!”
“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই পারো সুকন্যা। তুমি টলিউডের ব্যস্ততম নায়িকা...শুধুমাত্র ছোটো পর্দায় নয়, বড়ো পর্দাতেও পরপর তোমার তিনটে ছবি হিট হওয়ার পর থেকে নামী প্রোডিউসারেরা লাইন লাগিয়ে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করাচ্ছে তোমাকে দিয়ে...না, সেজন্যেই আমি অবাক হয়েছি...মানে এত সব সামলে কেমন করে যাচ্ছ, তা ভেবে কিন্তু নয়... তুমি যে আমার সঙ্গী হয়ে যেতে চাইছ, তাতেই আমি অবাক হয়েছি।”
“ওহ্! তুমি চাইছ না আমি তোমার সঙ্গী হই?”
“তা তো বলিনি! বলেছি, অবাক হচ্ছি...কেন-না, প্যারিসের ফেস্টিভ্যালে আমন্ত্রিত হয়ে এবার ২০২৩ সালেই তো আমি প্রথম যাচ্ছি না সুকন্যা, আরও দু-বার আমি গিয়েছি। তুমি কিন্তু কোনওরকম উৎসাহ দেখাওনি তখন...ইন ফ্যাক্ট, আমার কাজের ব্যাপারে তুমি একেবারে নিস্পৃহ...আই মিন, উদাসীন ছিলে! প্রথম বারেই আমি যখন অ্যাওয়ার্ড নিয়ে ফিরেছিলাম প্যারিস থেকে, তখনও হেলাফেলা করেছ আমায়, যেন সহজলভ্য কোনও...”
“দাঁড়াও জুবিন,” কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে ওঠে সুকন্যা, “হেলাফেলা করেছি তোমাকে! কক্ষনো না, আমি বলেছি, এই শিল্পকলার কিছুই বুঝি না আমি।”
“একই হল,” নিজের সমর্থনে জুবিন বলে, “তাহলে এবার আমার সঙ্গে যেতে চাইছ কেন? তুমি তো আর হঠাৎ করে শিল্পরসিক বনে যাওনি রাতারাতি!”
“তা যাইনি, তবে একেবারে সামনে উপস্থিত থেকে দেখতে চাইছি তোমার নিপুণ তুলির টান। এর বাইরেও আছে আর একটা উদ্দেশ্য...বলতে পারো, একঢিলে দুই পাখি মারা।”
“কী রকম?”
“শিল্প-সংস্কৃতির পীঠস্থানে এবার হবে আমাদের সেকেন্ড হানিমুন। আর তাই আমার প্রোডাকশন হাউসের কাছ থেকে আমি টানা দশদিনের ছুটি ম্যানেজ করেছি, যাতে করে যাতায়াতের সময় বাদ দিয়ে তোমার দু-দিনের ফেস্টিভ্যাল-শেষে আমার হাতে থেকে যাবে আরও চারটে দিন...তুমি খুশি হচ্ছ না জুবিন?”
“খুশি?” জুবিনের ঠোঁটে দুষ্টু হাসির ঝিলিক, “হ্যাঁ, খুশি তো হচ্ছিই তোমার দ্বিতীয় পাখির ব্যাপারে। কিন্তু, প্রথম পাখির ব্যাপারটা...” জুবিন হঠাৎ থেমে গিয়ে সুকন্যার চোখে চোখ রাখে, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পড়ে ফেলতে চায় তার ভিতরের সবটুকু।
“কী হল--- থামলে কেন তুমি! প্রথম পাখির ব্যাপারটা নিয়ে কী বলতে চাইছ বল।”
“তোমার প্রথম পাখি মারার উদ্দেশ্য আসলে অন্য, মানে তুলির টান দেখতে নয়...তুমি যাচ্ছ দেখতে যে, সুন্দরী বিদেশিনী তন্বী নগ্নিকাদের সঙ্গে কতখানি ইনভলভড হয়ে পড়ছি আমি...ঘণ্টার পর ঘণ্টা উন্মুক্ত এক্সোটিক শরীর মেলে ধরে তারা কতখানি সিডিউস করে ফেলছে আমায়...” জুবিনের চোখেমুখে খুনসুটি, “কী গো টলিউড-সুন্দরী, ভুল কিছু বললাম কি?”
“পুরোপুরি ভুল, আমি মোটেও...”
“জেলাসি দাই নেম ইস উওম্যান। কথাটা আমি বলিনি, বলেছেন এক মনীষী...সম্ভবত উইলিয়াম শেকসপিয়র।”
“আর আমি যদি তোমাকে প্রশ্ন করি জুবিন --- তুমি জেলাস হও না --- যখন শুটিং চলাকালীন নায়কের বক্ষলগ্না হই আমি কিংবা আরও ঘনিষ্ঠ চুম্বন-দৃশ্যে--- লিপ-লক, হও না তখন জেলাস? অনেস্টলি বল সত্যি কথাটা।”
“জেলাস হই না,” জুবিন জবাব দেয়, “তবে ভালো যে লাগে না, সেটা অস্বীকার করছি না।”
“কী জানো --- শেকসপিয়র ছেলে তো...তাই অমন একপেশে কথা বলেছেন!” সুকন্যার কণ্ঠস্বরে উষ্মা ঝরে পড়ে।
“আর তক্ক-ঝগড়া নয় প্রিয়তমা...আমরা দুজনেই তো আমাদের প্রফেশন সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল হয়েই তিন তিনটে বছর চুটিয়ে প্রেম করে একে অপরকে বুঝে নিয়ে...”
“বুঝেছ না ছাই!” ফুঁসে ওঠে সুকন্যা, “যদি বুঝতে, তাহলে...”
“টপ টু বটম বুঝেছি তোমায় ডিয়ার,” বলতে বলতে জুবিন আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে দু-হাত বাড়িয়ে সুকন্যাকে টেনে নেয় তার প্রশস্ত বুকে, তারপর... 'চিনি গো চিনি তোমারে ওগো স্বদেশিনী'...গাইতে গাইতে হঠাৎ গান থামিয়ে দিয়ে লিপ-লক হয়ে যায় সুকন্যার সঙ্গে।
দুই
নীচে শার্ল দ্য গল এয়ারপোর্ট। বিমানের জানালায় চোখ রেখে রোমাঞ্চিত সুকন্যা সামন্ত। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ছুঁতে চলেছে তার স্বপ্নের শহর প্যারিসের মাটি। ১৫-ই সেপ্টেম্বরের সোনালি সকাল। দিগন্তে উদিত হয়ে দিনমণি এখন লাল রঙ হারিয়ে কমলা থেকে ক্রমশ হয়ে উঠছে হলুদ। নীল আকাশে ইতস্তত ভেসে বেড়ানো খণ্ডমেঘে বিচিত্র বর্ণবাহার! কলকাতা থেকে দিল্লি, দিল্লি থেকে সংযোগকারী বিমানের বৈকালীন উড়ানে টানা ন-ঘণ্টার ভ্রমণ আর নিদ্রাহীন রাত পেছনে ফেলে রেখে ক্লান্তিকর কাস্টমস চেকিঙের গেরো পেরিয়ে যখন ফেস্টিভ্যালের উদ্যোক্তাদের পাঠানো ঝাঁ চকচকে রেনো-তে উঠে বসল সুকন্যা, তখন তার শরীরে জেটল্যাগের বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই।
আগেই এই ফেস্টিভ্যালের কর্তাব্যক্তিকে জুবিন জানিয়ে দিয়েছিল, সে অন্য সব শিল্পীদের জন্যে নির্ধারিত হোটেলে থাকবে না, নিজের থাকার জন্যে অনুষ্ঠান-স্থানের কাছাকাছি অন্য হোটেলে থাকবে ব্যক্তিগত কারণে। আসলে, ইচ্ছে করলে জুবিন স্ত্রীকে নিয়ে তার জন্যে নির্ধারিত স্যুটে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারত, কিন্তু প্রাইভেসি বজায় রাখার ব্যাপারে সুকন্যার মতোই তারও বারোয়ারি আবাসস্থল না-পসন্দ।
লাঞ্চের পর ঘণ্টা দুই বিশ্রাম করে সুকন্যাকে নিয়ে জুবিন বেরিয়ে পড়ল শহর পরিক্রমায়। ট্যাক্সি থেকে না নেমেই তাকে দেখাবে প্যারিসের প্রধান প্রধান দ্রষ্টব্যগুলির মধ্যে কয়েকটি। ফেস্টিভ্যাল শেষ হওয়ার পরে তো হাতে থাকছেই চারদিন।
বাইরে থেকে ল্যুভর মিউজিয়াম দেখার পর ট্যাক্সি যখন আইফেল টাওয়ারের পাশ দিয়ে যাচ্ছে, তখন না নেমে পারল না সুকন্যা, “তুমি তো আইফেল টাওয়ারের ওপরে উঠেছ জুবিন...কেমন দেখায় শহরটাকে?”
“পৃথিবীর উচ্চতম সৌধের চূড়া থেকে যেমন দেখা উচিত, তেমনটাই।”
“আজ যখন সময় আছে হাতে, না উঠে ফিরব না গো...আমার কবেকার স্বপ্ন! এক মুহূর্ত দেরিও আর সহ্য হচ্ছে না...আমি আকাশ ছুঁতে চাই জুবিন এখনই!”
“তা তো তুমি অনেকদিন আগেই ছুঁয়ে ফেলেছ টলিউড-সুন্দরী। বছর কয়েক ধরে তোমার ধারেকাছে আর কোনও সেলেব আছে কি সুকন্যা?” গর্বের সঙ্গে কথাগুলো উচ্চারণ করে জুবিন বলে, “আজ শুধু আকাশ ছুঁয়েই কিন্তু নীচে নেমে আসব আমরা, ভালো করে এনজয় করার জন্যে পরে আইফেল টাওয়ারে কাটাব পুরো একটা বেলা।”
হোটেলে যখন ফিরল জুবিন-সুকন্যা, তখন মধ্য সেপ্টেম্বরের ১২ ঘণ্টা ৩৫ মিনিটের দিন প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে। ডিজিটাল ঘড়িতে সময় ৭ টা বেজে ৫৯। হোটেলের সাত তলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সুকন্যা তার মোবাইল ক্যামেরায় তুলতে থাকে একটার পর একটা ছবি। গোধূলির মায়াবী আলোয় আরও স্বপ্নময় হয়ে উঠেছে তার স্বপ্ন-নগরী।
আগামীকাল ১৬-ই সেপ্টেম্বর। সপ্তাহ-শেষের প্রথম দিন। শনিবার। প্যারিসের খুব কাছের শহর Nogent-Sur-Oise-এ এই দিন বডি পেইন্টিং ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণ করবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা প্রফেশনাল মডেল এবং শিল্পীরা। থাকছে বিশেষ থিম। সঙ্গে চলবে কনসার্টস আর ডান্স পারফরম্যান্সেস। আর দ্বিতীয় দিন মানে ১৭-ই সেপ্টেম্বর, রোববার বিশেষ থিমের উপর বডি-পেইন্টিং প্রতিযোগিতায় ফ্রেঞ্চ টাইটেল পাওয়ার লক্ষ্যে যোগদান করতে পারবেন সেইসব আমন্ত্রিত মানুষ, যাঁদের উদ্যোক্তারা দিয়েছেন ভি.আই.পি পাস।
শনিবার অনুষ্ঠান শুরুর ঘণ্টাখানেক আগেই জুবিন আর সুকন্যা পৌঁছে গেল Nogent-Sur-Oise-এর মনোরম অনুষ্ঠান-স্থল Chateau des Oise -এ। ছিমছাম শহরের এত সুন্দর নয়নাভিরাম পরিবেশ মন কেড়ে নিল সুকন্যার, “সত্যিই...আমি ভাবতেই পারিনি জুবিন, পৃথিবীতে এত সুন্দর জায়গাও আছে...আসলে, ইউটিউবে ভিডিও দেখে বোঝা যায় না স্থান-মাহাত্ম্য...দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়! আজ প্রথম দর্শনেই মন ভরে গিয়েছে আমার জুবিন!”
“অনুষ্ঠান শুরু হলে বুঝবে, ফ্রেঞ্চরা কতখানি আমুদে, মানে জুবিল্যান্ট আর কী!” জুবিন বলে, “তুমি পুরো ক্যাম্পাসটা ঘুরে দেখতে পারো সুকন্যা, আমি তৈরি হই এবার।”
“তোমার মডেলের নাম কী বলেছিলে যেন...সুজান, তাই তো?”
“হ্যাঁ, সুজান। ফ্রেঞ্চ। আরে --- নাম করতে না করতেই এই তো এসে গেছে সুজান,” জুবিন পরিচয় করিয়ে দেয়, “মাই বেটার হাফ সুকন্যা...”
“হাই সুকন্যা,” সুজান হাত বাড়িয়ে দেয়, ফরাসি উচ্চারণে বলে, “হ্যাভ আ নাইস দে।”
প্রত্যুত্তরে সুকন্যা বলে, “বেস্ট উইশেস ফর ইউ সুজান।”
তারপর, জুবিনের উদ্দেশে বলে, “অন্যদিকে ঘুরে দেখতে বলছিলে কেন! আমি এখানেই থাকছি, তোমার পেইন্টিং সামনে থেকে দেখতেই তো এসেছি সাত সাগর পেরিয়ে...না কি! তোমরা শুরু করবে তো এবার?”
“হ্যাঁ, ওই তো অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে...হাতে আছে আর মাত্র দশ মিনিট।”
সুজান স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে এক এক করে তার সব পোশাক খুলে ফেলে সম্পূর্ণ নিরাবরণ হল। বাইশ তেইশ বছরের তন্বী তরুণী সুজান-সুন্দরী, নিরাবরণ হওয়ায় তার সে সৌন্দর্য যেন এক লহমায় শতগুণ বেড়ে গেল! চোখ ফেরাতে পারে না সুকন্যা...নিখুঁত শরীরী গঠন সুজানের, যেখানে যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু দিয়েই সৃষ্টিকর্তা তৈরি করেছেন এই রূপবতী কন্যাকে। ক্ষীণ কটি, গুরু নিতম্ব, পীন পয়োধর। গায়ের রঙ তো নয়, যেন কাঁচা সোনা!
সোনার প্রতিমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে তুলির টান দিতে শুরু করে জুবিন মহাপাত্র। বাহু-যুগল, বক্ষ, নাভিকুণ্ডলী...সর্বত্র সে তুলির সাবলীল চলন... কিন্তু কী আশ্চর্য! বিদ্যুৎ-শিহরন খেলে যেতে থাকে সুকন্যার শরীর জুড়ে। তারপর...দ্রুতলয়ের বাজনার তালে তালে আন্দোলিত হতে হতে একসময় চরম পুলকের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায় সে।
তিন
ফেরার পথে ট্যাক্সির মধ্যে উচ্ছ্বসিত সুকন্যা বলল, “আমার প্যারিসে আসা সার্থক জুবিন। প্রথম দিনের বডি পেইন্টিং ফেস্টিভ্যাল দেখে আমি মুগ্ধ বললে ঠিক বলা হবে না, আমি আসলে অনুভব করেছি, আর্টিস্ট আর মডেল কতখানি নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে...কতখানি প্রফেশনাল অ্যাপ্রোচ ওদের! সুজানকে খুব ভালো লেগেছে আমার, ওর কোনও জবাব নেই...অপরিসীম ধৈর্যের প্রতিমূর্তি যেন! দারুণ সাপোর্টিভ!”
“আর কিছু?”
“হ্যাঁ, তোমার জন্যে আছে চমক।”
“চমক! মানে?”
“মানে এমন কিছু, যা শুনে চমকে উঠবে তুমি আর সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য।”
“কী হেঁয়ালি শুরু করলে বলো তো!”
“হেঁয়ালি নয় জুবিন,” সুকন্যার চোখেমুখে কৌতুক, “জানো তো --- সবুরে মেওয়া ফলে।”
ডিনারের শেষে ডেজার্ট। খাওয়া শেষ করে জুবিন বলে ওঠে, “এবার নিশ্চয়ই মেওয়া ফলবে?”
“ফলবে। তবে, তোমার সহ্য হবে কিনা ভাবছি।”
“বলেই দেখো না!”
“আমি আগামীকালের ফেস্টিভ্যালে ফ্রেঞ্চ টাইটেলের জন্যে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছি, আমার বডি-পেইন্টিং করবে তুমি জুবিন।”
“তুমি ভেবেচিন্তে বলছ তো সুকন্যা!” উত্তেজনা-মিশ্রিত বিস্ময় প্রকাশ করে জুবিন, “রিপারকেশন কী হবে, সে সম্পর্কে কোনও ধারণা আছে তোমার?”
“বিলক্ষণ আছে।” সুকন্যা নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দেয়, “আমার ফ্যান ফলোয়ারের সংখ্যা এক লাফে কয়েকগুণ বেড়ে যাবে।”
“আর আমার-তোমার বাড়িতে এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে? --- সেটা মাথায় নেই!”
“দেখো জুবিন, তুমি যে কাজটা করে চলেছ...ইউটিউবে সবাই দেখেছে এবং দেখছে, তাতে কারো কোনও আপত্তি নেই...আরে...আপত্তি বলছি কেন! লোকে ভূয়সী প্রশংসা করছে তোমায়, তুমি অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছ, মিডিয়া তোল্লাই দিচ্ছে...কিন্তু আমি যদি মডেল হয়ে দাঁড়াই, তবে নিন্দার ঝড় বয়ে যাবে...আমি মেয়ে বলে? আসলে কী জানো তো জুবিন, মুখেই আমরা নারীপুরুষে ভেদাভেদ করি না...আমরা নাকি ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলির সময়কার সামাজিক পরিস্থিতির বাইরে বেরিয়ে আসতে পেরেছি এখন, সত্যিই কি পেরেছি? আমার মনে হয়, আপাত দৃষ্টিতে...হ্যাঁ, অনেক এগিয়েছি আমরা...এই যে আমি সিনেমা জগতে চুটিয়ে অভিনয় করছি, মডেলিং করছি...সমাজের সর্বক্ষেত্রে পুরুষদের পাশাপাশি মেয়েরাও আছে...পরিবর্তন না হলে এসব সম্ভব হত না। কিন্তু গভীরে প্রবেশ করলে বোঝা যায় যে, দেড়শো বছর পরেও মাঝেমধ্যেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে পুরুষতন্ত্রের ঘুমিয়ে থাকা দৈত্যটা।”
“একদম ঠিক কথা বলেছ তুমি সুকন্যা,” মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে ওঠে জুবিন, “এটুকু আশ্বাস দিতে পারি আমি তোমাকে যে, আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে না ওই দৈত্য। আমি শুধু বলেছি, তুমি সামলাতে পারবে তো...ফ্রেঞ্চ টাইটেলের প্রতিযোগিতায় তুমি বিনা দ্বিধায় অংশগ্রহণ করতে পারো, আমার দিক থেকে কোনওরকম আপত্তি নেই...মানে একেবারে মুক্তমনা আমি...নিশ্চিন্তে...”
“ব্যস ব্যস, আমি জবাব পেয়ে গেছি। অন্য কাউকে নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই।” বলতে বলতে সুকন্যা উঠে দাঁড়ায়, তার ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি, “এখন একবার ট্রায়াল হয়ে যাক তাহলে।”
“মানে?”
“মানে --- তুমি রঙ-তুলি বের করো শিগগির।” বলেই সম্পূর্ণ নিরাবরণ হয়ে সুকন্যা অপরূপ ভঙ্গিমায় জুবিনের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল, “আজ যখন তুমি সুজানের উন্মুক্ত শরীরে তুলির ছোঁয়ায় ফুটিয়ে তুলছিলে একের পর এক নকশা, তখন তা দেখেই পুলক-শিহরনে আমার সারা শরীর হয়ে উঠছিল রোমাঞ্চিত...আর তুমি যদি আমার শরীরে তুলি বোলাও...ইশ...! তবে না জানি কী হবে...বুঝতে পারছ জুবিন?”
জুবিনের মুখে কথা ফোটে না, সে অপার বিস্ময়ে চেয়ে থাকে এতদিনেও না চেনা দোসরের চোখের দিকে।
“কী হল জুবিন? --- তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?”
“না, শরীর আমার ঠিকই আছে। অবাক হচ্ছি একথা ভেবে --- তুমি আমায় অন্ধকারে রেখে ফ্রেঞ্চ টাইটেলের প্রতিযোগিতায় অংশ নেবার জন্যে ভি.আই.পি পাস...আমি নিজেই দিতাম তোমায়!
“আমি দেখছিলাম...” সুকন্যার ঠোঁটে ব্যঙ্গের সূক্ষ্ম রেখা, “আসলে কী জানো তো জুবিন, তোমরা --- পুরুষ মানুষেরা মুখে যতই আধুনিকতার বড়াই করো না কেন, ভিতরে ভিতরে তোমরা রক্ষণশীল, স্ত্রীকে নিজের সম্পত্তি মনে করো...কী? --- ভুল বললাম?”
জুবিন জবাবে কিছু বলার চেষ্টা করতেই সুকন্যা তাকে থামিয়ে দিয়ে হেসে বলে ওঠে, “চাপ নিয়ো না একদম জুবিন...রিল্যাক্স, পরীক্ষা করছিলাম তোমায়, শুনতে চাইছিলাম --- কী বলো তুমি। আমি অত মানুষের চোখের সামনে নিরাবরণ হয়ে দাঁড়াতে চাই-ই না...আপত্তি আছে আমার, আমি নিজে এই ব্যাপারে পুরোপুরি সনাতনপন্থী। একজন মনীষী বলেছিলেন না --- প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য ভাবধারা কোনওদিন মিলতে পারে না...আমি মনে করি, কথাটা চরম সত্যি।”
“তাহলে আমাদের দেশের খাজুরাহো আর কোনারকের মিথুন মূর্তিগুলো কি সমকালীন সমাজের প্রতিফলন নয়?”
“যেটুকু জেনেছি, নয়।” জবাবে সুকন্যা বলে, “এ বিষয়ে কিছু পড়াশোনা আছে আমার, নির্মাণের পিছনে ছিল অন্য অনেক কারণ। অবশ্য, মতভেদও আছে গবেষকদের মধ্যে।”
“বেশ, অতঃকিম?” জুবিন উঠে দাঁড়িয়ে স্পর্শ করে সুকন্যাকে।
“তুমি কি ভুলে গেলে যে, আমরা এসেছি সেকেন্ড হানিমুনে?”
“না, ভুলিনি... ভুলতে পারি কখনও?” বলতে বলতে জুবিন তার দু-হাতের দশ আঙুলের তুলি বুলিয়ে চলে নিরাবরণ সুকন্যার শরীরের প্রতিটি অন্ধিসন্ধিতে।
…………..
অলঙ্করণঃ- সায়ন্ন্যা দাশদত্ত
No comments:
Post a Comment