প্রবন্ধঃ ছয়-এ ঋতুঃ মণিশংকর বিশ্বাস

 ছয়-এ ঋতু


মণিশংকর বিশ্বাস



          ~বিরামহীন~

তোমার চলে যাওয়া কিছুতেই শেষ হচ্ছে না!

মন থেকে গান ছড়াতে ছড়াতে

গান থেকে মন ছড়াতে ছড়াতে

তুমি যাচ্ছ আর যাচ্ছ

অথবা

   ~খেই~

ফুল দিতে পারিনি

হলুদ ফুল…

আসলে ফুলের আশেপাশে

এমন সব অনুভূতি আছে,

যার এখনও শব্দ তৈরি হয়নি

এমন সব আশ্চর্য দৈব উচ্চারণে, ঋপণ আর্যর এই বইটি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে সেই দিনগুলিতে যখন লাস্ট-ট্রেন মাথার ভিতর গুনগুন করে উঠছে:

"প্রতিদিন তোমাকে হাতের মুঠো থেকে বের করে দিই

অন্য অনেক তারার মত আমিও জেনেছি

এ-পথ আমার, একার—

একা একাই বাড়ি ফিরে যাব রাত বারোটা পাঁচের বনগাঁ লোকাল ধরে…" 

হ্যাঁ, আমার ওই সময়কার মানসিক অবস্থা বর্ণনা করতে আমারই লেখা এই পঙক্তিগুলি উল্লেখ করতে হল এই কারণে যে, যখন আকাশভরা বনগাঁ লোকাল, বিশ্বভরা বিনয় মজুমদার আর চাঁদপাড়ার রোগা মেয়েটি...সেই দিনগুলিতে ঋপণ আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে এই দুই মলাটে ধরা টাইম-ক্যাপসুলে করে। কী বলি এসব কবিতা পড়ে! শুধু বলি, ঋপণের কবিতা, "তোমার বয়েস আমি ভালোবাসি"। কবিকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই।

 ~ভালোবাসা~

তুমি…আমি 

কেউ ভালো নেই 

ভালোবাসা নিয়ে গেছে সব 

বইয়ের নাম: নির্বাচিত শূন্য

প্রকাশক: সুতরাং


****


“...ছদ্মকবিতার এমন কোনও দুর্বলতা নেই। বরং কীভাবে লিখলে মহৎ চালাকি লুকিয়ে রাখা যায় তা কবি ভালোই জানেন। এমন কবিতা যা ভালো নয় আবার দুর্বলও নয়। যাকে গ্রহণ না করলেও অস্বীকার করা যায় না। এমন কবিতার সামনে দাঁড়ালে নিজের পাঠক সত্তা নিয়েই সন্দেহ জাগে। মনে হয় কবি অনেক পথ পেরিয়ে পৌঁছেছেন, আমারই কেবল দেরি হয়ে যায়। আসলে কলাকৌশলে কোথাও ফাঁক নেই। কীভাবে বললে কতগুলি শব্দ কবিতার মতো হয়ে ওঠে এই বিদ্যা তারা আগেই রপ্ত করে নেন। দীক্ষিত পাঠক কিংবা সম্পাদক সংশয়ে পড়েন। নিজের বোধের পরিসীমা লঙ্ঘন করে পত্রিকায় প্রকাশ করেন। ‘কবিতা’ পত্রিকা থেকে ‘রক্তমাংস’ সব পত্রিকায় কম বেশি ছদ্মকবিতা ছাপা হয়েছে এই সংশয় নিয়ে। আজও ফেসবুক, ওয়েব ম্যাগাজিন থেকে মুদ্রিত পত্রিকা সর্বত্র ছদ্ম কবিতার দাপট। ভণ্ড, মেধাহীন যশোপ্রার্থীর দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা। আর অস্তিত্বের মায়াক্রন্দন।” দুর্ভাগ্যক্রমে উপরের এই কথাগুলি স্পষ্ট করে বলার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। অথচ কী আশ্চর্য এই জরুরি কথাগুলি কোনও অশীতিপর বৃদ্ধ কবি বলছেন না। এমনকি মাঝবয়সী কোনও ‘মহাকাল’-এর কবিও নয়, বলছেন অপেক্ষাকৃত তরুণ এক কবি, পঙ্কজ চক্রবর্তী। ফলে পঙ্কজের কবিতাও ছদ্মকবিতা বা ‘কবিতার-মতো’ ইত্যাদি থেকে দূরে এক আশ্চর্য রেইনফরেস্ট। পঙ্কজের কবিতা-ভুবনের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে আমি ধন্য হয়েছি। পঙ্কজের নতুন বই ‘উদাসীন পাঠকের ঘর’। আশ্চর্য সব কবিতা এ বইয়ের পাতায় পাতায়। দু একটি পঙক্তি নয়, আমি তিনটি সম্পূর্ণ কবিতা এখানে পাঠকদের পড়তে দিলাম। এ বই সমালোচনার ঊর্ধ্বে। 

    ~সকাল-বিকেল~

এমন সামান্য জীবন আমার 

স্লেজগাড়ির মালিক হব না কোনওদিন

গানের ভিতর হয়তো

দেখব না মৃদু হাওয়া কথার সম্মান

উপত্যকার অন্ধকারে অন্ধ পাখিটির স্বেচ্ছা অবসর

ধূ-ধূ এক বিরহের পথে বেয়ে বেড়াব সকালের বাজার

অফিস ফেরত আপেলের স্বাস্থ্য বিচার

আস্তাকুঁড়ের উনুন আমায় ফিরিয়ে আনে ঘরে

কথার ভিতর যদি ছবি ফুটে নাই ওঠে

আমাকে কী দোষ দেবে তুমি?

সামান্য জীবনের মুদ্রাদোষ কুয়াশা জটিল

অসম্মানের ভিতর বয়ে বেড়াই কিছু সুসংবাদ


~শোকগাথা~

আমার মৃত্যুর পর স্মরণসভা হোক আমি চাই না। আমি জানি যেকোনও শোকসভা দুঃখের জাল বিছিয়ে গোপনে লাভ-ক্ষতির হিসেবসন্ধানী। তাই মঞ্চের পাশে চা আর ধূমপান অধিক মনোহর। তবুও আমি বুঝি আমার মৃত্যু স্তব্ধ করে দেবে সন্তান আর স্ত্রীকে সাময়িক। মা বেঁচে থাকলে হয়তো-বা পাগল হয়ে যাবে। কিছু ছাত্র-ছাত্রী, চায়ের দোকানে দু-চারজন চেনা খরিদ্দার, দু-একজন কবি আর অস্পষ্ট কিছু মানুষের চোখের জলে আমার কবিতা লেখা থাকবে। এইমাত্র আর কিছু নয়। 

মৃত্যুতে তেমন কিছু যায় আসে না আমাদের। প্রতিবেশী মৃত্যুর বিষণ্ণ ছায়া ভাতের থালায় কতটুকু পড়ে!

         ~দুরালাপ~

দুরের মাধুর্য তোমার বশ্যতা চাই

আমাকে ছিটকে ফেলো সংসার থেকে

সামান্য চায়ের দোকানের ফুটন্ত জলে মুখ দেখতে চাই

ভেঙে পড়া জানালার কাছে

এই তো সেদিন আমি কুয়াশা চোখে দাঁড়িয়ে ছিলাম

বিষণ্ণ ভাতের থালা আমাকে ঘরের দিকে টানে

তোমার চোখের সামনে বার বার দেখাব জুতোর বিদ্রোহ

বন্য বন্ধু এসে গল্প শোনায়

ছেঁড়া মানিব্যাগ দিয়ে আমি প্রতিরোধ করি

স্টেশনমাস্টারের বিধবা বউয়ের হাসি আজও ছুঁয়ে আছে

আর কী কী চাই সত্বর জানাও

এমন সব অনন্যসাধারণ কবিতা এ বইয়ের পাতায় পাতায়। কিন্তু আরও কবিতা এখানে উদ্ধৃত করলে সে তো প্রকাশকের উপর অবিচার করা হয়। শুধু বলি পঙ্কজের কবিতার শরীরে প্রবল উচ্ছ্বাসময় অক্সিজেন সমৃদ্ধ লোহিত কণিকাগুলি কী যে শান্ত একটি নদীর মতো বয়ে যায়, যেন আবহমান বাংলা কবিতায় বিকেলের ছায়া এসে পড়েছে। এইসব কবিতা পড়বার পর সন্দেহ থাকে না, মিনিমাল কবিতার এক যুগপুরুষের আবির্ভাব হয়েছে বাংলা-কবিতায়। 

বই: উদাসীন পাঠকের ঘর

প্রকাশক: তবুও প্রয়াস


***


"...‘শাওন রাতে যদি / স্মরণে আসে মোরে’ এটা বাঙালির র-নার্ভ (Raw Nerve)-কে দারুণভাবে টাচ্ করবে। এটা আমি বিদেশেও দেখেছি, বাঙালি অনেকেই বলে উঠেছে, “ও গান শুনিয়ো না।” প্রত্যেক জাতিরই এমন একটা র-নার্ভ থাকে। ... ‘শাওন রাতে যদি / স্মরণে আসে মোরে’ -- এটা গাইলে বাঙালির মনোজগতে (Psyche)- এর প্রতিক্রিয়ার কথা যদি ভাবেন তাহলে ইউ আর থিংকিং ইন টার্মস অফ ফর্ম, নট ইন টার্মস অফ কনটেন্ট। কনটেন্ট। কনটেন্ট-ওয়াইজ এ জিনিসটা অত্যন্ত বাজে-- রাবিশ।... ‘র নার্ভ’ বলতে আমি যা বোঝাতে চেয়েছি সেটা বিরাট একটা অ্যাসোসিয়েশনাল ব্যাপার। প্রথমত বর্ষার গান, আর একটা মধ্যযুগের কবিতা। আমাদের ভিতরে পদাবলী, রাধার অভিসার, যমুনা নদী-- এই ডার্ক ফোর্সেস (Dark Forces)-গুলো কাজ করে"। 

(সাক্ষাৎকার: উৎপল কুমার বসু/ যোগসূত্র / কলকাতা / ১৯৯৪) 

কল্পর্ষির কবিতা আমরা কেমনভাবে পড়ব, এমনকি কেমনভাবে গ্রহণ করব, সে সব অনেক কিছুর সঙ্গেই উপরের এই কথাগুলি সম্পৃক্ত। কল্পর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় সো কল্ড আধুনিক বাংলা কবিতার কেউ নন। আজকের নব্বই, শূন্য ইত্যাদি দশক-বিভক্ত বাংলা কবিতাও কল্পর্ষির কবিতাকে তেমন চেনে না। রাস্তাঘাটে, অর্থাৎ লিটলম্যাগাজিনের বাসস্টপ বা ফেরিঘাটে যে কখনোই দেখা হয়নি, তা হয়ত নয়, কিন্তু কল্পর্ষির কবিতার কৌলীন্যই হোক বা মেইনস্ট্রিম বাংলা কবিতার মূলত আদিখ্যেতাই হোক, খুব আলাপ-পরিচয় আড্ডা, বসন্তকেবিন ইত্যাদি যে হয়েছে এমনও নয়। তবে আমি এর জন্য মূলত কল্পর্ষি বা কল্পর্ষির কবিতা-ভাষাকেই দায়ী করব। এ বছর ২১-শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে কল্পর্ষির ফেসবুকে লেখা স্ট্যাটাসটি শুরুতেই ছিলেন মৃদুল দাশগুপ্ত, “তার পূর্ব-পুরুষরা স্বপ্নাদেশে লিখেছিলেন মঙ্গলকাব্য...” শুধুই কাকতালীয়? আমার মনে হয় না। বস্তুত কল্পর্ষির কবিতাভাষা কোনওদিন এই স্বপ্নাদেশের কথা ভোলেনি। তাই অত্যল্প লিখেও কল্পর্ষি যে এত উল্লেখযোগ্য কবি, তা শুধু এই কারণে নয় যে কল্পর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় একজন অসাধারণ কবি, বরং একবিংশ শতকের বাংলা কবিতায়, কল্পর্ষিই সম্ভবত একমাত্র দশকহীন কবি। বস্তুত কল্পর্ষির কবিতা, বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো চাকা’ এবং উৎপল কুমার বসুর ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’-র সমসাময়িক, অভিজাত। 

মূলত দুটি কারণে এসব কথা। ১. ভাষালিপি কল্পর্ষির একটি বই পুনর্মুদ্রণ করেছে, সঙ্গে অবশ্য ৬-টি নতুন কবিতা সংযোজিত (এটিও একটি প্রাপ্তি) হয়েছে। ২. মূল কারণ। আর তা হল, কল্পর্ষির কবিতাভাষা মূলত এক ধরণের আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধাস্ত্র। একটি প্রতিরোধ। ফেক কালচারে অভ্যস্ত এবং ওই একই যৌনতা থেকে উদ্ভূত বা সংশ্লেষিত ছদ্মকবিতার বিরুদ্ধে। কল্পর্ষি, ছদ্মকবিতার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে একজন গুরুত্বপূর্ণ কমরেড বা গেরিলা যোদ্ধা। কল্পর্ষির কবিতা, আমাদের 'র-নার্ভ'-কে টাচ করে। টোকা দেয়। 

বই: ব্যথা নিরোধক চাঁদ

প্রকাশক: ভাষালিপি


***


তখন মাঝরাত, আমার হিসি পায় খুব। ঘুমের ভিতর তোমার নীরব মুখ,

যেন বাতাবির বন-- ঘন ছায়া-- পোষা বিড়ালের ওম-- কৃষিকথার আসর,

প্রবচন ও অশ্রুর শেষে ধূসর নীলাভ এক তারা...

ঠাকুর্দা, তোমার নামের উপর চন্দ্রবিন্দু আমার ভালো লাগে না...

তুমি, বিষুবরেখার মতো গোল-- আমাকে জড়িয়ে আছো, চারপাশ থেকে।

(উৎসর্গ কবিতা / ভ্যান গঘের প্রিয় রঙ/ কুণাল বিশ্বাস)

খুব বেশি বই আমি পড়িনি। বৈধব্যের এই শাদা চিরখণ্ডটিতে শব্দঅক্ষরের মালিন্য নেই বললেই চলে। তবু শেষ খেয়াটিতে যাত্রা করবার সময় যেটুকু উজ্জ্বল কাদা, বাংলাভাষার মাটি আমার পিরানখানিতে লেগে থাকবে তার কিছুটা নিশ্চয়ই "ভ্যান গঘের প্রিয় রঙ"। অথচ এই বই নিয়ে লিখতে গেলে আমার কুণ্ঠা হয়। কেননা নিজের কানেই তাকে আত্মপ্রশংসা বলে মনে হয়। অবশ্য একথাও আমার মনে পড়ে, কেউ কেউ এই সময়ে দাঁড়িয়ে, অথরলেস বইয়ের প্রস্তাবনা করেছেন। আর এই সময়েই বা বলি কেন, সাহিত্যের আদিকাল থেকেই অ্যানোনিমাস সাহিত্যের চল রয়েছে। এবং সাহিত্যের এই শাখাটি যথেষ্ট শক্তিশালীও বটে। তাই লেখকের নাম, ভালো একটি বইয়ের ক্ষেত্রে, আমরা যতটা ভাবি, ততটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ত নয়। তবে এই বইটি তো আর অথরলেস নয় আর এমনও নয় যে লেখককে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। তাই এই বই নিয়ে আমি বিশেষ কিছু বলব না, শুধু পড়তে বলা ছাড়া। কেননা তবেই পাঠক হিসেবে আমি একটি আত্মপ্রশংসার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারব। তো তথাকথিত বাংলা কবিতার নিরিখে এই বইটি ঠিক কী কারণে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা বলবার আগে আমি একটা অবজার্ভেশনের কথা বলি। বাংলা কবিতায় তরুণ কবিদের প্রভাবিত করবার ক্ষেত্রে মণীন্দ্র গুপ্ত, মৃত্যু-পরবর্তীকালে একটু বেশি মাত্রায় সক্রিয় হয়েছেন। অর্থাৎ গদ্য = ন্যারেটিভ এবং কবিতা = অ্যান্টি-ন্যারেটিভ, এই সমীকরণের সীমারেখাকে, আজকের বহু তরুণ কবিই ধূসর থেকে ধূসরতর করতে সচেষ্ট হয়েছেন। কুণালের এই কবিতাগুলিও ছোট ছোট সন্দর্ভের আকারের লেখা। তবে একটি পার্থক্য চোখে পড়ে। লেখাগুলির মজ্জাস্রোতে লেগে আছে অ্যান্টি-ন্যারেটিভের রক্ত। একটা উদাহরণ দেব। এই বইয়ের প্রতিটি কবিতাই ভ্যান গঘের এক একটি ছবির বঙ্গানুবাদ। ৪ নম্বর কবিতাটি যেমন ভ্যান গঘের ছবি ‘পটেটো ইটার্স’। কবিতাটির শেষের দিকে আমরা পড়ি, "নিভু নিভু আলোয় সন্তপ্ত চাষি পরিবার। সকলের চোখে ঘুম, থালায় আলুসেদ্ধ মাখা ভাত। এর পর আলো নিভে যায়। অন্ধকার। কিছু দূরে, হয়তো জানালার বাইরে,” একটি মাদী বিড়াল আলস্য ভাঙে-- আততায়ী পা ফেলে এগোয়, নিজের ছায়ার দিকে... "যে কথা কুণাল লেখেন না, ছেড়ে রেখে দেন, পাঠককে দিয়ে লেখান, তা হল-- সেদ্ধ-আলু যায় অন্যদিকে, তার গতি অন্যত্র। অন্য কোনও আঁধারে জমে ওঠে তার খেলা, অন্য কোনও আলোয় তার রূপান্তর, যন্ত্রণা এককে...। সেদ্ধ আলুর সমান্তরালে কুণাল খুব সচেতন ভাবেই একটি মাদী বিড়ালকে নিয়ে আসেন আর প্রকৃত শিল্পীর মতই আমাদের নিয়ে যান আউট অব দ্য স্ক্যয়ার। বস্তুত, ছবিটির ফ্রেমের বাইরে আছড়ে ফেলেন তার পাঠককে। আর আমরা ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠি, লিখতে বসি, চেষ্টা করি। এভাবেই এই বই আরও বহু কবিতার মাতৃভূমি।

বই: ভ্যান গঘের প্রিয় রঙ/ কুণাল বিশ্বাস

প্রকাশক: ভাষালিপি 


****


"অনেক দূর থেকে পাহাড় দেখলে, তাকে খুব একটা উঁচু ব'লে মনে হয় না... অথবা পায়ের পাতায় নোনা জলের ছোঁয়াচ পেলে সমুদ্রের নীল তার্কিকভাবে বুঝে নেওয়া যায় না...

ঠিক একই ভাবে, চুল আঁচড়ানোর সময় তোমার প্রতিকৃতিকে তুমি দ্যাখো... "(কাব্যতত্ত্ব)

ভেবে দেখলে আমাদের জেনারেশানের সকলের কাব্যতত্ত্বই এই। অন্তত লক্ষ্যের দিক থেকে। অমিতাভ মুখোপাধ্যায় অমিতাভ-কবিতা লেখেন না। বরং তার কবিতা কুয়াশাচ্ছন্ন, সংকেতময়, বহুদূর থেকে ভেসে আসা সমুদ্রের ভিজে বাতাসে জানালার পর্দার ইতস্তত রঙিন ওড়াউড়ি, কখনো-বা পাহাড়ের বাঁকে নরম রোদ্দুরের ল্যান্ডস্কেপ! তাই বলে অমিতাভ-র কবিতার সংকেতময়তা পাঠককে দূরে সরিয়ে রাখে না, বরং কবিতার যে গন্তব্যে পৌঁছে পাঠকও স্বয়ং কবি হয়ে ওঠেন, সেখানে অমিতাভ তাঁর পাঠককে নিয়ে চলেন খুব অনায়াসে। “যদি যাই, যাবার মতো করেই তো যেতে হবে! সেই সব পোশাক, মুকুট, আঠা, গালা আর মোম কোন্ গুমটির কোনে প'ড়ে আছে! 

তারাও কী ব্যাপারটা এ'ভাবেই ভাবছে...?”

অমিতাভ তাই দুর্দান্ত কবিতা লেখেন, এটা বলার থেকে, বলা ভালো, অমিতাভ অত্যন্ত কনভিন্সিং কবিতা লেখেন। “অন্য লোকের চশমা প'রে এই জগৎটাকে কেমন লাগে” সেটা অমিতাভ খুব কনভিন্সিংলি পরিবেশন করেন। এই তো কবির কাজ। সত্যি বলতে কী, অমিতাভ সেই কবিতা লেখেন, যে কবিতায় আমরা বিশ্বাস করি। “যার ব্যর্থতার সংজ্ঞাটি, ঠিক আমারই মতো আনন্দে কেঁপে কেঁপে ওঠে...”। বাংলা কবিতার পাঠক হিসেবে, অমিতাভকে তাই অভিবাদন, অমিতাভর কবিতা-সফলতার জন্য।

বই: গোয়েন্দার আকাশ / অমিতাভ মুখোপাধ্যায়

প্রকাশক: ভাষালিপি 


****


শুরু করি একটা গল্প দিয়ে। ‘গল্প’, কেননা সূত্র মনে নেই। গটফ্রিড বেনকে নাকি একটা রেডিও ইনটারভিতে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কাকে বলে জ্ঞানতত্ত্ব? বেন: (ওহে বালক!) তুমি কী মনে করো না, আমার প্রতিটি চিত্রকল্পই এক একটি জ্ঞানতত্ত্ব!

এই গল্পটা করলাম, এটা বলবার জন্য যে, শুধু সমিধের নাম নয়, সমিধের কবিতাও সমিধবরণ। যেন যজ্ঞের আগুন থেকে আবির্ভূত, শুদ্ধতম। ওঁর ইমেজারিগুলির মধ্যে দিয়ে যজ্ঞের পুরোহিতের মতোই, সমিধ এক অত্যাশ্চর্যকে চাক্ষুষ করান আমাদের। যজ্ঞের আগুন কী তখনও ধিকিধিকি জ্বলছে? আমার মনে পড়ে যায়, ব্যোদলেয়ার কথিত তিনজন সম্মানিত অস্তিত্বের দুজন, প্রিস্ট (টু নো) এবং কবি (টু ক্রিয়েট)। সমিধও কবিতা লেখেন না, কবিতা সৃষ্টি করেন। 

“এমনই কেটেছে বেলা বাতাবি বাগানে

এজন্মে লেবুর গন্ধ, পারিজাত মৃদু মৃদু হাসে

এজন্মে চৌখোপ জামা, কুমারী জীবনে

জামায় কুটির আঁকা আছে

আঁকা আছে বনবাস, গভীর বনানী

সারাদিন গুটিসুটি বসে থাকে বাঘ

কুটিরের ছিটেবেড়া, দেয়ালের ঘন কালো মণির কর্ণিকা

হলুদ ডোরার নীচে শিকারির ক্ষুধা

মাঝে মাঝে গ্রাস করে বাতাবি বাগান”

এই জগতে কবি যে আমাকে ভালোবেসে প্রবেশাধিকার দিচ্ছে, আমার অভিভূত লাগে। 

বই: ওড়ো দেবযান / সমিধবরণ জানা

প্রকাশক: আদম 


………………………                          


No comments:

Post a Comment