বাজার থেকে ফিরে চায়ের কাপে প্রথম চুমুকটা দিতে না দিতেই মোবাইল বেজে ওঠে অনুকূলের।রনোর ফোন।
'হ্যালো।'
'শোন একটা জরুরি কথা আছে। কাল বিকেলের দিকে চলে আয় আমার বাড়ি। ডেফিনিটলি আসিস।'
বিস্কুটটা চায়ে ডোবাতে গিয়েও হাতটা থেমে গেল অণুকুলের।
'ব্যাপার কী বলতো?'
'আরে এটা বলবো বলেই তো এত সকালে ফোন করলাম। আগামী কাল আমাদের পুরোনো স্কুলের রিইউনিয়ন আছে। বাইরের অনেককেই ইনভাইট করা হয়েছে অনুষ্ঠানে। সেখানে স্কুলের ইতিবৃত্ত নিয়ে একটা বই প্রকাশ হবার কথা। রামনারায়ন বাগচির নাম তোর মনে আছে? বছর পঁচিশ আগে আমাদের স্কুলেরই সুবর্ন জয়ন্তীতে ওঁকে চিফ গেস্ট হিসেবে আনা হয়েছিল.. তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম..।'
...রামনারায়ন বাগচি...বহুদিন কেটে গেলেও নামটা এখনো খুব চেনা অণুকুলের কাছে...। 'আই সি!তোদের স্কুলের যিনি প্রতিষ্ঠাতা? কলকাতায় থাকেন ভদ্রলোক.. মনে পড়েছে।'
'ইয়েস। ফাংশানে তোর গান শুনে উনি খুব ইমপ্রেস্ড হয়েছিলেন। '
কি বলেছিলেন, সেটাও মনে পড়ে গেল অনুকুলের। বলেছিলেন, 'অদ্ভুত মাইক ফিটিং গলা আপনার! ক্যাসেট করতে পারেন তো?'
রণো বলে চলে,' ভদ্রলোক বেশ কবছর আগে মারা গেছেন। ওঁর ছেলে সুগত বাগচিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে স্কুলে। রিটায়ার্ড টিচার হিসেবে আমরাও আমন্ত্রিত। মিঃবাগচি তোর সঙ্গে একটু কথা বলতে চান।আমরা কয়েকজন সেদিন ইনভিটেশন কার্ড দিতে ওঁর বালিগঙ্জের বাড়িতে গিয়েছিলাম...আলাপ বেশ জমে উঠেছিল... প্রসঙ্গক্রমে তোর নাম করছিলেন উনি...ভদ্রলোক বেশ নস্টালজিক হয়ে পড়েছিলেন...এটা তো আসলে ওঁদের নিজের জায়গা... ওঁর বাপ ঠাকুর্দার কথা ছেড়েই দিলাম... উনিও জীবনের অনেকগুলো দিন এই উলাপুরে কাটিয়ে গেছেন.. আমাদের স্কুলে এইট পর্যন্ত পড়েওছেন... এখন কাজে কর্মে ব্যস্ততায় এদিকে আসা হয়ে ওঠে না সেটা আলাদা কথা...তিনটে ব্যাপারে দেখলাম উনি খুব ইন্টারেস্টেড...ছোটোবেলাকার স্কুল, অনেককাল আগে বিক্রি হয়ে যাওয়া নিজের পৈতৃক বাড়িটাকে আর একবার ঘুরে দেখা...তোর সঙ্গে একবার মুখোমুখি আলাপচারিতা...।'
'কিন্তু আমার পরিচয় উনি জানলেন কী করে? '
'রামনারায়ন বাগচির মুখে স্কুল ফাংশানে গাওয়া তোর সেই গানের সুখ্যাতির কথা উনি শুনেছেন। তুই যে আমার বিশেষ বন্ধু এটা জানার পর হি ইজ ভেরি ইন্টারেস্টেড টু টক্ টু ইউ...এটুকুই বলতে পারবো... তবে যেটা পারলাম না, সেটার জন্য সত্যিই খুব আপসেট লাগছে। ইচ্ছে ছিল এবারও ফাংশানে তোকে দিয়ে গান গাওয়ানোর...হলো না রে...দিন বদলে গেছে.. নতুন স্কুল কমিটি..নতুন মানসিকতার লোকজন.. রিটায়ার্ড স্কুল মাস্টারের সেই কম্যান্ড আর কোথায়...তবু যেটুকু করার, ঐ স্কুলটাকে ভালোবেসেই করে চলেছি...যাক সে কথা..।'
' তুই শুধু শুধু রিকোয়েস্ট করতে গেলি কেন? সে বয়স কি আর আছে..।'
কাল আসার কথা আর একবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে রনো ফোনটা রেখে দিল।
পাশের কিচেন এ রোজকার মতো রান্না নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সাথী। ভোরের দিকে ছেলে ফোন করেছিল। নেক্সট মান্থে ওরা আসছে। নীল ছুটি পেয়েছে বেশ কিছুদিনের। এ বাড়িতে এখন স্বামী-স্ত্রী মিলে দুটি মাত্র প্রাণী। যা সুখ দুঃখ সব দুজনের মধ্যেই ভাগ করে নিতে হয়। ছোট্ট নাতিটা এলে আবার কিছুদিন সরগরম থাকবে বাড়িটা।
চায়ের খালি কাপটা পাশে সরিয়ে রেখে সিগারেট ধরিয়ে একবার আড় চোখে কিচেনের দিকে তাকালো অনুকূল। রনোর কথাগুলো এখন বৃত্তান্ত করে সাথীকে বলা যাবে না। কাজ মিটলে তখন না হয়...।
সিগারেটের এলোমেলো ধোঁয়ার মতোই বিক্ষিপ্ত অনুভূতি গুলো এক এক করে ভীড় করছিল অনুকুলের মনে। জীবনের প্রথম স্কুলে চাকরি পাবার অভিজ্ঞতা... তৎকালীন হেড মাস্টার সত্য বাবুর মুখ থেকে ধেয়ে আসা সেই প্রশ্ন..'তোমার নিজস্ব ভালোলাগা কিংবা শখ..সেরকম কিছু আছে?'
'প্রিয় শখ বলতে গান। '
'শোনাও দেখি একটা...।'
গানটা শোনানোর পর অনুকুলের মনে হয়েছিল চাকরিটা বোধহয় সেদিনই পাকা হয়ে গিয়েছে। অনুমান মিথ্যে হয় নি।
ইউনিভার্সিটির কমনরুমে বসে বন্ধুদেরকে গান শোনানোর অভিজ্ঞতার সেই স্মৃতিও এখনো টাটকা। দূর থেকে যে গান শুনে কেমিস্ট্রির কাটখোট্টা স্বভাবের প্রফেসর অনাদি সান্যাল টিচার্সরুমে কলিগদের সামনে অনুকুলকে ডেকে পাঠিয়ে ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছিলেন, 'পথিক তুমি পথ ভুইলা অন্য লাইনে চইলা আইছো...।'
ভদ্রলোক আজ হয়তো জীবন থেকে বহু দূরে চলে গেছেন কিন্তু ওঁর কথা থেকে গেছে।
বাস্তব সত্যিটা হলো এই, জীবনের বিভিন্ন সময়ে মানুষজনের কাছে গানের গলা নিয়ে প্রশংসা কুড়োলেও রেওয়াজ বা তালিমের মধ্য দিয়ে নিজেকে গড়ে তোলা কিংবা গান জিনিসটা নিয়ে নিজের অবচেতনের স্বপ্নটাকে বাস্তবায়িত করা..কোনোটাই হয়ে ওঠে নি অনুকূলের ক্ষেত্রে। বাবার একার উপার্জনে চলা একান্নবর্তী পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ টাই তখন নিজের শখ আহ্লাদ কে ছাপিয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল সামনে। চাকরি করে ফ্যামিলির পাশে এসে দাঁড়ানোর রাস্তাটা যখন খুলে গেল, স্বপ্নকে পিছনে ফেলে বয়স আর সময় তখন আরো অনেকটাই এগিয়ে গেছে। আজ এই মূহুর্তে জীবনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে অনুকুলের মনে হলো, সে তো দাদা মেজদাদের মতোই চাকরি করে একদিন পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, পরিবার কি তার একান্ত নিজস্ব চাওয়া-পাওয়াগুলোকে আলাদা করে দেখেছে কখনো? প্রশ্নটা হয়তো থেকেই যাবে বাকি জীবনেও। এখন এই তিয়াত্তর বছর বয়সে তাঁর মতো নাম না জানা কাউকে ফাংশানে গান গাইবার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হবে এমন আশা করাটাই ভুল। পাশাপাশি অনুকুলের এটাও মনে হল, মাত্র একদিনের আলাপে রামনারায়ন বাগচির মতো মানুষ যে তার প্রতি এতটা ইমপ্রেসড হতে পারে, এমনটাও হয়তো সত্যিই ভাবতে পারেনি সে।
রণোর ঘরের সোফায় বসে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলেন সুগত বাবু। 'অপূর্ব..অপুর্ব!'
রণো, রণোর স্ত্রী দু'জনেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
এমন প্রস্তাব যে আসতে পারে, ভেবেই রেখেছিল অনুকূল। হলোও তাই। সুগত বাবুর অনুরোধে শেষমেশ গাইতেই হলো গানটা। গাইবার পর অনুকুলের মনে হলো সত্যিই কি এতটা প্রশংসা পাবার মতো করে গেয়েছে সে? কি জানি..।
'আসা যাওয়ার পথের ধারে... পঁচিশ বছর আগে স্কুল ফাংশানে ঠিক এই গানটাই গেয়েছিলেন আপনি.. কি ভুল বলিনি তো?' বললেন সুগত বাবু।
রণোও সায় দেয়।
অনুকূল হাসে।'রামনারায়ন বাবু বলেছেন বুঝি?'
'শুধু বলেনই নি, আপনার গানটা বাবা সেদিন ক্যাসেট করে রেখেছিলেন... একটা অদ্ভুত শখ ছিল বাবার। যখন যেখানে বেড়াতে যেতেন ব্যাগে আর কিছু না থাকুক, একটা ক্যামেরা আর ওঁর সবসময়ের সঙ্গী মিনি টেপরেকর্ডারটা নিয়ে যেতে কখনো ভুলতেন না। ভালোলাগার কত কি যে উপাদান ক্যামেরা আর ক্যাসেট বন্দী করে রাখতেন হিসাব থাকতো না। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত আর কখনো শোনা যাবে না ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেটে সেদিনের রেকর্ড করা আপনার সেই কন্ঠ... ফিতে জড়িয়ে ক্যাসেট খানা একেবারেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে...অত বছর আগের কথা.. তবু ভয়েস কি ভোলা যায় সবটা? ডাউন মেমোরি লেন এ যতটুকু রয়ে গেছে সেটুকু রেমিনিসেন্স করেই বললাম...। '
অনুকুল হাসে।'উনি যে আমার গান শুনে এতটা ইমপ্রেস্ড হয়েছিলেন এটা সত্যিই...।'
উর্মিলা প্লেটে করে কফি আর ডিম টোস্ট এনে দিয়েছিল। কফির কাপে চুমুক দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ' ভাবতে পারেন নি তাই তো? আসলে গান বাজনার প্রতি একটা আলাদা আবেগ বরাবরই বাবার মধ্যে দেখে এসেছি। গান ছিল তাঁর কাছে সাধনার মতো। পন্ডিত ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে তালিম নিয়েছিলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের। বাড়ির দোতলার ঘরের এক কোণে বসে একমনে যখন রেওয়াজ করতেন তাকিয়ে দেখতাম শুধু। কিন্তু নিজেকে বরাবরই সরিয়ে রেখেছিলেন প্রচারের আড়ালে...দু চারবার জলসায় গান গাইতে রাজি হয়েছিলেন বটে..সে নেহাৎই পরিচিতজনদের অনুরোধ উপরোধে.. হিজ্ মাস্টার্স ভয়েস থেকে রেকর্ডিং এর অফার এসেছিল.. ফিরিয়ে দিয়েছিলেন... এক ধরনের ডিভোসান ছাড়া আর কি বলবো বলুন...পরে চাকরি সূত্রে কলকাতায় চলে আসা, বিভিন্ন কর্মব্যস্ততার মাঝেও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজের সাধনাকে ছাড়তে পারেন নি বাবা..যারা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছে তারা বাবার এই দিকটার কথা হয়তো জানতে পারে...।'
রণো বললো, 'একজ্যাক্টলী। রামনারায়ন বাবুর গানের সে জলসা আমি শুনেছি। উলাপুর ষ্টেশন সংলগ্ন মাঠে হয়েছিল। দু’ দুবার। শেষেরটা সম্ভবত সিক্সটি ফোরে। তখন কতই বা বয়স আমাদের। বাঁশে খাটানো ত্রিপল। তার নীচে শীতের রাতে, শিশির ভেজা ঘাসে, চট পেতে বসে, গায়ে র্যাপার জড়িয়ে জলসা দেখেছি। কি অপূর্ব সে ওস্তাদি কন্ঠ! না ছিল চতুর্দিকের ক্যামেরার ঝলকানি, না প্রচার, না আলোর বৃত্তে মুখ দেখানোর কাড়াকাড়ি...। তাই বোধহয় জীবনের এতগুলো বছর পার করে এসেও ষ্টেশন মাঠের কবেকার সে জলসা মনের কোণে কোথায় একটা দাগ রেখে গেছে আজও। সুগত বাবু তখন অবিশ্যি অনেকটাই ছোটো। স্টেজে বাবার পাশে বসেছিলেন চুপ করে। একটা আবৃত্তিও করেছিলেন মনে আছে.. কী যেন বেশ..।'
'বীরপুরুষ..। '
' ইয়েস! '
সুগত বাবু হাসলেন।
' নিজের কথা ভুলে যাই কি করে বলুন..বিশেষ করে এসব গোল্ডেন রেমিনিসেন্স!'
রনোও যেন স্মৃতিচারণার মধ্যে।
' তা বটে। সেসব সোনালি দিন চোখের সামনে কিভাবে পালটে গেল! ষ্টেশন মাঠে এখন গরু চরে। খাবলা হয়ে, গর্ত হয়ে পড়ে আছে। বনবাদাড়, ঝোপজঙ্গলে ভরা। তবু ঐ মাঠের দিকে তাকালে একবার না একবার রামনারায়ন বাবুর সে জলসার কথা মনে পড়বেই...। তার বছর কয়েক পরেই উনি কলকাতা চলে যান। সূবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ওঁকে গান গাওয়ার জন্য বলেছিলাম... একটাই কথা বলেছিলেন,"লাইমলাইটের আলোয় আমাকে না হয় নাই টানলে" বিরল প্রতিভা..বেশিরভাগ লোকের কাছে স্কুলের ফাউন্ডার হিসেবেই থেকে গেলেন... এ তল্লাটের গুটিকয়েক পুরনো লোক ছাড়া কেই বা জানে তাঁর আর একটা পরিচয়...। '
উর্মিলা পাশে দাঁড়িয়ে চুপ করে শুনছিল কথাগুলো। সাথী আজ আসতে পারে নি। অনুকুলের মনে হলো, ও এলে শুনতে পেত, কত বড় প্রতিভাধর একজন মানুষ নিজে শখ করে ক্যাসেট বন্দি করেছিলেন পঁচিশ বছর আগে অনুকূল চক্রবর্তীর হারিয়ে যাওয়া কন্ঠ। যে দিন, যে সময় চলে যায় সে আর ফিরে আসে না। ঠিক যেমন করে আর ফিরবে না বাবা মা দাদা মেজদা আত্মীয় পরিজনেদের পাশে নিয়ে চলা সেদিনের সেই যৌথ পরিবারের আনন্দগুলো, দুপুর বেলায় খাটে শুয়ে বাবার একমনে রেডিওতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুরোধের আসর শোনার সেইসব মূহুর্ত, বসন্তের রৌদ্রে ছাদে উঠে মায়ের কুল শুকোতে দেওয়া, দুই হাতে দুটো ইয়া বড় বড় ব্যাগ নিয়ে ঘর্মাক্ত শরীরে দাদার বাজার থেকে ফেরা, মায়ের ঘরে পেল্লায় মাপের চারপায়া কাঠের টেলিভিশনকে ঘিরে গোল হয়ে বসে টিভি দেখার আনন্দকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া, মেঝেতে পাত পেড়ে একসাথে খাওয়া দাওয়া...তর্ক বিতর্ক হৈ হুল্লোড় আমোদ আহ্লাদ কত কিই না জড়িয়ে ছিল নৈহাটি অরবিন্দ রোডের ফেলে আসা ঐ পুরোনো বাড়ির সঙ্গে...।
কালের নিয়মে একদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল যে যার মতো করে। প্রথমে বাবা, তারপর মা সবশেষে বড়দার মৃত্যু.. মাথার ওপর থেকে শেষ ছাতাটাকেও সরিয়ে নিয়ে গেল একদিন। ভাইপোদের বিয়ে, তাদের আলাদা সংসার, পরিবারের কলেবর বেড়ে যাওয়া, একই বাড়িতে স্থান সংকুলান এবং তারই সূত্র ধরে মানুষের প্রয়োজন, সুবিধা অসুবিধা গুলোই সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিল সবার কাছে। হাঁড়ি আলাদা হলো...সংসারের ছিঁড়ে যাওয়া বাঁধন একদিন অনুকুলকেও বাধ্য করলো তার মতো করে ভাবতে...প্লাস্টার খসা ভেঙে পড়া আদ্দিকালের কড়ি বরগার ছাদ, দেওয়াল সত্যিই তো কে কতদিনই বা এসব মেইনটেইন করবে...তার চাইতে সকলের মত অনুযায়ী বাড়ি বিক্রির লোক খুঁজতে শুরু করা.. ততদিনে একটু একটু করে অনুকূল বুঝতে শিখেছিল এই ভেঙে যাওয়া সংসারে তার একার ভালো লাগা মন্দ লাগার আর কোনো দাম নেই...। বাড়ি ছেড়ে চলে আসার দিন রণো এসেছিল দেখা করতে। বাইরে তখন টিপটিপ বৃষ্টি। তিরিশ বছরের বিবাহিত জীবন কাটিয়ে আসা অনুকুলের সেই দশ বাই দশ ফুটের ঘরের খাটটাতে বসে রণো বলেছিল, 'আই শ্যাল নট পাস দিস্ ওয়ে এগেইন..।' কথাটা দাগ কেটে আছে আজও। হাজারো স্মৃতি বুকে নিয়েই সেদিন চলে আসতে হয়েছিল অনুকুলকে; নৈহাটি থেকে দু কিলোমিটার দূরে বহু পরিশ্রমে নিজের হাতে তৈরি তার সেই ছোট্ট বাড়িটাতে। একদিন বাবা মৃগাঙ্কশেখর বহু কষ্টে রক্তজল করে যে মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু গড়ে তুলেছিলেন সেই বাড়িটাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব কি অনুকুলের ছিল না? এখন আর এ নিয়ে ভাবতে চায় না অনুকুল। ভেবে কিই বা হবে...। শুধু বার্ধক্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে হারানো দিনগুলো যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে আরো বেশি করে...কথা বলে ওঠে পঁচিশ বছর আগেকার হারিয়ে যাওয়া কন্ঠের সুরে... দুটো সময়ের মধ্যে তুলনা করা হয়তো ঠিক হবে না। কিন্তু আজকের গানটা সত্যিই কি তেমন ভালো হয়েছে? চর্চা নেই বহুদিন, গলা বেশিদূর ওঠে না, বয়সের সাথে সাথে দমের ঘাটতি স্পষ্ট... এসব নিয়ে কি তেমন একটা ভালো গাওয়া যায় কখনো...? গাইবার সময় তার তো নিজেরই যেন মনে হচ্ছিল...।
কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল অনুকূল। সুগত বাবুর কথায় ফিরে তাকালো। ভদ্রলোক বললেন, 'আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম, এখানে যেদিন আসবো আপনার গান না শুনে ফিরবো না...। নিজের জন্মস্থান, ভিটে মাটির প্রতি টান, ছেলেবেলার স্কুলটাকে কাছ থেকে দেখার টান.. এসব তো রয়েইছে.. পাশাপাশি আপনিও রয়েছেন...। বাবার মতো গানের গলা পাইনি বটে; কিন্তু যেটা পেয়েছি সুরের প্রতি একটা আলাদা টান...। অন্য চাকরি ছেড়ে রেকর্ডিং কোম্পানির চাকরিটা বেছে নিয়েছিলাম অনেকটা সেই কারণেই। বলতে দ্বিধা নেই, সময়টা যদি আর কিছুটা আগে হতো আমি দায়িত্ব নিয়ে মিউজিক কোম্পানিতে আপনার ক্যাসেট রিলিজ করাতাম...।'
.... 'অদ্ভুত মাইক ফিটিং গলা আপনার। ক্যাসেট করতে পারেন তো...' অনুকুলের মনে হলো, সুগত বাবুর আজকের কথায় রামনারায়ন বাগচির সেদিনের কথার সুর কোথায় যেন লুকিয়ে রয়েছে। মাঝখানে শুধু সময়টাই বয়ে গিয়েছে অনেক..।
অনুকূল হাসে, ' এই বয়সে ঐ যতটুকু পারা যায় চেষ্টা করলাম আর কি...স্বরলিপি না জানলে নিজস্ব স্যাটিসফ্যাকশান টুকু ছাড়া গানের আর কি মূল্য বলুন...।
'চুয়াত্তর বছর বয়সে গলা যে এখনো সুরে চলছে এটাই তো অনেক... কমদিন তো হলো না মিঃ চক্রবর্তী এই মিউজিক লাইনে আছি...মানুষের ওঠাপড়া নেহাৎ কম দেখিনি...একসময়ের নামীদামি শিল্পী জীবনের একটা স্টেজে এসে গলা পড়ে গিয়ে কিভাবে ফুরিয়ে যেতে পারে.. এসব নিজের চোখে দেখা বাস্তব অভিজ্ঞতা... স্বরলিপি দিয়ে কি আর সবটুকু মাপা যায় বলুন..। '
রণো সহমত পোষণ করে। 'আমি তো বলি চেষ্টা করলে ও অনেক দূর চলে যেতে পারতো...। '
স্মিত হেসে সুগত বাবুর দিকে তাকিয়ে অনুকুল বলে,' কতদূর যেতে পারতাম তা হয়তো জানি না...তবে এটা ঠিক, সেই চেষ্টাটাই আর করা হয়ে ওঠে নি। কিছু পারিবারিক কাস্টমস, বিশ্বাস, ফ্যামিলি বার্ডেন, রেসপন্সিবিলিটি...এই সবকিছু মিলিয়ে আর কি...জয়েন্ট ফ্যামিলিতে এই ব্যারিয়ারগুলোকে ডিঙিয়ে চলাটা সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠে না... ইনফ্যাক্ট, বাবার অভিমত ছিল লেখাপড়া আর গানবাজনা দুটো দিক একসঙ্গে বজায় রাখা যায় না...অথচ ব্যাক্তিগত জীবনে বাবা কিন্তু ছিলেন একেবারেই অন্যরকম মানুষ। রবীন্দ্রনাথ... রবীন্দ্র সংগীত.. সারাটা জীবন রয়ে গিয়েছিল তাঁর মন জুড়ে... বাড়িতে একটা টেপ রেকর্ডার ছিল... জীবনের শেষ দিনটাতেও দেখেছি বাবা রোগগ্রস্ত অবস্থায় বিছানায় শুয়ে শীর্ণ কাঁপাকাঁপা হাতদুটো দিয়ে আমায় প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে বলছেন, "একবার দেবব্রত বিশ্বাসের ঐ গানখানা চালিয়ে দাও...একটু শুনি..."। সেই ছিল তাঁর শেষ কথা। গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা...শুনতে শুনতেই চলে গেলেন বাবা। গান না জেনেও গানের প্রতি এতটা ডিভোশান আমি খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখেছি...। '
রণোর বাড়ির খোলা জানলা দিয়ে স্কুল মাঠটাকে দেখা যাচ্ছিল বহুদূর পর্যন্ত... সেদিকেই তাকিয়ে ছিল অনুকূল। অনেক বছর হয়ে গেলেও সেদিনের সেই ছবিটা আজও স্পষ্ট হয়ে ভাসে চোখের সামনে। শেষের দিকে টেপ রেকর্ডারটাই হয়ে উঠেছিল বাবার নিত্য সঙ্গী। অনুকূল কিনে এনেছিল শখ করে বাড়ির জন্য। বাবার গলায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি, মায়ের কন্ঠস্বর... এসবই রেকর্ড করে রেখেছিল সে। আজ আর শোনার কোনো উপায় নেই। না আছে সেই আশির দশকের কেনা টেপ রেকর্ডার, না আছে ক্যাসেটের যুগ... কোথায় হারিয়ে গেছে সেসব কন্ঠস্বর.. হয়তো বা খারাপ হয়ে পড়ে আছে ঘরের কোথাও...যেভাবে স্পেয়ার পার্টস এর অভাবে খারাপ হয়ে পড়ে ছিল টেপ রেকর্ডারখানা বছরের পর বছর ঘরের বাঙ্কে...শেষমেষ কিলো দরে বেচে দিতে হলো বাধ্য হয়ে...কত হারানো সময়ের সাক্ষী ছিল জিনিসটা...।
অনেক কথা আজ যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে নিজে থেকে.. যা এতকাল সে রণোর সঙ্গেও শেয়ার করে নি। একেই কি বলে বয়সকালের আবেগ? হবে হয়তো।
সবাই এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল অনুকূলের কথাগুলো। সুগত বাবু বললেন, 'এবার আমাকে উঠতে হবে। অনেক আনন্দ পেলাম এখানে এসে। অনেক কিছু সঙ্গেও নিয়ে যাচ্ছি। জানি না আবার কবে আসতে পারবো। যাবার আগে একটা জিনিস আপনাকে দিয়ে যেতে চাই মিঃ চক্রবর্তী। রণোদীপ বাবুর বাড়িতে আমার আসার এটাও একটা বড় কারণ...। '
কৌতুহলী চোখে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে থাকে অনুকূল। রণোও সমান কৌতুহলী।
সুগত বাবু তাঁর ব্যাগ থেকে একটা অডিও ক্যাসেট বের করে সামনে সেন্টার টেবিলের ওপর রাখলেন।
'দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা?' বললেন তিনি। 'এটা আমাদের বাড়িতে রাখা ছিল। এই ক্যাসেটের বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই। মিঃ চক্রবর্তী আপনি আলোকপাত করতে পারেন?'
ক্যাসেটের গায়ে কালো কালিতে বড় বড় হরফে লেখা 'অনুকুল চক্রবর্তী ' নামটা এখনো বেশ স্পষ্ট।
রণো বললো,' এটা সেই ক্যাসেট না যেটা মিঃবাগচি নিয়ে গিয়েছিলেন? '
পঁচিশ বছর আগের একটা খন্ডচিত্র ভেসে উঠলো অনুকুলের স্মৃতিপটে...।
ঠিক এরকমই এক বিকেলে সূবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠান শেষে রণোর বাড়িতে এসে গল্প করছিলেন রামনারায়ন বাবু। অনুকূলকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, 'এরকম মাইক ফিটিং গলা...ক্যাসেট করতে পারেন তো? '
'হয়ে ওঠে নি আসলে। টেপ রেকর্ডারের ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেটে শখ করে নিজের গান রেকর্ডিং... এর বাইরে অন্য কিছু করা আর...।'
'তাই নাকি? থাকলে পরে শুনতাম...।'
রণোকে শোনানোর জন্য নিজের গান রেকর্ডিং করা একটা ক্যাসেট শখ করে সেদিন নিয়ে এসেছিল অনুকুল। কি মনে করে সেটাই দিয়ে দিয়েছিল ভদ্রলোককে। আজ এতদিন পর আবার সেই স্মৃতি...।
অনুকূল ঘটনাটা খুলে বললো সুগত বাবুকে।
শুনে ভদ্রলোক বললেন, ' আই সী! ক্যাসেটটা শোনার সৌভাগ্য আমার হয় নি। কিছু জানতামও না এ বিষয়ে। বাবার মুখেও কিছু শুনিনি। হয়তো কর্মব্যস্ততার মাঝে ভুলেই গিয়েছিলেন ক্যাসেটের ব্যাপারটা। রণোদীপ বাবুদের স্কুলের সেই অনুষ্ঠানের পর দিন দশেকের মধ্যে বাবা ট্রান্সফার হয়ে চলে যান শিলচরে। আমরা অবশ্য পড়াশোনার কারণে কলকাতাতেই থেকে যাই। সাত আট বছর পর বাবা আবার ফিরে আসেন নিজের জায়গায়। মাস চারেক আগে বাড়ি রং করার সময় বাবার একটা পুরনো অ্যাটাচি কেস থেকে হঠাৎই ক্যাসেটটা আমি আবিষ্কার করি। কিন্তু তখন আর এ বিষয়ে কাকেই বা জিজ্ঞেস করবো...বাবা মারা গেছেন ততদিনে অনেক বছর হয়ে গেছে। ক্যাসেটের গায়ে লেখা আপনার নামটা কেন জানি না মনে একটা আলাদা কৌতুহল জাগিয়ে তুলেছিল। ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেটে রেকর্ড করা আপনার গান হয়তো অবশ্যই এতে থাকতে পারে... বাড়িতে পুরোনো টেপ রেকর্ডার ছিলই। কিন্তু থাকলেই বা...ক্যাসেটের অবস্থা যে তথৈবচ। ফিতে জড়িয়ে বলতে গেলে প্রায় পঞ্চত্ব প্রাপ্তির পথে । শেষমেশ অনেক কসরত করে নিজের ডিজিটাইজ মেশিনের সাহায্যে ক্যাসেটটাকে আমি আগের অবস্থায় নিয়ে আসতে পেরেছি মিঃ চক্রবর্তী... কেন জানেন? শুধু একটাই কৌতুহলে.. আপনার গান শুনবো বলে...। কিন্তু বদলে যা পেলাম, সেটা আমি নিজের জন্য নয়...আজ আপনাকেই ফেরত দিতে চাই....। '
কৌতুহল যেন আগের চেয়ে আরো বেশ কিছুটা বেড়ে গেল অনুকূলের। কী বলতে চাইছেন উনি?
সুগত বাবু একটু হেসে ব্যাগ থেকে একটা ইলেকট্রনিকস যন্ত্র বের করে তার ভেতর ক্যাসেটটাকে সেট করলেন।
সুইচ টেপা মাত্রই ক্যাসেট চলতে শুরু করলো।
একে একে ফিরে আসছে মা হেমপ্রভা দেবীর হারিয়ে যাওয়া কন্ঠস্বর, বাবা মৃগাঙ্কশেখরের গলায় আবৃত্তি করা রবীন্দ্রনাথের কবিতা, বড় দার রেকর্ড করা সেদিনের কন্ঠস্বর, ইস্কুলে পড়া ছোট্ট নীলের আধো আধো সুরে দাদুর শিখিয়ে দেওয়া বীরপুরুষ কবিতা আবৃত্তি. ...ফিরে আসছে কবেকার হারিয়ে যাওয়া সময়.. হারিয়ে যাওয়া দিন... হারিয়ে যাওয়া আবেগ...সেদিনের যৌথ পরিবারের ছেঁড়া তারগুলো একটা একটা করে গাঁথা-মালা হয়ে উঠতে শুরু করেছে যেন নতুন করে...মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে থাকে অনুকূল... চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে তার...আবেগকে কিছুতেই যেন রোধ করতে পারছেন না...দুচোখের কোণায় বিন্দু বিন্দু জল জমতে শুরু করেছে...। ঠিক তখনই পিঠে একটা আলতো হাতের ছোঁয়া এসে লাগলো। কিরকম যেন ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল অনুকূল। ফিরে তাকালো। সুগত বাবু চেয়ে আছেন তারই মুখের দিকে।
'আজ আমি উঠি মিঃ চক্রবর্তী..।'
'ও চলে যাচ্ছেন...?'
রণো বলে উঠলো, 'অ্যামেজিং... সত্যিই অ্যামেজিং! শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল মাসিমা মেশোমশাই বড়দা..এঁদেরকে যেন সেই আগের মতো দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে.. কতদিনের কত সব স্মৃতি জড়িয়ে... বুঝলে উর্মিলা, অনুকুল দের ফ্যামিলির সঙ্গে আমার চুয়াল্লিশ বছরের রিলেশন...নিজের বাবা মার কথাও মনে পড়ে যাচ্ছে... দূর্ভাগ্য..তাঁদের কন্ঠস্বর আজ আর কোথাও খুঁজে পাবো না...।'
গাঢ় বন্ধুত্বের সূত্রে সম্পর্কটা যখন ছড়িয়ে যায় অন্য অনেকের মাঝে; তখন সেখানে যে আবেগ কাজ করে সেই আবেগকে যেন রণোও পারছিল না রোধ করতে...। দুজনের এই দীর্ঘ বন্ধুত্বের কথা উর্মিলা জানলেও সেদিন বিয়ে হয়ে আসা মেয়ে কতটাই বা উপলব্ধি করতে পারে..।
অনুকুলকে উদ্দেশ্য করে সুগত বাবু হেসে বললেন, 'পঁচিশ বছর আগে আপনার যে গানের গলা বাবা তাঁর নিজস্ব ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেটে রেকর্ড করে রেখেছিলেন, অনেক চেষ্টা করেও সে ক্যাসেট আর ঠিক করা যায় নি। এও জানি, মানুষ একবার আনসাকসেসফুল হলেও বারবার হয় না। এই ক্যাসেটের সৌজন্যেই আজ এমন একটা মূহুর্তের সাক্ষী হয়ে থাকতে পারলাম...এই নিন আপনার আবেগ,আপনার সেন্টিমেন্ট..শুধু একটা ডিজিটাইজ মেশিন দরকার... তাহলে ক্যাসেট শোনায় আর কোনো বাধা থাকবে না...। '
মেশিন থেকে ক্যাসেটটা বের করে অনুকুলের হাতে এগিয়ে দিলেন ভদ্রলোক।
আওয়াজ থেমে গেছে। কিন্তু সে আওয়াজের রেশ এখনো ছড়িয়ে রয়েছে অনুকুলের বুক জুড়ে... হৃদয় জুড়ে...।
'ফেরত দিয়ে দিচ্ছেন...? সরি, ভেরি সরি.. ভুল করে অন্য ক্যাসেটটা রামনারায়ন বাবুকে দিয়ে ফেলেছিলাম সেদিন... বুঝতে পারি নি...।'
অস্ফুটে বললো অনুকুল।
'ফেরত মানে? আমার জিনিসটা তো আমি নিয়েই যাচ্ছি...।'
ব্যাপারটা বুঝতে পারে না কেউই। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে অনুকূল।
পকেট থেকে নিজের মোবাইল ফোনটা বের করে চুপিসারে রেকর্ড করা গানটা চালিয়ে দিলেন ভদ্রলোক।
'আশা যাওয়ার পথের ধারে...কেটেছে দিন গান গেয়ে মোর...' স্বরলিপি না জানা চুয়াত্তর বছরের এক কন্ঠ....।
স্মিত হাসে অনুকূল।
'কী হবে শেষবেলাকার ভাঙা সুরকে সঙ্গে নিয়ে? '
'নিজের কাছে রেখে দেবো।'
বিকেল গড়িয়ে গিয়েছে। রণোদীপের বাড়ির জানলার ফাঁক দিয়ে বেলা শেষের আলোর রেশটুকু রয়ে গেছে। মাঠে ঘাটে, পুকুরের জলে, দূরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বাঁশঝাড়ের গায়ে গায়ে পড়ে আসা বিকেলের রাঙা স্পর্শ... ধূলো মাখা পথ ধরে হেঁটে চলা মাঠচষা গোরুর পাল, জলফেরত রাজহাঁসের দল, উড়ে চলা পাখির ঝাঁক...সবাকার মাঝে যেন ছড়িয়ে আছে ঘরে ফেরার আনন্দে মিশে থাকা ক্লান্ত বাঁশীর শেষ রাগিণীর সুরটুকু...।
সুগত বাবুর কাছ থেকে ক্যাসেটটা নিয়ে সযত্নে নিজের হ্যান্ড ব্যাগে রেখে ভদ্রলোকের দিকে বন্ধুত্ত্বের হাতখানা বাড়িয়ে দিল অনুকূল। জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে ফিরে পাওয়া দুর্মূল্য উপহারটাকে হারাতে চায় না সে কিছুতেই...।
No comments:
Post a Comment