বাগানে রুপকথার একশিঙ্গা ঘোড়া
জেমস্ থার্বার
(The Unicorn in the Garden - James Thurber)
অনুবাদ: ভাস্বরজ্যোতি ঘোষ
লোকটা সবেমাত্র বাগানের ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে স্ক্র্যাম্বলড এগ দিয়ে তার ব্রেকফাস্ট শুরু করতে যাবে, চোখ তুলে তাকাতেই তার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। সোনালী শিঙের দুধ সাদা একটা ইউনিকর্ণ তার বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে! ইউনিকর্ণটার কোনোদিকে নজর নেই, নিঃশব্দে বাগানের গোলাপগুলি খেয়ে যাচ্ছে। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই লোকটা প্রায় ছুটতে ছুটতে দোতলায় ওর বেডরুমে এসে উপস্থিত হ’ল। ওর বৌ তখনো ঘুমোচ্ছে। ‘এই শুনছো।’ লোকটা তার বৌকে ডেকে তোলে। ‘আরে, শিগগির ওঠো। দেখবে এসো, একটা ইউনিকর্ণ আমাদের বাগানে এসে গোলাপ ফুল খাচ্ছে।’
‘ইউনিকর্ণ? মানে পুরাণের সেই গল্পকথার ইউনিকর্ণ আমাদের বাগানে? তোমার মাথার ঠিক আছে তো?’ প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে ওর বৌ আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। বৌয়ের পাশে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল লোকটি। তারপর ধীরে ধীরে আবার বাগানে নেমে এল। তাজ্জব ব্যাপার! ইউনিকর্ণটা এখনও বাগানেই রয়েছে। এখন ওর নজর পড়েছে টিউলিপ ফুলগুলোর উপর। লোকটা একটা লিলিফুল তুলে ডাকতে থাকে ‘ইউনিকর্ণ আয় আয়, লিলিফুল খেয়ে যা।’ ওমা! ইউনিকর্ণটা সত্যিই ওর হাতের লিলিফুলটা দিব্যি খেয়ে নিল। উফ্! একটা সত্যিকারের ইউনিকর্ণ, ওর বাগানে। ভাবা যায়! লোকটা উত্তেজিত হয়ে উঠল। ইস্! বৌটা এখনও ঘুমোচ্ছে। ‘আরে, আর কত ঘুমোবে, দেখে যাও ইউনিকর্ণটাকে। এইমাত্র আমি ওকে একটা লিলিফুল খাওয়ালাম।’ লোকটি বেডরুমে এসে ওর বৌকে আবার ডাকাডাকি করতে থাকে। একরাশ বিরক্তির সাথে ওর বৌ এবারে উঠে বসে। ‘একেবারে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছো তুমি। দাঁড়াও তোমাকে পাগলা গারদে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি আমি।’
আশ্চর্য ব্যাপার, বাগানে একটা আস্ত ইউনিকর্ণ ঘুরে বেড়াচ্ছে, কোথায় ওর বৌ আনন্দের সাথে ওর সাথে নেমে আসবে, তা না, এসব কী অপমানকর কথাবার্তা। লোকটার মোটেই ভালো লাগেনা। ‘দেখা যাবে কে বদ্ধ উন্মাদ।’ লোকটা বেডরুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে, ‘মনে রেখো একটা সত্যিকারে ইউনিকর্ণ, যার মাথার ঠিক মাঝখানে একটা সোনালী শিং আছে।’ বৌয়ের উত্তরের অপেক্ষা না করে ও বাগানে নেমে আসে। নাঃ ইউনিকর্ণটাকে তো আর দেখা যাচ্ছেনা। কে জানে কোথায় গেছে। লোকটা বাগানের পাশে বসে পড়ে। খানিক বাদে ঘুমিয়েও পড়ে। লোকটা বেরিয়ে যেতেই ওর বৌ উঠে পড়ে। ঝটপট রাতপোশাক পালটে নেয়। ওর চোখ কুটিল উত্তেজনায় চকচক করতে থাকে। সে প্রথমে পুলিশে ফোন করে, তারপরে সাইকিয়াট্রিস্টকে। ‘তাড়াতাড়ি আসুন, একটা পাগলকে ধরতে হবে আপনাদের।’ বৌটা পুলিশ আর সাইকিয়াট্রিস্ট আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
পুলিশ এবং সাইকিয়াট্রিস্ট একসাথেই এসে উপস্থিত হয়। দুজনে দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে বৌটির সামনে বসে। সন্দেহের দৃষ্টিতে তাঁরা বৌটির দিকে তাকায়। ‘জানেন, আজ সকালে আমার স্বামী নাকি বাগানে একটা ইউনিকর্ণ দেখেছে।’ বৌটি দারুণ উত্তেজিত স্বরে বলতে থাকে, ‘ইউনিকর্ণটা নাকি ওর হাত থেকে একটা লিলিফুলও খেয়েছে।’ বৌটি বলতে থাকে, ‘আর হ্যাঁ, ইউনিকর্ণটার মাথার ঠিক মাঝখনে একটা সোনালী শিং ও রয়েছে।’ পুলিশ এবং সাইকিয়াট্রিস্টের মধ্যে একটা বিদ্যুৎ চকিত সংকেতময় চোখ ঠারাঠারি হয়। পুলিশটি একলাফে চেয়ার ছেড়ে উঠে বৌটিকে জাপটে ধরে। বৌটিকে বাগে আনতে ওদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। অবশেষে বৌটিকে বেঁধে ফেলতে সক্ষম হয় ওরা। ঠিক এই সময় বৌটির স্বামী বাগান থেকে বেডরুমে আসে।
‘আচ্ছা, আপনি কি আপনার স্ত্রীকে বলেছিলেন যে আপনি বাগানে একটা ইউনিকর্ণ দেখেছেন?’
‘পাগল নাকি!’ ‘ইউনিকর্ণ তো একটা রূপকথার জানোয়ার। সেটা আবার বাগানে আসবে কী করে?’ লোকটা জবাব দেয়।
‘ব্যাস ব্যাস, এইটুকুই শুধু জানার ছিল আমাদের।’ সাইকিয়াট্রিস্ট উত্তর দেয়। ‘দুঃখিত আপনার স্ত্রী একজন বদ্ধ উন্মাদ। ওকে পাগলা গারদে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের কোন উপায় নেই।’
বৌটা প্রচন্ড গালিগালাজ করতে থাকে। কিন্তু লাভ হয় না।
স্বামী বাকি জীবন সুখে-স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে দেয়।
অলঙ্করণঃ ডাঃ সায়ন্ন্যা দাশদত্ত
অনুবাদক পরিচিতি
ভাস্বর জ্যোতি ঘোষ। ব্যক্তিগত জীবনে বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। অনুবাদ এবং মৌলিক গল্প দুটিই লিখে থাকেন। অনুবাদ গল্প এবং মৌলিক গল্প বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত। দেশ পত্রিকায় দুটি গল্প প্রকাশিত। এছাড়া বাংলায় সম্পূর্ণ অনুবাদ সাহিত্যের একিমাত্র পত্রিকা 'অনুবাদ সাহিত্য' তেও, অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। প্রিয় লেখকদের মধ্যে রয়েছেন - গ্যাব্রিয়েল গর্সিয়া মার্কেজ, জ্যাক লন্ডন,আন্তন চেকভ। বাংলায় মানিক বন্দোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়, মতি নন্দী।
No comments:
Post a Comment