শেরিং ওয়াংচুকের সাথে আলাপটা কোথায় হয়েছিলো মনে পড়ে না। তবে আলাপের সময় বয়সটা বেশ মনে পড়ে আমার। আমি তখন আঠেরো। আর শেরিং তখন সাতান্ন। অসমবয়স্ক বন্ধুর সাথে “লং ডিস্ট্যান্স রিলেশনশিপ” বজায় রাখতে বেগ পেতে হয়েছিলো বেশ খানিক। না, দুরত্ব, বয়স, বা রাজনৈতিক মতাদর্শ নয়, বেগ পেতে হয়েছিলো অতি সাধারণ একটি কারণে। তা হল মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক। তার গ্রামে এই ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’তে আজকেও হালেকালে সাকুল্যে একটি সরকারী সংস্থার নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় কেবল। তাও আবার ঘণ্টাখানেকের জন্য। সে যাই হোক, সেই সকল প্রতিকূলতা পেরিয়ে বন্ধুত্বটা টিকে যায়। এবং তার বহুবারের নেমন্তন্ন এড়াতে না পেরে এবং ওয়ান্ডারলাস্ট তাড়িত হয়ে কিছু মজাদার লোভের বশে পৌঁছে গেলাম দিল্লীতে। উদ্দেশ্য শেরিং এর বাড়ি যাওয়া। বলা হয় নি, শেরিং এর বাড়ি হল “অলচি” নামের একটি গ্রামে। পরিচিত নাম নয়। এবং সেটা স্বাভাবিক। অলচি হল কাশ্মীরের লেহ জেলাস্থিত একটি ছোট গ্রাম।
আমাকে শেরিংমুখী করেছিল একটি মাত্র লোভ। সেটা হল দিল্লী থেকে রাস্তা ধরে লেহ অবধি যাওয়া। মোক্ষম দুর্বলতা ধরতে পেরেছিল শেরিং। নতুন দিল্লী স্টেশনের বাইরে দেখা মিলল শেরিংএর। আমি পঁচিশ ছুঁই ছুঁই, আর শেরিং চৌষট্টির মধ্যগগনে। খান দুয়েক আলুর পরোটা উদরস্থিত করে, দু লিটারের ফ্লাক্সে চা ভরে রওয়ানা হলাম লেহ-র পথে।
প্রথম গন্তব্য নালাগড়। নতুন দিল্লী থেকে প্রায় তিনশো কুড়ি কিমি দূরে অবস্থিত এই নালাগড় যেতে হল আম্বালা, পিঞ্জোর পেরিয়ে। রাজা অজয় চাঁদের তৈরি রামশহর নালাগড় দুর্গ যার বয়স প্রায় হাজার হতে চলল (খুব সম্ভবত ১১০০ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত), তার স্থাপত্যশৈলী দেখে মধ্য প্রাচ্য, সনাতনবাদ এবং কিছুক্ষেত্রে পাশ্চাত্য ছোঁয়া বেশ টের পেলাম। এবং যখন শুনলাম এই মহলে থাকবার ব্যবস্থাও রয়েছে, মনে মনে দ্বিতীয়বার নালাগড় আসার ষোলআনা ইচ্ছাও বেশ টের পেলাম। সেইদিন রাত্তিরে খেলাম আঞ্চলিক মিষ্টি বাব্রু। বেশ আলুর চপের মতো দেখতে। তবে হলফ করে বলা যায় হুঁকোমুখো হ্যাংলার মুখে এক টুকরো এই বাব্রু ভরে দিলে বেশ ফুরফুরে মেজাজে একগাল হেসে জিজ্ঞেস করে বসতেই পারে “দাদা বৌদি-বাচ্চারা ভালো আছে তো?” যাই হোক সেদিন ঘুমাতে আর দেরি করলাম না।
পরের দিন ভোর বেলার গন্তব্য দুশো পঁচাত্তর কিমি দূরের মানালি। আর পাঁচজন বাঙালীর মতো আমার আবার মানালির ওই সবুজ শাড়ি পরা পাহাড় পছন্দের নয় কোনদিনই। আমার পছন্দ মূলত মানালির লুগড়ি। নাক সিটকানো এলিট সোসাইটির আঁতেল বন্ধুদের ভাষায় “মানালির ধেনো”। আমি বরং প্রেম ধুমল নামে আঞ্চলিক এক বন্ধুর থেকে “রাইস বিয়ার” নামেই নিলাম। সাথে প্রেমের প্রেমভরা উপহার ছিল “মালানা” গ্রামের স্পেশাল মধুকাঠি। ভাই আমার প্রেম থেকে প্রেমিক হয়ে গেল সেদিন। ঘোর কাটল শেরিংএর ডাকে। আমার জন্য জোগাড় করা হয়েছে লোয়ার ম্যালের “সিদ্দু আর ভেয়”। নাম শুনে চোখ কপালে ওঠার উপক্রম অনেকেরই। কিন্তু বলে রাখা ভালো এই সিদ্দুরই একটি চীনে সংস্করণ শনি রবিবার টেরিটি বাজারে নিকোলাসের ঝুলিতে পাওয়া যায়। বেকড মোমো নামে সুপরিচিত। আর ভেয় হল পদ্মগাছের কাণ্ড ডুমো ডুমো করে কেটে বেশ মশলা মাখিয়ে সুপাকে আঞ্চলিক মানুষজনের স্বপাকে রান্না। এই সিদ্দুর এক পিসের ওজন প্রায় পঁচাত্তর গ্রামের কাছাকাছি। আমি সেদিন “প্রেমময়” উপহারের আশীর্বাদে চারটে সিদ্দু আর দেড়শ গ্রাম ওজনের “ছোটু গুলাবজামুন” উদরস্থ করে হিড়িম্বা মন্দিরের সামনের দুধওয়ালার থেকে একটা বড় ভাঁড় কেশর দুধ আর গোটা চারেক জিলিপি খেয়ে “পেটটা ঠিক ভরল না” বলে ঘুমাতে গেলাম। পথে পেছনে ফেলে এলাম মান্ডি, বিলাসপুর, কুলুর মতো কিছু স্মৃতি।
পরের দিন ঘুম ভাঙল ধাক্কা খেয়ে রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ।বেরতে হবে নতুন গন্তব্যে।
হিমাচল প্রদেশের শেষ গ্রাম, জিস্পা। শেরিং আগেভাগে আমার মতো “স্বল্পাহারী” বন্ধুর রাস্তার খোরাকের জন্য তুলে এনেছিল খান আটেক সিদ্দু এবং দুটো বোতল খালি করে ভরিয়ে নিয়েছিল “লুগড়ি”। আমার তন্দ্রাভাব কাটল ভোর পৌনেপাঁচটা নাগাদ। মানালি থেকে জিস্পার দুরত্ব বেশী নয়। একশো চল্লিশ কিমি মতো। কিন্তু রাস্তা বড্ড বেশী দুর্গম। মানে ওই “ডিজিটালাইজেশন” বিশেষ হয় নি বোঝা গেলো। রোটাং-এর কাছাকাছি এসে আমি অনুভব করলাম গাড়ির ড্যাশবোর্ড থেকে খুব চেনা একটা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তড়িঘড়ি করে খুলতেই দেখি চারজোড়া সিদ্দু আমার দিকে লাজুক চোখে তাকিয়ে আছে। আমি আর “হেঁহেঁ, এসবের কি দরকার ছিল” না করে একটা তুলে কামড় বসিয়ে দিতেই মশলাভরা পুরের কিছুটা আমার কশ বেয়ে দাড়ির দিকে এগোতে লাগলো। যাই হোক আমার জিভ আর সেই অমৃতকে দাড়ির সাথে প্রেমে লিপ্ত হতে না দিয়ে আপন সুখের সংসারে, মানে মুখের ভেতর চালান করে দিলো। বেশ শাজাহান ফিল নিয়ে বললাম “নাজুক”। শেরিং আমার দিকে তাকিয়ে কি বুঝল ছাই বুঝলাম না। খালি শিশুসুলভ একটা হাসি হেসে বলল “জুলে”। মানে কিনা “স্বাগতম”। ভাগাভাগি করে সিদ্দু খেতে গিয়ে বুঝলাম আমি জলখাবারের সময় হওয়ার আগে তিনটে সিদ্দু খেয়েছি। সাথে একটি দু লিটারের বোতলভর্তি লুগড়ি প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। সাথে গাড়িতে চলছে মুলবেক ভাষার লোকগান “ওয়াখায় ডাকবু”। রোটাং পৌঁছে বোঝা গেলো আর এগোবার জন্য অপেক্ষা করতে হবে বেশ কিছুক্ষণ। ক্লাউডব্লাস্ট। আকাশ ফাটানো বৃষ্টি। অগত্যা দাঁড়াতে হল কিছুক্ষণ। বৃষ্টি থামল প্রায় আধঘণ্টা পরে। ততক্ষণে ট্রাফিকের অবস্থা দেখে “হেস্টিংস” ভেবে নেমে পড়তে যাব। শেরিং আমাকে থামিয়ে মনে করাল যে আমি পাহাড়ের কোলে। মাঝপথে লাহুল-স্পিতি নামের একটি গ্রামের কিছুটা ভেতরে একটা ছোট খাবারের দোকানে রুটি, ডিমভাজা, পাঁপড় পোড়া খেয়ে আরও কিছুটা প্যাক করিয়ে নিলাম রাস্তার জন্য। জিস্পা পৌঁছালাম কেলং, গোলাবা, দারচা এরকম কিছু গ্রাম পেরিয়ে। জিস্পার বড় অপরূপ সৌন্দর্য। একদিকে গ্রেটার হিমালয়ের মলাট, অন্যদিকে পির-পঞ্জাল দিয়ে মোড়া। আর মন ভরাবার জন্য স্পিতি-চন্দ্র ওয়াটারশেড একাই কাফি। সূর্যের ডুবন্ত আলোয় এই জায়গাটিকে মনে করলে একটা কথাই মাথায় আসে। “অগর ফিরদউস বারুয়ে জমিন অস্ত/হামিন অস্ত, হামিন অস্ত, হামিন অস্ত”। জিস্পাতে খাবার পাওয়ার সমস্যা শেরিং স্থানীয় হওয়ার সুবাদে জানত। তাই গাড়ি হাতড়ে বের করলো তিনটে সিদ্দু, লাহুল থেকে কেনা আটখানা রুটি, ডিমের ভুজিয়া আর পাঁপড় পোড়া। আঞ্চলিক সংযোজন বলতে স্থানীয় গলা জ্বালানো আচার আর স্থানীয় গুরদ্বারা থেকে ঘি চপচপে হালুয়া প্রায় আড়াইশো গ্রাম। উদরপূর্তি সেরে বাকি থাকা এক বোতল লুগড়ি গলাধঃকরণ করে ঘুমের হাতে আত্মসমর্পণ করলাম।
পরদিন ভোরবেলাতে রওনা দিলাম। গন্তব্য লেহ। দূরত্ব প্রায় তিনশো তিরিশ কিমি। যাতে পৌঁছাতে দেরি না হয় সেই কারণে সকাল ছটার ভেতর বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় বারালাচা লা পার করে ষোলহাজার ফুট ওপরে পাহাড়ের কোলে ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ সারলাম গুড়গুড় বা লাদাখা চা আর শাম্পা দিয়ে। এই গুড়গুড় নামের পেছনে একটা বড্ড মজাদার কারন আছে। যে যন্ত্রটাতে চা, চমরীর দুধ, মাখন আর নুন মেশানো হয় তার আওয়াজ হয় গুড়গুড় করে। যে কারনে চায়ের নাম গুড়গুড়। আর শাম্পা হল স্থানীয় একধরনের ভুট্টা দিয়ে বানানো ছাতু। গাড়িতে খাওয়ার জন্য নিয়ে নিলাম আরও কিছুটা শাম্পা আর ফ্লাস্কে সেই গুড়গুড়। পাং ভ্যালী যেতে না যেতে বিপত্তি। সকালে বেরোবার আগে খাবার জল নিতে ভুলে গেছি। খাবার জল প্রায় শেষ। গলা শুকিয়ে কাঠ দুজনেরই। টাংলাং লা পৌঁছে কিছুটা স্বস্তি পেলাম একটা ছোট গুমটি দোকান দেখে। এই সতেরোহাজার ছশো ফুট উঁচুতেও মানুষের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থাপনা দেখে কে বলবে যে মানুষ কেবল পেট চালাবার জন্য নীচে নামে। অনেকক্ষেত্রে ওপরেও ওঠে। ভাগা নদীর সঙ্গ নিয়ে এগোতে থাকলাম লেহ এর দিকে। এই ভাগা নদীই চন্দ্রভাগা কিনা সেটা জানা হয় নি । থাক না অঞ্চলের মানুষের স্নেহভরা ডাকনাম নিয়ে। জন্মপরিচয় জেনে লাভ কি। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ ঢুকলাম লেহতে। এইখানে এসে পড়লাম আরেক বিপদে। মোবাইল নেটওয়ার্ক উন্নয়নের মতই উধাও। অগত্যা ভার্চুয়াল সভ্যতা থেকে অনিশ্চিত কালের জন্য বিদায় নিলাম।
পরের দিন বেরলাম লেহ চত্বরে টহল দিতে। তবে লেহর মেন মার্কেটের থেকে গোল মার্কেট অনেক বেশী আপন মনে হল। একে একে ঘুরলাম শান্তি স্তুপ, হেমিস গুম্ফা, শঙ্কর গুম্ফা, ফ্যাং গুম্ফা, সিন্ধু ঘাট, স্পিটুক গুম্ফা। সেদিন “ঠিক সন্ধে নামার আগে” স্থানীয় যাত্রা শেষ করলাম লেহ প্যালেসের সামনে। আকবর বলে একজনের গুমটিতে সেইদিন বিকালের টিফিন সারলাম চমরীর দুধের চা আর নানখাটাই নামক স্থানীয় বিস্কুট দিয়ে। আকবরের সাথে খাবার দাবার নিয়ে আলোচনা এমন দার্শনিক পর্যায়ে উন্নীত হল যে একটা প্যাকেটে বেশ কিছু ছুপ্রি বা চমরীর দুধের জমাট বাঁধা মাখন দিয়ে দিলো। আমিও আমার সঙ্গে নিয়ে যাওয়া বেনারসের পান মশলার আধ কৌটো তার হাতে দিলাম বন্ধুত্বের স্মৃতি হিসাবে। এক খাবলা পান মশলা মুখে পুরে আমার দিকে তাকাতেই বুঝলাম এই বান্দা কেবল ছুপ্রি দিয়ে ছাড়বার লোক নয়। দাওয়াত পেলাম রাত্তিরবেলায়। আরেকজন অসমবয়স্ক বন্ধু পাওয়া গেলো। রাত আটটা নাগাদ একদম বাংলা খাদির পাঞ্জাবী আর জিন্সের প্যান্ট পরে, গায়ে একটা শাল চাপিয়ে হাজির হলাম আকবরের বাড়িতে। ভেতরে ঢুকে আমার চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার জোগাড়। শুরুর চা খাবার আয়োজন দেখে যা বুঝলাম এটা শেষ করতেই আমার লেগে যাবে প্রায় দেড় ঘণ্টা। অগত্যা, সোনামুখ করে শুরু করলাম। প্রথমেই কাপে পড়ল কাশ্মীরী কাওয়া, প্রায় সাত ধরনের স্থানীয় বিস্কুট, তিন রকমের পকোড়া, এবং প্রায় সেউ ভাজার মতো করে ভাজা আলু ভাজা। এসব শেষ করতে বাজল রাত পৌনে দশটা। মজার বিষয় হল যে আমি এই সব শেষ করার পরে জানতে পারলাম এইসব কেবলমাত্র স্টারটার ছিল। একপর এলো মেইন কোর্স। প্রথম পাতে দেওয়া হল টিমো বা টিগমো। এটা খেয়ে একরকম পুর ছাড়া পাউরুটি লাগলো। সঙ্গে ছিল বেশ ঝাল ঝাল মশলা দেওয়া দুম্বার মাংসের স্টু। এরপর ছিল থুকপা। অবশেষে বাঙালীর “মোমো চিত্ত” ভরাতে ছিল মোকথুক। হালকা মশলার পাতলা ঝোলে হাবুডুবু খাচ্ছে ফর্সা ফর্সা গোলগাল কটা মোমো। শেষ পাতে আর এক কাপ কাওয়া খেয়ে রওনা দিলাম ঘুমাবার উদ্দেশ্যে।
পরের দিন সকালে ঘুমটা শেরিং ডাক দেওয়ার আগেই ভেঙে গেলো। বেশ বুঝতে শুরু করেছি যে বাউন্ডুলেপনা আমার ঘাড়ে চেপে বসেছে। প্রস্তুতি সেরে দেখি শেরিং কাশ্মীরের স্থানীয় জংলা গোলাপের “সুওক” আতর অফার করছে। এতো হালকা গন্ধের আর এতো দীর্ঘস্থায়ী আতর এর আগে চোখে পড়ে নি। আতর নিয়ে এতো খুঁতখুঁতে হওয়া সত্ত্বেও তারিফ না করে পারলাম না। সুওক ছিল সুলতান বাবরের খাস আতর। আরবি গোলাপের তেল। তারই নাতিপুতি মনে হল এই সুওককে। আজ গন্তব্য প্যাংগং। লেহ থেকে প্রায় তিনশো কিমি দূরের রাস্তা। রওনা দিলাম ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ। কিছু সময় যাওয়ার পরে রাস্তায় পেলাম থিকসে গ্রামের থিকসে গুম্ফা। মৈত্রেয় বুদ্ধের প্রায় পনেরো মিটার মূর্তিটি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার মতো। অদ্ভুত বাস্তুকারিতা মগজধোলাই করতে যথেষ্ট। এখানে এসে জলখাবার খেলাম। বোতল ভরে নিলাম। ফ্লাস্ক ভরে নিলাম গুড়গুড়ে, সাথে দুপুরের খাবার নিয়ে নিলাম, খাম্বির আর ডিমের ভুজিয়া। খাম্বির হল স্থানীয় এক রকম রুটি আর পাউরুটির মিশেল।এগোতে থাকলাম। গাড়ি এবার থামল চাংলাতে। চাংলা গিয়ে প্রথমবার বেশ কষ্ট হল। পরে শুনলাম উচ্চতার কারণে এই সমস্যা। প্রায় সতের হাজার চারশো ফুট উঁচুতে এই রাস্তাটি। একটু এগিয়ে গিয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে নিলাম। তারপর ইন্দো-চাইনিজ বর্ডার বরাবর যেতে যেতে প্যাংগঙের কিছু আগে দেখি একটা ছড়ান মাঠের সবটুকু জুড়ে বহু গর্ত। এখানে শেরিং গাড়ি থামিয়ে নামতে বলল। বলে “কুছ ছোটাসা দোস্ত হ্যায় ইয়াহা পে, উতরকে মিল লিজিয়ে”। দেখি বাংলা-ভোঁদড়ের থেকে আয়তনে কিছুটা ছোট প্রাণী। বেশ নির্ভীকচিত্তে মনোরঞ্জন করে যাচ্ছে। সামনে একটু সাহস নিয়ে যেতে দেখি বেশ মিষ্টি একজোড়া গোঁফ আছে। আমাকে দেখে কি জানি কেন দাঁড়িয়ে গেলো। আমার গোঁফ দেখে দেশোয়ালি দোপেয়ে ভাই ভেবেছে হয়তো। বেশ কিছু ছবি তুললাম। এবং পেশাদার মডেলের মতো তারাও বেশ পোজ দিলো। ওদিক থেকে শেরিংএর তাড়া পড়েছে। “আপ ক্যা আজ ইয়েহি পর রহেঙ্গে?” মানে তুমি কি আজ এখানেই থাকবে? অগত্যা ক্ষুদে “দেশোয়ালি” বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে রওনা দিলাম প্যাংগং এর দিকে। পরে জানতে পারলাম তাদের নাম মারমট। পাহাড়ের কোলে অদ্ভুত এক সুন্দর মিষ্টি জলের ঝিল। অদ্ভুত এই প্রকৃতির খেলা। প্যাংগং থেকে এগিয়ে কিছুদুর যেতে বেশ কিছু তাঁবু চোখে পড়ল। আধুনিক সুযোগ সুবিধা বেশ আছে এখানে। সঙ্গে লোভনীয় অফার হল “ফ্রি ওয়াইফাই”। আমার প্রয়োজন পড়ে নি তার বিশেষ। কারণ সামাজিকভাবে আমি তখন আইসোলেটেড। অগত্যা টানা ঘুম লাগালাম। সে ঘুম ভাঙতে ভাঙতে পরের দিন। প্রস্তুতি সেরে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট শেষ করে রওনা দিলাম সোমোরিরির দিকে।
রেজাংলা পার করতে না করতে মেঘ কালো হতে থাকল। সঙ্গে শেরিং এর মুখের বলিরেখাগুলো প্রথমবার স্পষ্ট ভাবে দেখা দিলো। তারা থেকে চব্বিশ কিমি আগে রোহিত পোস্টে পৌঁছাবার আগে আকাশ থেকে টুপটাপ বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। শেরিং গাড়ির স্পিড বাড়াল। চুশুল বা চুছুলে সেই আকাশ ভয়াবহ রূপ নিল। সাথে প্রতি মিনিটে কমতে থাকল পারিপার্শ্বিক উষ্ণতা। হাওয়ার বেগ গাড়ি এগোতেই দেয় না। এমন সময় দেখি ঘোড়ার মতো এক প্রাণী ওই বিশাল মরুভূমির কর্ণ বরাবর দৌড়ে যাচ্ছে। সোকর হ্রদের পথে মরুভূমির বুকে এমন প্রাণী নাকি দেখা যায় একমাত্র। এই রেড ডাটা বুকভুক্ত বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর চামড়া বড্ড মখমলি আর তেমন মজবুত। সোকর লেক হল নুনের ঝিল। একই গঠনের পাথরের বুকে আলাদা স্বাদের জল মনে হয় কেবল হিমালয়েই পাওয়া সম্ভব। বৃষ্টি থামল সোমোরিরির একশোকুড়ি কিমি আগে সাগাতে থাকাকালীন। এই যাত্রাপথে সব থেকে চমক দিয়েছে অমিত রঞ্জন দাস। হাওড়া জেলার হাঁসখালিপোলের ছেলেটি চাংথাঙ্গের সিকিউরিটির দায়িত্বে। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করা এই জওয়ানের বয়েস সাকুল্যে একুশ কি বাইশ। কেমন ভাসাভাসা চোখ আর হাতে কালাশনিকভ নিয়ে বড্ড বেমানান লাগছিল ছেলেটিকে। সেইখানে আড্ডায় কেটে গেলো প্রায় ঘণ্টা দুয়েক। বন্ধুত্বের উপহার স্বরূপ দিয়ে এলাম বাড়ি থেকে আনা এক কৌটো মুড়ি আর টক ঝাল মিষ্টি চানাচুর মেশানো সাথে এক প্যাকেট প্রজাপতি বিস্কুট। বড্ড সাধারন উপহার পেয়ে যেন একটুকরো ঘর খুঁজে পেল অমিত। “আবার দেখা হবে” এমন মিথ্যে প্রতিশ্রুতি ছাড়াই বিদায় নিলাম অমিতের থেকে। কপাল থাকলে আবার দেখা হবে। অবশ্যই দেখা হবে। তারা পোস্টে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আকাশ আবার পরিষ্কার হয়ে গেলো। সন্ধ্যে নামতে নামতে পৌঁছে গেলাম সোমোরিরিতে। সেই একই পাথুরে অঞ্চলে এবার পেলাম নোনা জলের ঝিল। সেইখানেও আশ্রয় নিলাম স্থানীয় অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধাযুক্ত তাঁবুতে। সেখানে চমক পেলাম তাঁবুর মালিকের থেকে ডিনারের সময়। একদম ঘরোয়া ভাত, মাখন আর ডিমের অমলেট। সেইদিন হয়তো প্রথমবারের জন্য বাড়ির বাতাবরণ মিস করলাম। যাই হোক পরের দিন ফিরতে হত আবার লেহতে। অগত্যা দেরী না করে ঘুমাতে গেলাম।
পরদিন সকালে জলখাবার প্যাক করিয়ে নিয়ে চললাম আবার লেহ শহরে। এক এক করে পেছনে ফেলে আসতে লাগলাম সব স্মৃতি। লেহ পৌঁছালাম বিকাল হওয়ার কিছু পরে। আজ কেবল মাত্র ফুডওয়াক আগে থেকেই শেরিং জানিয়ে রেখেছিল। সুতরাং গিয়েই শুরু হল খাদ্য-খাদকের সম্পর্কস্থাপন। সেই রাত্রের দাওয়াত হয়তো সারা জীবনে ভোলার নয়। প্রথমে লেহতে মোমো খেতে একটু নাক সিটকাচ্ছিলাম বটে। তবে শুরু করলাম মোমো দিয়েই। এবং সেই মোমো মুখে পড়তেই মনে হল, এই জিনিস না খেয়ে থাকলে সমাজ ক্ষমা করত না। এই স্বাদ এর আগে আমি কোলকাতার কোথাও পাই নি। এরপর আবার সেই মোকথুক। আকবরের দাওয়াতে বড্ড পছন্দ হয়েছিলো এই খাবারটি। এরপর যে খাবারটি এলো বেশ দেখেই অমায়িক লাগলো। নাম হল স্কায়ু। একধরনের স্যুপের ভেতর মাংস এবং আনাজপাতি দিয়ে তৈরি বল সাঁতরাচ্ছে। স্টারটার হিসেবে বেশ লোভনীয় এবং উপাদেয়ও। এরপরে খেলাম খাম্বির দিয়ে কাওয়া। অদ্ভুত কম্বিনেশন একটা এটা। মন ভরাবার জন্য একটা খাম্বির যথেষ্ট। তখন রাত সাড়ে আটটা। এরপরে অপেক্ষা করছিল পাবা আর টাংটুর। পাবা একধরনের পাঁপড়ের মতো রুটি। টাংটুর খেয়ে মনে হল ঘন দুধে বেশ কিছু আনাজ আর মশলা দিয়ে ফোটানো এক ধরনের পেটভরানো তরকারী বিশেষ। খাবারের ভেতর সবশেষে এলো গোস্ত রিশতা। কেবল মাত্র দুম্বার মাংসের কিমা দিয়ে বানানো মাংসের বলকে কাজু, পেস্তা, আখরোট, মেওয়া, কাঠবাদাম, চমরীর কাঁচা দুধ আর লঙ্কাবাটা দিয়ে জয়িত্রী-জায়ফল-ক্যাওড়ার জল- গোলাপজলের বাষ্পে বানানো এক দেবভোগ্য জিনিস এই রিশতা। এক একটা মিটবলের ওজন প্রায় পঁচাত্তর গ্রামের কাছাকাছি। পেট ভরে যাওয়া সত্ত্বেও খানতিনেক রিশতা উদরস্থ করলাম। তখন রাত দশটা বেজে গেছে। লেহর ম্যালে মানুষজনের থেকে শ্বাপদের সংখ্যা আনুপাতিক হারে বেড়েছে। এবার লেহ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে এই যাত্রায় শেষ রাত। শেরিং এনে হাজির করলো দুবোতল ছাং। লেহ উপত্যকার যব থেকে তৈরি একধরনের “আমার ভাষায়” বলবর্ধক ওষধি আর “ভদ্দলোকের ভাষায়” ষবের “ধেনো”। প্রথমবার স্বাদ নিতেই বেশ মখমলি স্বাদ পেলাম। গলায় লাগে না। আপনমনে গলা দিয়ে নেমে মিশে যায় দেহঘড়ির কলকব্জায়। পরের দিনের কথা ভেবে এক বোতলের বেশী আর রিস্ক না নিয়ে কম্বলের তলায় আশ্রয় নিলাম।
পরের দিন ঘুম ভাঙল আটটার পরে। এদিকে শেরিং দেখি চিন্তিত মুখে প্রায় পঞ্চাশ মিটার ব্যাস জুড়ে গোল গোল পায়চারী করছে। তাকে অভয় দিয়ে রেডি হতে সময় নিলাম ঝাড়া কুড়ি মিনিট। সাথে নিলাম গতরাত্রের সেই “বলবর্ধক” ওষধি। ব্যাগপত্তর কাঁধে চাপিয়ে সেই যাত্রার জন্য লাদাখকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম নুব্রা উপত্যকার উদ্দেশ্যে। দূরত্ব প্রায় একশো কুড়ি কিমি। যাত্রাপথে বিপত্তি না হলে কিসের বাঙালি আমি। অগত্যা বিপত্তিও এলো হেসেখেলে। এবার বিপত্তির নাম খারদুং লা। পৃথিবীর উচ্চতম যানচলাচলের রাস্তা। উচ্চতা প্রায় আঠেরো হাজার তিনশো আশি ফুট। এবং পরবর্তী “উদয়শঙ্কর সরণী” চলল প্রায় পনেরো কিমি। এই নামকরণটি আমার করা। কারন এই রাস্তা অতিক্রম করতে গিয়ে যে পরিমাণ ঝাঁকুনি খেয়েছি, নিজেকে ওনার সঙ্গে ছাড়া অন্য কারোর সাথে তুলনা করতে ইচ্ছা করছিল না। এই গা ব্যথা কমাতে শেষমেশ সহায় হল সেই “বলবর্ধক”। আধ বোতল শেষ করার পরে বেশ চাঙ্গা লাগতে শুরু করলো নিজেকে। বিকাল নামার আগে পৌঁছে গেলাম ডিস্কিট। হাত মুখ ধুয়ে যতটা সম্ভব পরিষ্কার হয়ে প্রবেশ করলাম ডিস্কিট গুম্ফায়। এই গোটা যাত্রাতে খাবার ছাড়া অন্য যদি কোনকিছু আমাকে প্রথম দর্শনে মুগ্ধ করে থাকে, তা হল অত্যাবশ্যকীয়ভাবে এই বত্রিশ মিটার উঁচু মৈত্রেয় বুদ্ধের প্রশান্ত মূর্তিখানি। প্রতিবেশি দেশের শয়ক নদীর দিকে মুখ করে যেন মৈত্রেয় বুদ্ধ বিশ্ব শান্তির ডাক দিচ্ছেন। সেইদিন আর কিছু দেখে ওই স্মৃতিকে আবছা করতে ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু শেরিং নাছোড় যে সে আমাকে একবার লামার পিঠে চাপাবে। সারল্যভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে ভারত-পাক যুদ্ধ বন্ধ করে দেবে। আমি তো নিমিত্ত মাত্র। অগত্যা যেতে হল নুব্রা ভ্যালিতে। লামার পিঠে বসে আমি যত না আনন্দ পেলাম ততোধিক আনন্দ পেল যেন মধ্য পঞ্চাশের কিশোর শেরিং ওয়াংচুক। তারপর সেই রাত্রে আরেক চমক অপেক্ষা করছিল যেখানে থাকার ব্যবস্থা হচ্ছিল সেখানে। ওদের রাঁধুনি হঠাৎ বেরিয়ে এসে আমাকে প্রশ্ন করায় চমকে গেলাম “আলুপোস্ত খাবেন নাকি? সঙ্গে ডিম ভেজে দিই?” ভদ্রলোক পেটের টানে সুদূর ঘাটাল থেকে এসে ঘাঁটি গেড়েছেন ডিস্কিটে। এখানে না বলার কোন প্রশ্নই আসে না। সাথে বাঙালিয়ানার খাতিরে আবদার করে বসলাম যদি একটু চাটনি পাওয়া যায়। ভদ্রলোক বরাভয়মুদ্রা দেখিয়ে হেঁশেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। মনে মনে হাসলাম। কে বলে বাঙালি ঘরকুনো? সেদিন খেতে বসে আবার মনে পড়ে গেলো ঘরের কথা। ভদ্রলোক এখানে আছেন প্রায় কুড়ি বছর। অথচ আলুপোস্ত রাঁধার মুন্সিয়ানা কমে নি। আর প্রাপ্তিযোগ বলতে সেদিন টমেটোর চাটনিতে বেশ কয়েকটুকরো খেজুর পড়েছিল। শেরিংএর এই টমেটোর চাটনিতে খেজুরের বিষয়টা বোধগম্য হয় নি। সে বোঝাতে যাইও নি আর। টমেটোর চাটনিতে খেজুর-আমসত্ব একটু না মিললে তো তা টমেটো কেচাপ খাওয়ার সমতুল। সেইদিন সেই ভদ্রলোকের সাথে গল্প সেরে ঘুমাতে বেজে গেলো রাত বারোটার কাছাকাছি। নাম মনে নেই আজ। তবে “সামন্তদা” হয়ে স্মৃতির মণিকোঠায় উজ্জ্বল হয় থাকবেন তিনি।
পরদিন ভোরবেলায় বেরিয়ে পড়লাম। টিফিন করে দিলেন সামন্তদা। ডজনখানেক গরম লুচি আর আলুর দম। সাথে গতরাতের বেঁচে যাওয়া চাটনি কিছুটা। কিছুতে বকশিশ নিলেন না মানুষটা। খালি এই বিশ্বাসটুকু রেখে বিদায় দিলেন যে আবার কোনও না কোনও প্রান্তে দেখা হবে। গন্তব্য কার্গিল। প্রথম যেখানে গাড়ি দাঁড়াল জায়গাটার নাম চম্বা গুম্ফা। পাথর খোদাই করে প্রায় তিনতলা বাড়ির সমান বুদ্ধমূর্তি। আর বিশেষত্ব হল একটি মাত্র পাথর কুঁদে এই মূর্তি তৈরি আর এখানে পুজো পদ্ধতি হিন্দুধর্মের সাথে বেশ কিছু অংশে মেলে। এখানে জলখাবার সেরে নিলাম। আর দুপরের জন্য কিছুটা রাখলাম। এরপরে যেখানে থামলাম সেখানে গিয়ে বেশ কিছুটা আশ্চর্য হলাম। জায়গাটির নাম আর্যগ্রাম। এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক মুল্য নির্ধারণ সম্ভব নয় আমার পক্ষে। কথিত আছে আলেকজান্ডার গ্রীসে ফিরে যাওয়াকালীন তাঁর একদল সৈন্য থেকে গিয়েছিল এই দেশে। আর অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শিতা বিশেষে স্থাপন করেছিল কিছু গ্রামীণ সভ্যতা। সেই গ্রামগুলির ভেতর অন্যতম হল ধা, হানু, বিয়ামা, দারচিক, গারকুন, তুরতুক। এর মধ্যে তুরতুক উনিশশো একাত্তর সালে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সেইবার যাওয়া হয়ে ওঠে নি। আমি যখন পৌঁছালাম তখন বিকালের আগের মুহূর্ত। আর খোবানি বা অ্যাপ্রিকর্ট তোলার সময়। গ্রামে ওঠার জন্য সামান্য ক্লাইম্ব করতে হল। সঙ্গে নিলাম বেশ কিছু তাজা খোবানি। এখানেও একটি সঙ্গিনী জুটল আমার। ছয় বছর বয়স্কা এবং পিসিমা মনস্কা তাঞ্জিম পাল্কিত নামের একটি পাহাড়ি ঝর্ণার মতো প্রাণোচ্ছল মেয়ে। সে হেঁটে হেঁটে পুরো গ্রামখানা ঘুরিয়ে দেখাল। এবং যাওয়ার বেলায় তার দাবী ওই বয়সী আর পাঁচটা বাচ্চার মতো চকলেট বা উপহার ছিল না। দাবী ছিল যেন তার বাড়িতে থেকে যাই। সে আমার সাথে খেলা করবে। পরে মনে হল বড়সড় সাইজের ভালুক ভেবে খেলার সাথী বানাবে ভেবেছিল হয়তো। যাই হোক, সেই যাত্রায় তাঞ্জিমকে ভারী মন আর চোখের কোনে জল নিয়ে বিদায় জানালাম। না, তাকে একটিও চকলেট নেওয়ানো যায় নি। আমরা অদৃশ্য হওয়া অবধি তাঞ্জিমকে একটা শুকনো খোবানির ডাল হাতে এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। সিন্ধুতীর বেয়ে সোজা পৌঁছে গেলাম কার্গিল। পথে ফেলে এলাম মুলবেক, ম্যাগনেট হিল। সেখানে রাত্রিবেলায় ডিনার সারলাম পাত্থরসাহিব গুরদ্বারার লঙ্গড়ে গরম রুটি, ছোলার ডাল, তরকারী, হালুয়া আর দুধ সহযোগে। সেই রাত্রে কার্গিলেই থাকবো ঠিক করলাম। বেশ বুঝতে পারছিলাম যে এই ওয়ান্ডারলাস্ট নামক খুড়োর কল শেষদিকে চলে এসেছে। যাত্রা শেষের পথে।
পরের দিন আমার ঘুম ভাঙতে দেরী হল বেশ কিছুটা। বেরলাম দশটা নাগাদ। গন্তব্য দুশো দশ কিমি দূরের শ্রীনগর। জোজি লা পার করার সময় সেদিন আর কষ্ট হয় নি। পেছনে দ্রাস ভ্যালিকে ফেলে সন্ধ্যা নামার ভেতরে পৌঁছে গেলাম শ্রীনগর। সেই রাত্তিরে কাশ্মীরী ওয়াজবানের লোভ ছেড়ে একটা বাঙালি হোটেল খুঁজে বের করলাম। প্রায় তেরোদিন পরে আবার সেই ডাল-ভাত-আলুসেদ্ধ-মাছের ঝাল-চাটনি-পাঁপড় খেয়ে সেইদিন গা এলিয়ে দিলাম বিছানায়। শেরিং অদ্ভুত রকমের চুপচাপ হয়ে গেছে বিগত কিছু ঘণ্টা ধরে।
পরদিন বেশ ক্লান্তি নিয়ে উঠে প্রস্তুত হলাম। গন্তব্য অমৃতসর। দূরত্ব প্রায় সাড়ে চারশ কিমি। প্রথম থামলাম পাটনিটপে। জলখাবার গাড়িতেই সেরেছিলাম শুকনো খাবার দিয়ে। এবার পাটনিটপে রুটি আর ডাল-মাখনি খেয়ে কিছুটা উদরপূর্তি করে আবার রওনা দিলাম। রাস্তা বেশ সুন্দর। কিন্তু পাহাড়ের সংখ্যা যত কম হতে লাগলো আমার মন তত বেশী ভারী হতে শুরু করলো। অমৃতসর পৌঁছাতে বেশ রাত হয়ে গেলো।
পরের দিন ঘুম থেকে উঠতে বেশ কষ্ট হল। কিন্তু বেরতে তো হবেই। দিল্লী পৌঁছে শেরিংকে বিদায় জানাবার সময় ঘনিয়ে এসেছে। ও ফিরে যাবে ওর পরিবারের কাছে। বেরিয়ে পড়লাম দিল্লীর উদ্দেশ্যে। গল্প বাড়তে লাগলো। শেরিংএর ঘর-বাড়ি-সন্তান-সন্ততি সবার গল্প চলতে থাকলো। ওর আসাম রাইফেলসে কাজ করাকালীন কোলকাতাতে ঘুরতে আসার সময় সেই সব রাস্তার খোঁজ খবর সব নিতে নিতে পৌঁছে গেলাম দিল্লীতে। তখন বেশ রাত। কোনোক্রমে দুটো খেয়ে ঘুম দিলাম। পরের দিন দুপুরের ট্রেন।
ঘুম ভাঙল পরদিন বেলা নটা নাগাদ। জলখাবার সারা হল আলুর পরোটা দিয়ে। এবার শেরিংকে বিদায় জানাবার পালা। এক অদ্ভুত আবেগঘন মুহূর্ত এটা। হয়তো মুহূর্তকে কিছুটা হালকা করার জন্যই ওর শতছিন্ন ঝোলা থেকে সুওকের আতরটা বের করে আমার গলায় একটু ঘষে দিলো। আমার সাথে হাত মিলিয়ে বিদায় নেওয়ার পর আমার দিকে একটাবারের জন্যেও ফিরে তাকাল না শেরিং। ওর চোখের অবস্থা কি ছিল আমার অজানা।কিন্তু আমার চোখ বেশ ঝাপ্সা হয়ে গেছিল।
No comments:
Post a Comment