গল্পঃ আক্ষেপঃ দেবারতি ভৌমিক





আজকে দেবযানী আর সৌভিকের একমাত্র ছেলে ঋভুর স্কুলে প্যারেন্ট টিচার্স মিটিং আছে৷ শনিবার দেবযানীর অফিসে ছুটি থাকলেও সৌভিকের ছুটি থাকে না কিন্তু প্যারেন্ট টিচার মিটিং থাকার জন্যে সৌভিক আজকে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। ন’টার মধ্যে ব্রেকফাস্ট করে ওরা তিনজন গাড়ি করে বেরিয়ে পড়ল ঋভুর স্কুলের দিকে৷ স্কুলে পৌঁছে ওরা গেল ক্লাস টিচার নবনীতা ম্যাডামের ক্লাসের দিকে৷ নবনীতা ম্যাডাম ঋভুর ক্লাস টিচার৷ ঋভু সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে৷ ম্যাডাম ঋভুর পড়াশোনা নিয়ে খুব একটা খুশি নন৷ উনি বার বার করে সৌভিক আর দেবযানীকে বললেন যেন ঋভুর দিকে ওরা ভালো করে খেয়াল রাখে কারণ ঋভু নাকি পড়াশোনায় খুবই অমনোযোগী আর তাই রেজাল্ট নাকি সে রকম ভালো হয় না৷ এরকম চলতে থাকলে স্কুল থেকে ওকে আবার এই ক্লাসেই রেখে দেওয়া হবে। দেবযানীর খুব মন খারাপ হয়ে যায় এ কথা শুনে৷ ছেলের জন্য এবার ভাল প্রাইভেট টিউটর রাখতে হবে ভাবল ও।

ম্যাডাম বললেন “আপনারা হয়ত দুজনেই চাকরি করেন বলে সেভাবে কিংশুকের দিকে নজর দিতে পারেন না৷ কিন্তু ও তো এরপরে আর উঁচু ক্লাসের পড়া পারবে না, তখন খুবই মুশকিলে পড়বেন আপনারা। ইংরেজিতে ও খুবই কমজোর, এবারে খুব লুজ করে খাতা দেখেও আমি ওকে সি প্লাসের বেশি দিতে পারিনি।”

“সি প্লাস?” আঁতকে উঠল দেবযানী।

“আপনি দেখুন আনসার শিট, নম্বর দেওয়ার কোনও জায়গা নেই। দরকার হলে আপনি ওকে আমার টিউশনে ভর্তি করে দিতে পারেন আমি লক্ষ্য রাখব যে ওর রেজাল্ট যেন নেক্সট টাইম থেকে খুব ভালো হয়৷”

এই শুনে দেবযানীরা দুজনই খুব খুশি হয়৷ সৌভিক এও ভাবে অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি এসে ছেলের পড়াশোনার পেছনে সময় দেবে৷ পরের দিন থেকেই দেবযানী ঋভুকে নবনীতা ম্যাডামের ক্লাসে ভর্তি করে দিল৷ যেহেতু ঋভু পড়াশোনায় খুবই দুর্বল তাই ম্যাডাম দেবযানীকে বললেন যে ওর জন্য স্পেশাল ক্লাস নেবে ওদের বাড়িতে গিয়ে৷

কিছুদিন পরে....


নবনীতা ম্যাডাম পড়ানো শুরু করেছেন সপ্তাহ দুয়েক হল। এখন সৌভিকও মাঝে মাঝে এসে ঋভুর পড়াশোনা নিয়ে বসে। সৌভিকের খুব ইচ্ছা ঋভু বিদেশে যাবে স্কলারশিপ নিয়ে। এখন থেকে একটু একটু করে চেষ্টা করলে নিশ্চয় ওর স্বপ্ন পূর্ণ হবে। দেবযানী যদিও কিংশুকের পড়াশোনায় ভাল হওয়া নিয়ে চিন্তিত, তবে ওর বেশি কিছু চাহিদা নেই, শুধু লেখাপড়া করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারলেই হলো।

আজ অফিস থেকে বেরিয়ে দেবযানী ভাবল ঋভুর জন্য কিছু ইংরেজি গল্পের বই নিয়ে যাবে। এগুলো পড়লে ঋভুর ইংরেজির বেসটা আরও মজবুত হবে। বাড়ি ফিরে দেখল বাড়ি অন্ধকার এবং অন্ধকারের মধ্যেই ঋভু চুপচাপ বসে আছে৷ চিন্তিত মুখে দেবযানী ঋভুকে জিজ্ঞাসা করে ওর কী হয়েছে কিন্তু সে কোনও উত্তর দেয় না, চুপ করে বসে থাকে৷ দেবযানী ঋভুর মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে আদর করে। ঋভু মাকে জড়িয়ে চুপ করে বসে থাকে কোনও উত্তর দেয় না। 

রাতে ৮:৩০ নাগাদ নবনীতা ম্যাডাম দেবযানীকে ফোন করে৷ হ্যালো বলতেই, ওপাশ থেকে ম্যাডাম বললেন “আজকে কিংশুককে আমি গ্রামার বই থেকে কয়েকটা প্রশ্নোত্তর লিখতে দিয়েছিলাম। কিন্তু ও সেগুলো ঠিক করে লিখতে পারেনি। খুবই অমনোযোগী ছিল, আমি আসলে একটু অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিলাম, আমি ওকে খুব বকাবকি করি। মিসেস সরকার, আসলে আমি না ওকে স্কেল দিয়ে হাতের উপরে মেরেওছিলাম। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।”

“ওহ্ তাই নাকি! আমার মনে হয় সেই কারণে বোধহয় ও চুপ করে বসে আছে। না না আপনি যা করেছেন ওর ভালর জন্যই করেছেন।”

দেবযানী অধৈর্য হয়ে পড়ে নবনীতা ম্যাডামের কথা শুনে। সৌভিক অফিস থেকে বাড়ি এলে ও সৌভিককে পুরো ঘটনাটা বলে। তারপর ওরা স্বামী স্ত্রী আলোচনা করে যে এভাবে আর হচ্ছে না, পড়াশোনায় কোনও মন দিচ্ছে না ঋভু৷ আজ সে টিউটরের কাছে মার খেয়েছে, এরকম করলে রেজাল্ট এবারও খারাপ হবে৷ শুধু তাই নয় সোনালী যে কথা পি টি এম এ বলেছিলেন, সেটাই সত্যি হবে। বছর নষ্ট হলে ঋভুর কী হবে এই আশঙ্কায় দেবযানী খুব রেগে যায় ঋভুর উপরে। ঘটনাটা শুনে সৌভিকও মেজাজ হারিয়ে ফেলে ঋভুকে মারে। সে বলে দেয় এবার স্কুলের পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো না হলে সে কিন্তু তার সমস্ত গল্পের বই আর খেলার সরঞ্জামগুলো ফেলে দেবে৷ আশ্চর্য ভাবে মার খেয়েও খুবই শান্ত ছিল ঋভু। সৌভিক অবাক হলেও রাগের মাথায় ওর এই মনোভাবকে বয়ঃসন্ধির অভিব্যক্তি ভেবে এড়িয়ে গিয়েছিল।



ঋভুর আজকাল খুব মন খারাপ থাকে সব সময়৷ বহু চেষ্টা করেও ও একটা কথা তার মাকে কিছুতেই বলতে পারেনি কেন তার নবনীতা ম্যাডামের কাছে পড়তে একটুও ভালো লাগে না ৷ ও জানে মা কোনওদিন ওর কথা বিশ্বাস করবে না। মাঝে মাঝে ভাবে যদি ওর কথাগুলো ও কাউকে বলতে পারত, তাহলে বোধহয় খুব ভাল হতো। সপ্তাহে যে তিনদিন ম্যাডাম আসে সেই দিনগুলোতে যেন নিজের উপর ঘেন্না হতে থাকে ঋভুর৷ 

আজকে নবনীতা ম্যাডাম পড়িয়ে চলে যাওয়ার পরে ঋভু মরিয়া হয়ে ওর বন্ধু ঋতব্রতকে ফোন করল। পুরো ঘটনাটা ওকে বলে, ঋতব্রত পুরোটা শুনে বিশ্বাস করতে পারে না, ওদের ক্লাসে ম্যাডাম কত সুন্দর করে পড়া বোঝান, কত ভালো কথা বলেন, কাউকে মারেন না তাহলে কিংশুকের সাথে এরকম ব্যবহার করে কেন। কিংশুককে বলল ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলতে যে প্রাইভেট টিউশন না পড়ে ও বাকিদের মতোই ম্যাডামের টিউটোরিয়ালে পড়বে। ঋভু একবার বলার চেষ্টাও করেছিল বাবাকে যে ও আলাদা করে পড়বে না, সকলের সঙ্গেই পড়বে, কিন্তু বাবা ওর কথা শোনেনি, হয়তো ভেবেছে পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়ার জন্য ও এই ধরনের কোনও ফন্দি করেছে৷

আজ নবনীতা ম্যাডামের কাছে ঋভুর পড়ার দিন৷ সকালে ঘুম থেকে উঠে, ঋভু মাকে বলল “মা আজকে অফিসে যেও না প্লিজ। আজকে তোমার কাছে পড়তে ইচ্ছা করছে, গত দুদিনে আমি দুটো টেস্ট পেপার সলভ করেছি। ওগুলোতে কয়েকটা প্রশ্ন আটকেছে, তাই তোমাকে দেখিয়ে নিতে চাই।”

দেবযানী ঋভুর পড়াশোনার আগ্রহ দেখে খুশি হলো “বুঝতে পারছি রে, কিন্তু আজকে অফিসে জরুরি কাজ আছে, সেটাকে কোনওভাবেই এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। তাই না চাইলেও আমাকে বেরোতেই হবে। কিন্তু কথা দিলাম অফিস থেকে আজকে তাড়াতাড়ি চলে আসব, তোর পড়াগুলো দেখিয়ে দেব আর তারপরে আমরা সকলে উইকেন্ডে কোথাও বেড়াতে যাব৷”

দুঃখ পেলেও সত্যি কথা বলতে পারল না ঋভু, শুধু ঘাড় নেড়ে বলল “ঠিক আছে মা।”

আজ ঋভু নিজেকে মানসিকভাবে তৈরি করেছিল তাই ম্যাডামের কাছে পড়ার সময় উনাকে বলল যে উনার কথা ও বাবা মাকে জানিয়ে দেবে৷ এই কথা শুনে হঠাৎ করে উনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে যান৷ ঋভু ভাবে আজ যেভাবেই হোক মা বাবা কে সব কথা খুলে বলবে৷

ঋভুদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছু দূর গিয়ে নবনীতা দেবযানীকে ফোন করে বললেন “দেখুন মিসেস দত্ত, কিংশুক আজকেও পড়তে চায়নি। এরকম করে কিন্তু হচ্ছে না, আর তাছাড়া আপনারা ওকে একটু সময় দিন। ছেলে একদম উচ্ছন্নে যাচ্ছে। আজ তো আমার সামনে স্ল্যাং ব্যবহার করেছে আর তারপরে চিৎকার করে আমাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছে৷ তাই ওকে আমার পক্ষে আর পড়ানো সম্ভব নয়। আপনি আমার এই মাসের ফিসটা দিয়ে দেবেন। রাখছি।”

ফোন রেখে দেবযানী প্রমাদ গোনে। ক্লাস টিচারের সঙ্গে এই ব্যবহারের মানে দেবযানী খুব ভালো করেই বুঝতে পারে৷ আর এর প্রভাব যে ঋভুর স্কুলের পরীক্ষার খাতায় পড়তে চলেছে তা বুঝতেও খুব বেশি সময় লাগে না দেবযানীর৷ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে বাড়ি ফেরে সে৷ ৫:৩০টা নাগাদ বাড়ি ঢুকে ঋভুকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে দেবযানী খুব রেগে যায়। মেজাজ হারিয়ে দেবযানী প্রচণ্ড মারধর করে ঋভুকে৷

মায়ের কাছে মার খেয়ে, ঋভু বুঝতে পারে যে ম্যাডাম ওর নামে ওর মায়ের কাছে মিথ্যে অভিযোগ করেছে৷ মা রেগে আছে তাই এখন বোঝাতে যাওয়া বোকামি ভেবে ও চুপ করে নিজের ঘরে উঠে চলে যায়৷ চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরছে ওর। মায়ের কাছে মার খেয়ে কেঁদেছে শুনলে বন্ধুরা খেপাবে ভেবে সে নিঃশব্দে কাঁদে। ওর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায় যে তার কথা তার বাবা-মা আর বিশ্বাস করবে না আর এই নোংরামি থেকে ওর আর কোনওদিনও মুক্তি নেই। তাই ওর বেঁচে থাকার আর কোনও মানে নেই৷

নিজের ঘরে আলমারিতে লুকিয়ে রাখা মায়ের শাড়িটা বের করে ঋভু। জীবনের শেষ মুহূর্তে উপস্থিত হয়ে ঋভু ওর আর বাবা মায়ের একসঙ্গে একটা ফটো সঙ্গে করে বিছানায় চুপ করে শুয়ে পড়ে, ওর চোখের জলে ভেসে যায় বিছানার চাদর৷ খুব দুঃখ হয় তার তবু এই দুঃখ কারো সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায়না৷ মা বাবাকে ছেড়ে যেতে একটুও ইচ্ছে না থাকলেও ওর আর কোনও উপায় নেই বুঝে যায়৷ বালিশের নিচে ঋভু একটা চিঠি রেখে গেল তার বাবা মার জন্য ৷ তারপরে মায়ের শাড়িটাকে বিছানার উপরে উঠে সিলিং ফ্যানে জড়ায়।



ঋভুর পড়াশোনা নিয়ে দেবযানী খুবই চিন্তিত থাকে সে কিছুতেই বুঝতে পারে না কী করলে পরে ঋভুকে পড়াশোনায় মনোযোগী করে তুলতে পারে৷ সন্ধ্যেবেলায় ৭:৩০টার সময়ে সৌভিক অফিস থেকে ফিরে ঋভুর কথা জিজ্ঞাসা করলে দেবযানীর যেন ঘোর কেটে যায়৷ হঠাৎ খেয়াল হলো প্রায় দেড় ঘণ্টা হয়ে গিয়েছে ঋভু নিজের ঘরে ঢুকেছে। রাগের মাথায় এভাবে ওকে মারা উচিত হয়নি। সৌভিককে সে আজকের সব ঘটনা খুলে বলল। পরক্ষনেই সৌভিকের দিকে সভয়ে তাকিয়ে দেবযানী বলল “আমার আজকে এত রাগ হয়ে গিয়েছিল যে ওকে খুব মেরেছিলাম। এখন এতোটা সময় হয়ে গেছে, ওর ঘরের দরজা বন্ধ। একবার দেখবে?”

দেবযানীর কথা শুনে তাড়াতাড়ি ঋভুর ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে সৌভিক৷ বারবার দরজাটা খুলতে বলে ওকে৷ অনেকক্ষণ ভেতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে এবার দুজনেরই খুব ভয় হতে থাকে৷ দেবযানীর মনে হয় তার অতটা বাজে ভাবে ঋভুকে না মারলেও হত৷ দরজা ধাক্কাধাক্কি করে অনেক কষ্টে প্রায় দশ মিনিটের চেষ্টায় সৌভিক দরজা খুলে দৃশ্য দেখে আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে। ওরা আসার অনেক আগেই, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে ঋভু৷ দেবযানী এই দৃশ্য দেখে ভয়ে সাদা হয়ে মাটিতে বসে পড়ে। সৌভিক বিছানার উপরে ঋভুর লেখা চিঠিটা দেখতে পেল, সেটা পড়ে দেবযানীর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল “আমরাই ছেলেটাকে মেরে ফেললাম, দেবযানী৷”

চিঠিটা পুরো পড়ে শোকে পাগল হয়ে গেল দেবযানী শুধু একটাই কথা বলতে পারল “মা হয়ে আমি নিজেই নিজের ছেলেকে খুন করলাম৷”


------ ঋভুর চিঠি --------


চিঠিতে ঋভু লিখেছিল,

মা বাবা তোমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি বলে প্লিজ তোমরা কেউ দুঃখ পেয়ো না৷ আমার আর কোনও উপায় ছিল না বিশ্বাস কর৷ আমি পড়াশোনা করতে চাইতাম, আমি ভালো রেজাল্ট করতে চাইতাম, অমনোযোগী ছিলাম কারণ আমি চাইতাম তোমরা দুজনে আমাকে সময় দাও। তবু লাস্ট পি টি এম এর পরে ঠিক করেছিলাম মন দিয়ে পড়ব, যাতে আমার রেজাল্ট ভালো হয়।

কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল, যবে থেকে তোমরা আমাকে নবনীতা ম্যাডামের কাছে টিউশনিতে দিলে। সেদিন থেকে আমি নিজেকে ভীষণ ঘৃণা করতে শুরু করলাম। প্রথম দুই দিন উনি আমাকে পড়াতে এসে উনি আমাকে ঠিক করেই পড়ালেন। গ্রামারে যেখানে সমস্যা হচ্ছিল সেগুলো দেখিয়ে দিলেন। কিন্তু তার পরদিন যখন এলেন তখন সব কিছু গুলিয়ে গেল। আমার মনটাই ভেঙ্গে গেল৷ আমি জানি তোমরা কেউ হয়ত বিশ্বাস করবে না নবনীতা ম্যাডাম এখানে আমাকে একলা কেন পড়াতে আসতেন!

সেদিন থেকে আজ অবধি উনি আমার সঙ্গে অনেক নোংরামি  করেছেন৷ আমাকে উনি অযাচিত ভাবে স্পর্শ করতেন, জোর করে নিজের শরীরে আমার হাত ছোঁয়াতেন। আমাকে উনি বারবার উনার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে বাধ্য করেছেন৷ আমার ভাল লাগত না, আমি বহুবার বলা স্বত্বেও উনি আমার কথা শোনেননি উলটে আমাকে ভয় দেখাতেন আমি যদি উনার কথা না শুনে উনি যা করছেন তাতে বাধা দি, তাহলে উনি আমাকে স্কুলের পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেবেন। শুধু তাই নয় তোমাদেরকে জানিয়ে দেবেন যে আমি পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত৷ আমি বহুবার তোমাকে বলতে চেয়েছি মা কিন্তু তোমরা কিছুতেই আমার কথা শুনতে চাওনি।

বাবা শুধুই উনার কথা বিশ্বাস করত আর ভাবত আমি বোধহয় পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়ার জন্য অনেক রকমের ফন্দি ফিকির করে থাকি৷ ঋতব্রতকেও জানিয়েছিলাম, ও বলেছিল তোমাদের সঙ্গে কথা বলে আমাকে কোচিং ক্লাসে ভর্তি করে দিতে। আমি বলেছিলাম বাবাকে, কিন্তু বাবা আমার কথা শোনেনি।

বিশ্বাস করো মা এই নোংরামি আমি আর নিতে পারছিলাম না৷ আমার নিজের উপর নিজের ঘৃণা হচ্ছিল৷ অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই বেরিয়ে আসার কোনও রাস্তা খুঁজে পাইনি৷ আজ আমি আগে থেকেই সব কিছু ঠিক করে রেখেছিলাম, উনি আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলেই আমি উনার নামে স্কুলে আর পুলিশের কাছে অভিযোগ করব। এই কথা বলে উনাকে বারণ করি, উনি তখন আমাকে  বলে যান যে আমাকে দেখে নেবেন ৷ আমি বুঝতে পারি যে তোমরা আমার কথা কেউ বুঝবে না তাই সেইজন্যই আমি আজ এই পথ নিলাম আমায় তোমরা প্লিজ ক্ষমা করো৷ মনে করো তোমাদের বাজে ছেলেটা তোমাদের ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে৷ আমারও তোমাদের ছেড়ে খুব কষ্ট হচ্ছে মা।

ইতি,

ঋভু।

মা বাবা আর সন্তানদের মধ্যে বেড়ে যাওয়া দূরত্ব আজ একটা কিশোরের তরতাজা প্রাণ কেড়ে নিল৷ মা বাবার সন্তানকে সময় দিতে না পারায়, একটা মায়ের কোল খালি হয়ে গেল।

এই ঘটনার পরে থানা পুলিশ হয়েছিল। ঋভুর সুইসাইড নোটের ভিত্তিতে নবনীতাকে গ্রেফতারও করা হয়। ওঁর বিরুদ্ধে কিংশুককে যৌন নিপীড়ন ও আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়ার জন্য যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। স্কুল থেকে নবনীতাকে টার্মিনেট করে দেয়া হয়। কিংশুককে যে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিল, তার শাস্তি হয়তো সে পেল কিন্তু একটা মায়ের কোল আর পূর্ণ হল না। সৌভিক দেবযানীর একমাত্র সন্তান, ওদের ছেড়ে সে কোনও নিরুদ্দেশের পথে পাড়ি দিল।


…………………….


অলঙ্করণঃ- সায়ন্ন্যা দাশদত্ত


No comments:

Post a Comment