রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পূর্ববঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশ
খালিদ আল হাসান
মৃত্যুকালে দ্বারকানাথ ঠাকুর যেমন অগাধ বিষয়সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন, তেমনি রেখে গিয়েছিলেন প্রচুর ঋণ। সে-দেনা শোধ করতে দেবেন্দ্রনাথকে বিক্রি করে দিতে হয় বহু সম্পত্তি, এমনকি বাড়ির আসবাবপত্রও। তারপরও যা রয়ে যায়, তা সামান্য নয়: উড়িষ্যায় তিনটি এবং পূর্ববঙ্গে তিনটি জমিদারি। সম্পত্তি এজমালি, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক দেবেন্দ্রনাথ। এক সময়ে তিনি যখন আর নিজে জমিদারি দেখাশোনা করতে চাইলেন না, তখন সে-ভার দিলেন জ্যেষ্ঠ জামাতা সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়কে। রবীন্দ্রনাথের বিয়ের দিনে শিলাইদহে মৃত্যু হয় সারদাপ্রসাদের। এবারে দায়িত্ব পড়ে জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথের ওপরে। তিনি দানধ্যান করে, খাজনা মওকুফ করে, লোকসান ঘটিয়ে আসেন এবং তাঁর পুত্র দীপেন্দ্রনাথকে দেন জমিদারি দেখতে।
দীপেন্দ্রনাথ খুব গুছিয়ে কাজ করতে পারেননি। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সবচেয়ে প্রতিভাবান সন্তান কনিষ্ঠ পুত্রকে বিয়ের দুই দিন আগে ২২ অগ্রহায়ণ ১২৯০ বঙ্গাব্দে একটি চিঠিতে সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। চিঠিতে তিনি লেখেন: ‘এইক্ষণে তুমি জমিদারির কার্য্য পর্য্যবেক্ষণ করিবার জন্য প্রস্তুত হও; প্রথমে সদর কাছারিতে নিয়মিতরূপে বসিয়া সদর আমিনের নিকট হইতে জমাওয়াশিস বাকী ও জমাখরচ দেখিতে থাক এবং প্রতিদিনের আমদানি-রপ্তানি পত্রসকল দেখিয়া তার সারমর্ম্ম নোট করিয়া রাখ’। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র ২২।
এই জমিদারির কিছু উড়িষ্যা ও বিহারে থাকলেও মূল অংশ ছিল পূর্ববঙ্গে, পদ্মাপারের বিস্তীর্ণ পল্লিবাংলায়। তাঁর জীবনপঞ্জিতে দেখা যায়, জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব পেতে পেতে আরও ছয় বছর কেটে যায়। ১৮৮৯ সালের নভেম্বরে ২৮ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের জমিদারির দায়িত্ব পালন শুরু করেন। সে বছরের নভেম্বরে সপরিবারে শিলাইদহে নৌকাবাস করেন, যার উল্লেখ রয়েছে ছিন্নপত্র-এর তৃতীয় চিঠিতে, যা ছিন্নপত্রাবলীতে চতুর্থ চিঠি। পড়ে বোঝা যায়, প্রকৃতির এই অবাধ মুক্ত রাজ্যে তাঁর মন একদিকে বিশালতার বোধে পরিতৃপ্ত, অপর দিকে এর অনিশ্চয়তা ও বৈচিত্র্যের নাটকীয়তায় কৌতুকে-কৌতূহলে প্রাণবন্ত। এই চিঠি থেকে সামান্য উদ্ধৃতি দেওয়া যাক:
"শিলাইদহের অপর পারে একটা চরের সামনে আমাদের বোট লাগানো আছে। প্রকাণ্ড চর—ধূ ধূ করছে—কোথাও শেষ দেখা যায় না—কেবল মাঝে মাঝে এক এক জায়গায় নদীর রেখা দেখা যায়—আবার অনেক সময় বালিকে নদী বলে ভ্রম হয়—গ্রাম নেই, লোক নেই, শুরু নেই, তৃণ নেই—বৈচিত্র্যের মধ্যে জায়গায় জায়গায় ফাটল ধরা ভিজে কালো মাটি, জায়গায় জায়গায় শুকনো সাদা বালি—পূর্ব দিকে মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখলে দেখা যায় উপরে অনন্ত নীলিমা আর নিচে অনন্ত পাণ্ডুরতা, আকাশ শূন্য এবং ধরণীও শূন্য, নিচে দরিদ্র শুষ্ক কঠিন শূন্যতা আর উপরে অশরীরী উদার শূন্যতা।"
১৮৯০ সালের দিকে দেবেন্দ্রনাথ স্থির করেন যে জমিদারি দেখাশোনার সম্পূর্ণ ভারটা রবীন্দ্রনাথকেই দেবেন। সেই মুহূর্তে পরিবারের আর কাউকে এ-দায়িত্ব দেওয়া যেতো না। দ্বিজেন্দ্রনাথ আপনভোলা দার্শনিক। সত্যেন্দ্রনাথ আইসিএস, রাজকর্মে ব্যস্ত। হেমেন্দ্রনাথ মৃত। স্ত্রীবিয়োগের পর থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একরকম সংসারবিরাগী। বীরেন্দ্রনাথ ও সোমেন্দ্রনাথ অসুস্থ। সুতরাং একমাত্র রবীন্দ্রনাথই আছেন সামনে। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের বয়স ত্রিশ হতে চলল, সাহিত্যচর্চা ছাড়া আর কিছুই করেন না। তাঁকেও একটা কাজে লাগাতে হয়! পিতার আদেশে রবীন্দ্রনাথ অবাকই হয়েছিলেন। ‘আমি কবিমানুষ, পদ্যটদ্য লিখি, আমি এসবের কি বুঝি? কিন্তু বাবা বললেন – ‘তা হবে না; তোমাকে এ কাজ করতে হবে।’ কি করি? বাবার হুকুম, কাজেই বেরতে হ’ল।’ কলকাতায় সেরেস্তায় বসে জমিদারির কাজ শিখতে হলো তাঁকে – নিম্নতম কেরানির কাজ থেকে নায়েবের কাজ পর্যন্ত সবই। তারপর পাড়ি দিতে হলো পূর্ববঙ্গে। সেখানে তাঁদের তিনটি পরগনা নদিয়া জেলায় বিরাহিমপুর, তার কাছারি শিলাইদহে; রাজশাহি জেলায় কালিগ্রাম, তার কাছারি পতিসরে; আর পাবনা জেলায় শাজাদপুর, তার কাছারি শাজাদপুর গ্রামেই। এতদিন বাড়ির অন্যদের মতো রবীন্দ্রনাথও মাসোহারা পাচ্ছিলেন দুশ টাকা, এখন তা উন্নীত হলো তিনশয়। এর আগেও কনিষ্ঠ পুত্রকে জমিদারির কাজে বাঁধার চেষ্টা করেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ, কিন্তু সফল হননি। রবীন্দ্রনাথ সুযোগ পেলেই পালিয়ে এসেছেন কলকাতায়। তবে পূর্ববঙ্গের নিসর্গ যে তাঁকে মুগ্ধ করেছিল, তা নিঃসন্দেহ। সম্ভবত ১৮৮৯ সালে রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে এসেছিলেন পূর্ববঙ্গ ও উড়িষ্যায়। তখন শিলাইদহ থেকে ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লিখেছিলেন, “পৃথিবী যে বাস্তবিক কী আশ্চর্য সুন্দরী, তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়।’ এখন এসে পড়লেন সেই সুন্দরী পৃথিবীর একেবারে কোলের মধ্যে। এবারে লিখছেন : ‘পৃথিবী যে কী আশ্চর্য সুন্দরী এবং কী প্রশস্ত প্রাণ এবং গভীরভাবে পরিপূর্ণ তা এইখানে না এলে মনে পড়ে না।’ কবি থাকেন পদ্মা নামের বোটে – শিলাইদহ থেকে পদ্মা নদীতে বোট ভাসিয়ে চলে যান ইছামতীতে, সেখান থেকে চলনবিলে, আত্রাইয়ে, নাগর নদীতে, যমুনা পেরিয়ে সাজাদপুরের খাল বেয়ে সাজাদপুরে। এমনি করে পদ্মা নদীর সঙ্গে গড়ে ওঠে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক, কবুল করেন, ‘বাস্তবিক পদ্মাকে আমি বড়ো ভালোবাসি।“
একই বছর ফাল্গুনে আবারও শিলাইদহে যান রবীন্দ্রনাথ, এবার সঙ্গী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘ছেলেবেলা’য় স্মৃতিচারণা করে লিখেছেন:
“পুরোনো নীলকুঠি তখনো খাড়া ছিল। পদ্মা ছিল দূরে। নীচের তলায় কাছারি, উপরের তলায় আমাদের থাকবার জায়গা। সামনে খুব মস্ত একটা ছাদ। ছাদের বাইরে বড়ো বড়ো ঝাউগাছ, এরা একদিন নীলকর সাহেবের ব্যবসার সঙ্গে বেড়ে উঠেছিল।
... সেদিনকার আর যা-কিছু সব মিথ্যে হয়ে গেছে, কেবল সত্য হয়ে আছে দুই সাহেবের দুটি গোর।“
রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখেন, বালবৃদ্ধ নারীপুরুষকে অবলোকন করেন, পরিচিত হন তাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে। তাঁর সৃষ্টিশীলতা লাভ করে এক আশ্চর্য গতিময়তা। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘বাবার গদ্য ও পদ্য দুরকম লেখারই উৎস যেমন খুলে গিয়েছিল শিলাইদহে, এমন আর কোথাও হয়নি।’ যে-বছর তিনি পূর্ববঙ্গে আসেন, সে-বছরেই কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় মাসিক হিতবাদী – তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যুক্ত হন সাহিত্যসম্পাদকরূপে। হিতবাদীতে পরপর লেখেন ছটি ছোটোগল্প – আর প্রকৃতপক্ষে তাতেই সূচনা হয় বাংলা ছোটোগল্পের – সেসব গল্পের বস্তু পূর্ববঙ্গের গ্রামজীবন থেকেই নেওয়া। সোনার তরী-চিত্রা-কণিকা-কথা-কাহিনি-কল্পনা-ক্ষণিকার বহু কবিতা এখানেই লেখা। চিরকুমার সভা নাটক এবং চোখের বালি উপন্যাসেরও পত্তন এখানে। আর এখানে রচিত হয় অজস্র গান। যেমন, ‘পুষ্পবনে পুষ্প নাহি, আছে অন্তরে’ লেখা হয় শিলাইদহে; ‘ভালোবেসে, সখী, নিভৃত যতনে’ সাজাদপুরে; ‘বঁধু মিছে রাগ কোরো না’ পতিসরে। যমুনার স্রোতে ভাসতে ভাসতে লেখেন ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না’, চলনবিলে ‘যদি বারণ করো তবে গাহিব না’, নাগর নদীতে ‘আমি চাহিতে এসেছি শুধু একখানি মালা’, পদ্মায় বোটে বসে লেখা হয় ‘বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে’শুধু সৃষ্টিশীল রচনাই নয়, মননশীল লেখাও ছুটছে কলমে। দেশের রাজনীতি নিয়ে লিখছেন। পূর্ববঙ্গের অভিজ্ঞতা থেকে নতুন নতুন চিন্তা আসছে মাথায়। পল্লী-পুনর্গঠনের বিষয়ে ভাবছেন, সমবায়ের কথা ভাবছেন, যন্ত্র দিয়ে কৃষিকর্মের কথা ভাবছেন। কুষ্টিয়ায় বয়ন বিদ্যালয় স্থাপন করেন – তাঁতশিল্পের উন্নতির উদ্দেশ্যে। পতিসরে কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন পরে – কৃষকদের মধ্যে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করবেন বলে। ১৮৯৮ সাল থেকে স্ত্রীপুত্রকন্যা নিয়ে শিলাইদহে বাস করতে থাকেন তিনি। ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে গিয়ে শিক্ষার নতুন দর্শনের সূচনা করেন।তিরিশ বছর বয়সে জমিদারি দেখতে এসে দশটি বছর পূর্ববঙ্গে কাটিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ইতিমধ্যে দেবেন্দ্রনাথ সংকল্প করেছেন, জমিদারি আর এজমালি রাখবেন না। ভবিষ্যতে বিষয়সম্পত্তি নিয়ে গোলযোগ এড়াতে তিনি বেঁচে থাকতেই যথাযথ ভাগ-বাটোয়ারা করে যেতে চান। তাতে পুত্র হেমেন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারীদের হাতে চলে যায় উড়িষ্যার জমিদারি। তেমনি করে অনুজ গিরীন্দ্রনাথের পৌত্র গগনেন্দ্রনাথ, সমরেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের ভাগে পড়ে সাজাদপুর পরগনা। ওদিকে মৃণালিনী দেবী আর থাকতে চাইছিলেন না শিলাইদহে। মাধুরীলতার বয়স প্রায় চোদ্দ – তার বিয়ে দিতে হবে। রেণুকাকেই বা আর কদিন ঘরে রাখা যাবে! রথীন্দ্রনাথের এনট্রানস পরীক্ষার সময়ও চলে এলো। আবার লোকজনে ও কোলাহলে পরিপূর্ণ জোড়াসাঁকোর বাড়িতেও তিনি ঠাঁই নিতে চান না। রবীন্দ্রনাথকে তাই শান্তিনিকেতনে বসতি স্থাপন করতে হলো।
আগে পর্যন্ত কখনো নিজের দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে নিজের মুগ্ধ-চেতনার এমন অনুভব প্রকাশ করেননি : ‘পৃথিবী যে বাস্তবিক কী আশ্চর্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়। এই-যে ছোটো নদীর ধারে শান্তিময় গাছপালার মধ্যে সূর্য প্রতিদিন অস্ত যাচ্ছে, এবং এই অনন্ত ধূসর নির্জন নিঃশব্দ চরের উপরে প্রতি রাত্রে শত সহস্র নক্ষত্রের নিঃশব্দ অভ্যুদয় হচ্ছে, জগৎ সংসারে এ যে কী একটা আশ্চর্য মহৎ ঘটনা তা এখানে থাকলে তবে বোঝা যায়।’ এ চিঠিতে স্বদেশের ভিন্ন জায়গা দেখার অনুপ্রেরণায় তিনি নিজের উপলব্ধিকে প্রগাঢ় করেছেন। প্রকৃতি, পল্লীর, পল্লীর জনজীবন, দারিদ্র্য ইত্যাদি মিলিয়ে পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ, পতিসর, শাজাদপুর তাঁর জীবনদর্শনকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গেছে। তিনি তাঁর পূর্ববঙ্গের গণমানুষের সাহস, আত্মশক্তি দেখেছেন, তাদের মধ্যে নবজাগরণের বাণী শুনতে পেয়েছেন।
১৯২৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি ময়মনসিংহে এসেছিলেন। ময়মনসিংহ পৌরসভার আয়োজনে সূর্যকান্ত টাউন হলে কবিকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। তিনি তাঁর ভাষণে বলেছিলেন : ‘আমি আপনাদের এখানে আসবার সময় গাড়ীর বাতায়ন থেকে দেখতে চেষ্টা করেছিলাম আজকের দিনের জর্জরিত দেশকে নয় দুঃস্থ দেশকে নয় শ্রদ্ধাবিশ্বাসহীন অবমানিত দেশকে নয় দেখতে চেষ্টা করেছিলুম ভাবীকালের হাস্যোজ্জ্বল বঙ্গমাতার সুন্দরী মূর্তি। সেই দূরের মূর্তি ধ্যানের মধ্যে আনবার চেষ্টা করেছিলুম। কি করে সকলের কাছে সেরূপ প্রকাশ করব এই ইচ্ছা আমার হচ্ছিল। সেই সুজলা, সুফলা, শ্যামলামধুকর, গুঞ্জিতনবজচ্যুত মঞ্জরী শোভিত সুন্দরী বঙ্গমাতার মধুর মূর্তি আমার অন্তরে জাগ্রত হয়ে উঠেছিল। আজ নতুন যুগ এসেছে রথের ঘর্ঘর ধ্বনি শোনা যাচ্ছে বঙ্গদেশ আশার বাণীতে মুখরিত হয়েছে উঠেছে। আমার স্বাস্থ্য নেই, যৌবনের তেজ নেই, কিন্তু তৎসত্ত্বও আমার ইচ্ছা আছে, সেই ইচ্ছাই আজ আপনাদের কাছে নিবেদন করতে চাই। এ দেশের আকাশে বাতাসে স্নেহ আছে, মাদকতা আছে, সৌন্দর্য আছে তার কথা চিন্তা করতে করতে আমার জীবন শেষ হবে, এই আমার কামনা। সেই আশার সঙ্গীত ধ্বনি দেশের আকাশে বাতাসে মুখরিত হবে এই আমার চিরন্তন বিশ্বাস।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম শিলাইদহে আসেন ১৪ বৎসর বয়সে। সঙ্গী হয়ে ছিলেন পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সময়টি ছিল ১৮৭৫ সালের ডিসেম্বর মাস। ১৯ ডিসেম্বর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রামপুর বোয়ালিয়ার ব্রাহ্মমণ্ডলী আয়োজিত প্রার্থনাসভায় যোগ দেন। প্রশান্ত কুমার পাল তত্ত্ববোধিনী মাঘ-সংখ্যার সূত্র ধরে লিখেছেন ‘স্বাধ্যায়ের পর প্রধান আচার্য্য মহাশয়ের কনিষ্ঠপুত্র শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুমধুর স্বরে একটি মনোহর ব্রাহ্মসঙ্গীত করেন। এই সময়ে শিলাইদহে অল্পদিন অবস্থানের কারণে শিলাইদহ তাঁর মনে তেমন দাগ কাটেনি। তিনি দ্বিতীয়বার শিলাইদহে যান ১৮৭৬ সালে। সঙ্গী হয়েছিলেন বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের। এবার তিনি শিলাইদহে একমাসের বেশি সময় কাটিয়ে ছিলেন। এ সময় তিনি কবিতা লিখে খাতা ভরিয়েছেন। ঘোড়ায় চড়ে ঘুরেছেন। ফুলের রঙিন রস কলমের নিবে লাগিয়ে কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সফল হননি। তিনি ‘জীবনস্মৃতি’-তে লিখেছেন—‘একলা থাকার মন নিয়ে আছি। ছোটো একটি কোণের ঘর, যত বড়ো ঢালা ছাদ তত বড়ো ফলাও আমার ছুটি। অজানা ভিন দেশের ছুটি, পুরানো দিঘার কালো জলের মতো তার থই পাওয়া যায় না। বউ-কথা-কও ডাকছে তো ডাকছেই, উড়ো ভাবনা ভাবছি তো ভাবছিই। এইসঙ্গে আমার খাতা ভরে উঠতে আরম্ভ করেছে পদ্যে। সেগুলো যেন ঝরে পড়বার মুখে মাঘের প্রথম ফসলের আমের বোল ঝরেও গেছে।‘ কিশোর বয়সে পূর্ববঙ্গের প্রকৃতি দেখার সূচনায় নগরজীবন এবং গ্রামীণ জীবনের পার্থক্যটি প্রবল হয়ে ওঠে। পূর্ণ হয় সৃজনশীলতার মাত্রা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করেন পূর্ববঙ্গের যশোর জেলার দক্ষিণডিহি গ্রামের মেয়ে ভবতারিনীকে। ১৮৮৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। বিয়ের পরে তিনি স্ত্রীর নাম রাখেন মৃণালিনী। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন : ‘মা গায়ে হলুদের পরে রবিকাকাকে আইবুড়াভাতের নেমন্তন্ন করে। মা খুব খুশি, একে যশোরের মেয়ে, তায় রথীর মা মার সম্পর্কের বোন। বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের মামা ব্রজেন্দ্রনাথ রায়ের পিসিমা আদ্যাসুন্দরী।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দক্ষিণডিহি গ্রামে এসেছিলেন কিনা এই নিয়ে তথ্যের মতভেদ আছে। রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন: ১৮৮৩ পূজার ছুটির সময় জ্ঞানদানন্দিনী দেবী উৎসাহী হইয়া বাস্তুভিটা দেখিবার অজুহাতে যশোর জেলার নরেন্দ্রপুর গ্রামে যান, উদ্দেশ্য কাছাকাছি পিরালী পরিবারের মধ্যে হইতে বধূ সংগ্রহ। রবীন্দ্রনাথ নিজে মৈত্রেয়ী দেবীর কাছে বলেছেন—‘আমার বিয়ের কোনো গল্প নেই। বৌঠানরা যখন বড় বেশী পীড়াপীড়ি শুরু করলেন আমি বললুম, তোমরা যা হয় কর, আমার কোনো মতামত নেই। তারাই যশোর গিয়েছিলেন, আমি যাইনি।’ এই পরিপ্রেক্ষিতে নিশ্চিত বলা যাবে না যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৩ সালে পূর্ববঙ্গে এসেছিলেন। তবে এটা ঐতিহাসিক সত্য যে দক্ষিণডিহি গ্রামের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বংশানুক্রমিক যোগ আছে। দক্ষিণডিহির জমিদার জগন্নাথ কুশারী রবীন্দ্রনাথের আদিপুরুষ। এই পরিবারের জয়রামের পুত্র নীলমণি ১৭৮৪ সালের জুন মাস থেকে জোড়াসাঁকোতে বসবাস শুরু করেন। নীলমণির মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র রামলোচনের পুত্র সন্তান ছিল না। তিনি ভায়ের ছেলে দ্বারকানাথকে দত্তকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। পৈতৃক উত্তরাধিকারের সূত্রে রবীন্দ্রাথ পূর্ববঙ্গের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন সম্পর্কে যুক্ত। তার মা সারদা দেবীও ছিলেন দক্ষিণডিহির রামনারায়ণ চৌধুরীর কন্যা। সুতরাং মামাবাড়িও পূর্ববঙ্গে। আর দক্ষিণডিহি গ্রামের কন্যা মৃণালিনী দেবীকে বিয়ের সূত্রে পূর্ববঙ্গ একই সমান্তরালে তাঁর জীবন-সম্পৃক্ত ভূখণ্ড হয়।
১৮৮৯ সালের নভেম্বর মাসে মৃণালিনী দেবী, তাঁর বান্ধবী বেলা ও রথীন এবং ভাইপো বলেন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি শিলাইদহ আসেন।
১৯২২ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি ভাগ করে দিলে রবীন্দ্রনাথের ভাগে পড়েছিল কালিগ্রাম। জমিদারি তত্ত্বাবধানের কাজ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন উপলক্ষে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করেন। বিশেষ করে নাগরিক সমাজের আমন্ত্রণে তাকে বিভিন্ন। জায়গায় যেতে হত। তিনি সব নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছেন গভীর আনন্দ ও দায়িত্ববোধে। কারণ পূর্ববঙ্গ তার চিন্তা, চেতনা, মননকে ভিন্ন খাতে নিয়ে গিয়েছিল। উপলব্ধির বহুতল বিস্তৃত এই পরিসর তার সৃজনশীলতার, জ্ঞানের বোধকে তীক্ষ্ন করেছিল। পূর্ববঙ্গকে নিয়ে তাঁর আশাবাদ পরিব্যাপ্ত হয়েছিল তার চিন্তার সূত্রে।
১৮৯২ সালে রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত অনুষ্ঠানে ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধ পাঠ করেন। ১৮৯৮ সালে তিনি প্রথম ঢাকায় এসেছিলেন। উপলক্ষ ছিল বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের দশম প্রাদেশিক সম্মিলনীতে অংশগ্রহণ। ১৯০৫ সালে কুমিল্লার টাউন হলে বক্তৃতা করেন। ১৯০৭ সালের জুন মাসে চট্টগ্রামে বক্তৃতা করেন। ১৯০৮ সালের ১১-১২ ফেব্রুয়ারি পাবনায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক সমিতির অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯১৪ সালের ২২-২৩ ফেব্রুয়ারি পাবনায় উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সপ্তম অধিবেশনের আয়োজন হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই সম্মেলনে ভাষণ প্রদান করেন। ১৯১৯ সালের ৩ নভেম্বর গুয়াহাটি থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সিলেট শহরে পৌঁছান ৫ নভেম্বর। ৬ নভেম্বর রতনমণি লোকনাথ টাউন হলে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ৭ নভেম্বর মুরারিচাঁদ কলেজের ছাত্ররা তাকে সংবর্ধনা দেয়।
১৯২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়বার ঢাকায় আসেন। ঢাকা পৌরসভা এবং জনসাধারণ তাঁকে সংবর্ধনা প্রদান করে। একই দিনে ঢাকার করপোরেশন পার্কে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার নারীদের সংগঠন দীপালি সংঘ কবিকে সংবর্ধনা দেয়। ৯ ফেব্রুয়ারি জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজে বক্তৃতা করেন। ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলের ছাত্র সংসদ কবিকে সংবর্ধনা দেয়। ১০ ও ১৩ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ‘The Meaning of Art- The Rule of the Giant’ শীর্ষক দুটি লিখিত বক্তৃতা পাঠ করেন। ১৯২৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহে আসেন। ময়মনসিংহ মিউনিসিপ্যালিটি সূর্যকান্ত টাউন হলে তাঁকে সংবর্ধনা জানানো হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ ব্রাহ্মসমাজের ব্রাহ্মমন্দিরে কবিকে সংবর্ধনা দেয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ সাহিত্য সমাজ তাঁকে সংবর্ধনা দেয়। ১৯২৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কবি কুমিল্লায় আসেন। ২০ তারিখে কুমিল্লার অভয় আশ্রমের কর্মীরা তাঁকে সংবর্ধনা জানায়। ২১ ফেব্রুয়ারি অভয় আশ্রমের বার্ষিক উৎসবে সভাপতিত্ব করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় যেসব ভাষণ দিয়েছেন তার বিভিন্ন অংশে পূর্ববঙ্গের মানুষ, জনজীবন, জনজীবনের মানসিক শক্তি, আত্মিক স্ফুরণ এবং এই ভূখণ্ড তাদের মাধ্যমে যেভাবে উজ্জ্বল হয়তো উঠেছে তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন এই ভূখণ্ডের অমিত সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে। তাঁর অভিজ্ঞতায়, অনুভবে পূর্ববঙ্গবাসীর আত্মজাগরণের জায়গাটি চমৎকারভাবে ফুঠে উঠেছে।
১৯২৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের ছাত্রসংঘ কবিকে সংবর্ধনা প্রদান করে। স্থানীয় হাইস্কুলে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় শোভাযাত্রা করে। দীর্ঘ কয়েক বছর এই অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বাস করে ১৯০১ সালে তিনি সংসার গুটিয়ে শান্তিনিকেতনে যান। তারপর আসা-যাওয়া করেছেন। নদীতে বসবাস করেছেন বটের পতিসর-শাজাদপুর ঘরোয়া সময় বিল-নদীর নৌপথে তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার বিবরণ পত্র-সাহিত্যে পাওয়া যায়। কত নিবিড়ভাবে মানুষ ও প্রকৃতিকে দেখেছেন তা বর্ণনা করে শেষ করার নয়। ১৯৩৭ সালে কবি শেষবারের মতো পূর্ববঙ্গে আসেন। গ্রাম ছিল পতিসর। পূর্ববঙ্গের সঙ্গে কবির আত্মিক যোগ। সেবার তিনি নাগর নদীপথে পতিসর ছাড়েন। তারপর আত্রাই স্টেশন থেকে ট্রেনে কলকাতায় যান।
১৯৩৬ সালের ২৯ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ‘Degree of Doctor of Literature’ প্রদান করে। জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারকে কবি যে চিঠি লিখেছিলেন সেখানে আছে— ‘কল্যাণীয়েষু, ঢাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে আজ আমাকে নিমন্ত্রণ করবার জন্যে দূত এসেছিলেন। তাঁদের বিশেষ অনুরোধে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্ব্বেই যাত্রা করতে প্রস্তুত হয়েছি। ওই তারিখে রাত্রে রওনা হয়ে গোয়ালন্দ থেকে তাদেরই জলযানে। ভেসে পড়ব। ১০ তারিখ পর্যন্ত তাদের আতিথ্য ভোগ করে কর্তব্য অন্তে তোমার আশ্রমে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিমন্ত্রণ পালন করব। নইলে আমাকে দীর্ঘকাল ঢাকায় থাকতে হয়। আমার সময় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিঃস্থিত ঢাকার লোকের নিমন্ত্রণ কোনো মতেই উপেক্ষা করা উচিত বোধ করিনে। তাই দুই নিমন্ত্রণক্ষেত্রে আমার সময়কে বিভক্ত করে দিলুম। যে কয়দিন তোমাদের দেব স্থির করেছিলুম সে কয়দিন সম্পূর্ণই রইল। ইতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।—১৬ মাঘ ১৩৩২।’ এভাবে গ্রামীণ জনপদ থেকে শুরু করে ঢাকা শহর পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ববঙ্গে তাঁর ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
যে পূর্ববঙ্গের কথা এই লেখায় উল্লিখিত হলো তা আজকের বাংলাদেশ। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জাতি অর্জন করেছে স্বাধীনতা।
তথ্যসূত্রঃ
১. জমিদার রবীন্দ্রনাথ - অমিতাভ চৌধুরী।
২. রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি - কুলদা রায়।
৩. রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ - ড. আনোয়ারুল করীম।
৪. শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ - প্রমথনাথ বিশী।
৫. শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ - নরেশচন্দ্র চক্রবর্তী।
৬. রবীন্দ্রভুবনে পতিসর - আহমদ রফিক।
৭. রবীন্দ্রজীবন কথা - প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়।
৮. রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্র সাহিত্য প্রবেশক - প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়।
No comments:
Post a Comment