প্রবন্ধঃ মুদ্রা-জালিয়াতি আর এক মহাবিজ্ঞানী - অর্পণ পাল


মুদ্রা-জালিয়াতি আর এক মহাবিজ্ঞানী


অর্পণ পাল



মূল লন্ডন শহর থেকে একটু বাইরে রয়েছে এক বিরাট প্রাচীর ঘেরা দুর্গ টাইপের ভবন, যাকে সবাই ‘টাওয়ার অব লন্ডন’ নামেই চেনে। প্রতি বছর প্রায় কুড়ি লক্ষ দর্শনার্থীর পা পড়ে এই ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট দেখতে। ব্রিটেনের রাজপরিবারের এক সময়ের আবাস এই দুর্গটি তৈরি হয় প্রায় সাড়ে ন’শো বছর আগে ১০৬৬ সালে, এক ক্রিসমাসের দিনে। 


ব্রিটেনের মুদ্রা বা কয়েন মূলতঃ যেখানে তৈরি হয় সেই টাঁকশালের নাম ‘রয়্যাল মিন্ট’। আজ থেকে এগারোশো বছরেরও আগে তৈরি এই মিন্ট (বাংলায় টাঁকশাল বলা হয়; আমাদের কলকাতায় আলিপুরে একটি সরকারি টাঁকশাল রয়েছে) প্রায় আটশো বছর ধরে অবস্থিত ছিল টাওয়ার অফ লন্ডনের মধ্যেই। পরে স্থানান্তরিত হয়। টাওয়ার অফ লন্ডনের মধ্যে থাকাকালীন এই মিন্টের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল সবচেয়ে বিখ্যাত সেই বিজ্ঞানীটির নাম। বিজ্ঞানচর্চার নিভৃত পরিসর ছেড়ে যিনি অর্থনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েও দেখিয়েছিলেন নিজের সহজাত বুদ্ধি আর মেধার স্ফুরণ। ব্রিটেনকে টেনে তুলেছিলেন এক অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে থেকে। তাঁর নাম, আইজ্যাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭)।


১৬৯৫ বা ’৯৬ সালের দিকে, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় তিনশো পঁচিশ বছর আগের ইংল্যান্ডেই নিউটন মস্ত বড় এক বিজ্ঞানী হিসেবে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিলেন। তখন তাঁর বয়স তিপান্ন-চুয়ান্ন। জীবনের প্রথম আঠেরো বছর উলস্থর্প গ্রামের খামারবাড়িতে কাটাবার পর কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে তাঁর ছোট কোয়ার্টারে বসেই কাটিয়েছেন জীবনের একটা বড় সময়, প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর। আলো, মহাকর্ষ বা গণিতের একটি বিশেষ বিষয় ক্যালকুলাস— এগুলো নিয়ে চর্চা করেছেন বহু দিন ধরে, লিখেছেন ‘প্রিন্সিপিয়া’ নামে একটি বিখ্যাত বই। পড়ানো বা ছাত্রদের শিক্ষিত করার দিকে তিনি মোটেই দড় নন, বরং ঘরের নিভৃত কোণে বসে বিজ্ঞানচর্চা করতেই তাঁর সবচেয়ে বেশি আগ্রহ। বন্ধুবান্ধব বিশেষ নেই, আর আড্ডা দিতেও তিনি মোটে পছন্দ করেন না। 


তবে ওই ১৬৯৩/৯৪ সালের দিকে আইজ্যাক নিউটনের জীবনে বেশ স্থায়ী একটা মানসিক অস্থির অবস্থা তৈরি হয়েছিল। তিনি তখন ক্ষুধাহীনতা আর অনিদ্রা রোগে ভুগতেও শুরু করেন। পরপর পাঁচটা রাত না ঘুমিয়ে থাকবার পর তাঁর হ্যালুসিনেশন হতে শুরু করে। নানারকম ভুল বা অবাস্তব জিনিস চোখের সামনে দেখতে থাকেন। বিজ্ঞানচর্চা মাথায় উঠে যায়। অনেকে মনে করেন এই সময় তিনি অ্যালকেমিচর্চার (অর্থাৎ রাসায়নিক নানারকম পদার্থ নিয়ে চর্চা, এই বিশ্বাসে যে একদিন অন্য ধাতু থেকে সোনা তৈরি করে ফেলতে পারবেন) প্রতি আস্তে আস্তে উৎসাহ কমিয়ে ফেলতে থাকেন। অ্যালকেমিবিদ্যা নিয়ে তাঁর গোপন গবেষণায় একটুও ফল ফলেনি, যেমনটা তিনি আশা করেছিলেন। আর এজন্য তিনি চাইছিলেন কেমব্রিজ ছেড়ে কোথাও চলে যেতে। তাঁর মাথার একগাছি চুল অনেক পরে আধুনিক বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন যে তাতে স্বাভাবিকের চেয়ে চার গুণ বেশি সীসা, অ্যান্টিমনি আর আর্সেনিক রয়েছে, আর পারদ রয়েছে পনেরো গুণ বেশি! যা ওই বিশেষ বিদ্যা অ্যালকেমি চর্চারই ফল। অনেক পরে অবশ্য অ্যালকেমি নিয়ে চর্চা করা বন্ধ হয়ে যায়, আর ওই বিদ্যাটিকে বিজ্ঞানের আওতা থেকেই দূর করে দেওয়া হয়। নিউটন, বিজ্ঞানী হলেও এরকম বেশ কিছু অপবিজ্ঞানের চর্চাই করতেন। 


যাই হক, সেই অস্থির সময়ের কিছু আগে নিউটন নিতান্ত কপালের ফেরে আর কিছুটা সে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণেই, ১৬৮৯ সালের দিকে হয়ে বসেছিলেন ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের সদস্য। অর্থাৎ আমাদের এখানকার মতোই, এমপি (মেম্বার অব পার্লামেন্ট বা সংসদের সদস্য)। যদিও এমপি হিসেবে তাঁর মেয়াদ ছিল মাত্রই এক বছরের, আর এই এক বছরে তিনি পার্লামেন্টের সভায় গিয়েছেন হাতে গোনা কয়েকদিন, একদিনও মুখ খোলেন নি। না, ভুল বলা হল, একদিনই তিনি সেখানকার বেয়ারাকে ডেকে বলেছিলেন, জানলাটা বন্ধ করে দিতে। ওই একবারই তাঁর মুখ খোলা। 


তা এ হেন নিউটন, জীবনের দ্বিতীয় ইনিংসে সম্পূর্ণ ভোল বদলে ফেললেন। নিভৃতবাস থেকে বেরিয়ে এসে পৌঁছলেন লন্ডনে আর পুরোপুরি আলাদা একটা জগতে প্রবেশ করলেন। তাঁর বিজ্ঞানচর্চায় সাময়িক ধাক্কা লাগলেও এই জগতে তাঁর পরবর্তী কাজকর্ম অন্তত সে দেশের পক্ষে তখন খুবই উপকারী হিসেবে গণ্য হয়েছিল। দেশকে এক মহাবিপর্যয়ের হাত থেকে তিনি বাঁচিয়েছিলেন। 


১৬৯৬ সালের এপ্রিল মাসে রয়্যাল মিন্টে ওয়ার্ডেন হিসেবে যোগ দিলে কেমব্রিজের আশ্রয় ছেড়ে লন্ডনে এলেন তিপ্পান্ন বছরের আইজ্যাক নিউটন। তিনি যে লন্ডনে আসেন, সেটার বেশিরভাগটাই ত্রিশ বছর আগের এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর যাকে বলে একেবারে ঢেলে সাজানো। বাড়ি-ঘর-অফিস-কাছারি-হাসপাতাল-গির্জা— সবই নতুনভাবে তৈরি করে নতুন করে সাজিয়ে তোলা এই  এই লন্ডন শহরের লোকসংখ্যা সাড়ে সাত লক্ষ, যা পুরো ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের দশ ভাগের এক ভাগ। এই লন্ডন এখন ইউরোপের এক প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বহু বিদেশির আনাগোনা। কত রকমের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠছে। 


অন্যদিকে এই বৈভব আর চোখ ঝলসানির আড়ালে আছে অন্য এক লন্ডন। যে রূপ দেখতে পাওয়া যায় একটু পর্দা সরালেই। অসংখ্য শ্রমিক, নিম্নবিত্ত, দরিদ্র মানুষ থাকেন শহরের পূর্ব দিকের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। এখানে আইনের শাসনও চলে না বিশেষ। নোংরা বস্তির মতো ঘরে চোরছ্যাঁচোড়দের আস্তানা, সব মিলিয়ে এখানে যেন নরক গুলজার চলছে। অথচ এখান থেকে কয়েক কিলোমিটার গেলেই বড়লোকদের পাড়া, লক্ষ লক্ষ পাউন্ড সম্পত্তির মালিকদের বসবাস। 


এইরকম একটা শহরে ১৬৯৬ সালের এপ্রিল মাসের শেষের দিকে পা রেখে, সপ্তাহখানেক কিছু কাজকর্ম সেরে নিয়ে তাঁর নতুন বাসস্থান টাওয়ার অব লন্ডনে গিয়ে উঠলেন মে মাসের ২ তারিখে। শুরু হল নতুন ঠিকানায় দীর্ঘস্থায়ী বসবাসের পালা। রয়্যাল মিন্টের মুদ্রাব্যবস্থাকে তিনিই যে ঢেলে সাজাবেন কয়েক বছরের মধ্যেই, নতুন চাকরিতে যোগ দেওয়ার দিনেই কি নিউটন ভেবে উঠতে পেরেছিলেন? 


ব্রিটেনের কয়েন ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি মূল্যমানের কয়েন হল পাউন্ডস স্টার্লিং, যাকে সংক্ষেপে শুধু পাউন্ড বলে। এর নিচে শিলিং, আর তারও নিচে পেন্স (শুধু এক পেন্সকে বলা হত পেনি)। বারো পেন্সে এক শিলিং, আর কুড়ি শিলিং-এ এক পাউন্ড। অর্থাৎ দুশো চল্লিশ পেন্সে এক পাউন্ড। পাউন্ডকে ইংরেজিতে লেখা হয় £, শিলিং-কে s., আর পেন্সকে d.। দশ পাউন্ড পাঁচ শিলিং পনেরো পেন্সকে লেখা হবে এইভাবে— £ 10 5 s. 15 d. পাউন্ডের এই চিহ্নটা এসেছে লিব্রা বা জোডিয়াক সাইন থেকে। শিলিং এসেছে সোলিডিয়াস আর পেনি এসেছে ডেনারিয়াস থেকে। সংক্ষেপে এই তিনটেকে বলা হত LSD। এছাড়া আরও কিছু কয়েনের বিশেষ নাম দেওয়া ছিল, যেমন ক্রাউন বলতে বোঝানো হত হাফ শিলিং, ফ্লোরিন বলতে দু’ শিলিং, হাফ ক্রাউন বা  দু’শিলিং আর ছয় পেন্স— এরকম। 


তখন কয়েন পাওয়া যেত ছয় পেন্স, তিন পেন্স, দুই পেন্স, হাফ পেন্স আর ফার্দিংস, অর্থাৎ এক পেনির চার ভাগের এক ভাগ। ১৮৯৬ সালের কয়েন বিপ্লবের পর ৫, ২, ১ আর ১/২ (অর্ধেক) গিনি কয়েনের প্রচলন শুরু হয়। এগুলো তৈরি হত সোনা দিয়ে। তার আগে কয়েন মূলত তৈরি হত সোনা আর রূপো দিয়ে। ১৮২০ সালের পর রূপো দিয়ে পেন্স বানানো একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। আর ১৯৭১ সালের পর সে দেশে চালু হয়েছে দশমিক ব্যবস্থা বা ডেসিম্যাল সিস্টেম। যেখানে একশো পেন্স-এ এক পাউন্ড। 


প্রায় গোটা সতেরো শতক জুড়েই ইউরোপ জুড়ে চলত কয়েন নিয়ে নানারকম বেআইনি কারবার। এগুলো মোটামুটি হত এই ধরনের—  কয়েনের নকল তৈরি করা; নকল কয়েক তৈরির জন্য দরকারি কাঁচামাল সংগ্রহ করা বা তা দিয়ে ধাতব তাল বানিয়ে রাখা; কাগজের নোট, ব্যাংক নোট এসব জাল করা; কয়েনকে ক্লিপিং করা, বা তা থেকে ছোট ছোট অংশ কেটে ফেলা। তখনকার দিনে কয়েন তৈরি হত সোনা বা রূপো দিয়ে, যে ধাতুগুলো এমনিতেই দামী। তাই সে দেশের জালিয়াতেরা কয়েন থেকে অল্প অল্প করে অংশ কেটে নিত, সেগুলোকে এক জায়গায় করে তারা গলাত, এবং মণ্ড তৈরি করে সেই মণ্ড থেকে তৈরি করত জাল কয়েন। বা অনেকে এই ধাতব মণ্ড পাঠিয়ে দিত পাশের দেশ ফ্রান্সে। তখন সে দেশের সঙ্গে যুদ্ধ চলছে ইংল্যান্ডের। ফ্রান্সে এই ধাতব মণ্ড বিক্রি করলে দাম বেশি পাওয়া যেত। সব মিলিয়ে সে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বেশ সঙ্কটের মধ্যেই পড়েছিল। 


অবশ্য সতেরো শতকের ইংল্যান্ডে কয়েন ক্লিপিং করা ছিল এক মারাত্মক অপরাধ। এর শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। তবু এই জোচ্চুরি বন্ধই করা যাচ্ছিল না কোনওভাবে। 


ক্লিপিং করা নিয়ে বহু গল্প বা কাহিনী প্রচলিত আছে। সে আমলে লন্ডনে কাজটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বেশ সংগঠিত ক্ষেত্র। বহু মানুষ (শুধু পুরুষ নয়, মহিলারাও) এই কাজ করেই সংসার চালাত। একটা পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৬৯৬ সালের আগে অব্দি এরকম অপরাধের সংখ্যা নথিবদ্ধ হয়েছিল চারশোটিরও বেশি। এর সবচেয়ে সুবিধা, খুব কম জিনিস দিয়েই কাজটা করে ফেলা যেত। শাস্তির ভয় দেখিয়ে, বা অনেককে শাস্তি দিয়েও কাজটা বন্ধ করা যাচ্ছিল না। 


এক মহিলার কথা জানা যায় যার কাছে গোপনে রোজ কয়েন এনে দিত একাধিক বাড়ি বা অফিসের ভৃত্য বা ক্যাশিয়ারেরা। সেগুলোকে ক্লিপিং করবার পর আবার ফেরত দেওয়া হত। প্রত্যেক একশো পাউন্ডের কয়েন নিয়ে আসবার জন্য ওই ভৃত্য বা ক্যাশিয়ার পেত পাঁচ পাউন্ড করে। উপার্জন তার মানে ওদের খারাপ হত না। কিন্তু ফেঁসে গেল মহিলাটি। ধরা পড়বার পর তার শাস্তি ঘোষণা হল।

কী শাস্তি? 

জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হল তাকে!  


নতুন চাকরিতে যোগ দিয়ে দিন কয়েকের মধ্যেই নিউটন বুঝলেন একটা বড় পরিবর্তন দরকার। তার মনে হল কয়েন জিনিসটাকে এমন ভাবে বানাতে হবে যাতে তাকে নকল করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। এ জন্য তিনি মিন্টের যে সব কর্মচারী এনগ্রেভিং অর্থাৎ কয়েনের গায়ে খোদাইয়ের কাজ করতেন, তাঁদের আলাদা করে ডেকে নিয়ে ট্রেনিং দিতে শুরু করেন। তাঁদের দেখিয়ে দেন কীভাবে আরও কঠিন করে তুলতে হবে কয়েনকে। দিন রাত এক করে প্রচুর খাটলেন বেশ কয়েক মাস। বাজারে আসতে লাগল নতুনভাবে তৈরি করা কয়েন। 


শুধু রয়্যাল মিন্ট না, ইংল্যান্ডের আরও তিন চারটি জায়গায় সাহায্যকারী মিন্ট তৈরি হল, সে সব জায়গাগুলোতেও বানানো হতে থাকে নতুন কয়েন। নিউটন পঁচাশি মিলিগ্রামের বদলে কয়েনের স্ট্যান্ডার্ড ওজন নির্ধারণ করেছিলেন উনপঞ্চাশ মিলিগ্রাম। যার জন্য রাজকোষের বেশ কিছু সাশ্রয় হয়। 


কানাডার ভ্যাঙ্কুভারের ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির এক গবেষক অ্যারি বেলেঙ্কি বহর আটেক আগে অনেক হিসেব করে দেখিয়েছিলেন নিউটন ঠিক কতটা সাশ্রয় করিয়েছিলেন ব্রিটেনের অর্থব্যবস্থার। তাঁর হিসেবমতো নিউটন সে আমলে ৪১,৫১০ পাউন্ড, যেটা আজকের মূল্যমানে দেখলে তিরিশ লক্ষ পাউন্ডেরও বেশি। এখানেই শেষ না, তাঁর পরে যে চারজন মাস্টার সে দেশের মিন্টে কর্মরত ছিলেন, তাঁদের সাশ্রয় করবার পরিমাণ ধরলে সব মিলিয়ে সাশ্রয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় এক কোটি পাউন্ড। এর কৃতিত্ব নিউটনকেই দেওয়া উচিত। 


নিউটনের দ্বিতীয় কৃতিত্বটিও বড় কম নয়। তাঁর দায়িত্ব নেওয়ার সময় সে দেশের মোট বাজারে প্রচলিত কয়েনের দশ শতাংশই ছিল জাল। এই জাল কারবারিদের শাস্তি দিতে উঠেপড়ে লাগেন নিউটন। আর এ জন্য তিনি কী করেন নি!  নিজে ছদ্মবেশে সন্ধ্যের দিকে বেরিয়ে পড়তেন অপরাধীদের হাতেনাতে ধরবার জন্য। শহরের নানা বস্তি এলাকায়, যেখানে অপরাধীদের বসবাস, সেখানে তিনি ঘুরে বেড়াতেন, মিশতেন বহু সাধারণ মানুষের সঙ্গে, কথাবার্তা বলে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করতেন অপরাধীদের পরিচয়। একটা কাহিনী এরকম — উইলিয়াম চ্যালোনার নামে একজন অপরাধী সে সময় দারুণ ফর্মে ছিল। সে এমনিতে থাকত ভদ্রলোক সেজে, কিচ্ছুটি বোঝবার উপায় নেই। তার ওপরমহলে অনেক চেনাজানাও ছিল। নিউটন নিজে এই জালিয়াতকে ধরতে উঠেপড়ে লাগলেন। তিনি নিজের স্পাইদের তো কাজে লাগালেনই, নিজেও ছদ্মবেশে বেরিয়ে পড়লেন নানা জায়গা থেকে সূত্র আর সাক্ষী জোগাড় করে আনতে। তারপর একদিন তো সেই লোকটিকে ধরা হল, আদালতে বিচারও শুরু হল। দেখা গেল নিউটন একাই আটজন সাক্ষী জোগাড় করে এনে দিয়েছেন। 


লোকটির বিরুদ্ধে প্রচুর সাক্ষ্যপ্রমাণ জমা দেওয়ায় বিচারের রায়ে চ্যালোনারের ফাঁসির হুকুম হল। ১৬৯৯ এর মার্চের তিন তারিখ ফাঁসি দেওয়া হল সে আমলের এক কুখ্যাত অপরাধী উইলিয়াম চ্যালোনারকে। আর সেই বছরেই নিউটন  রয়্যাল মিন্টের মাস্টার থমাস নিয়েল (Thomas Neale) প্রয়াত হলে তাঁর পদে নিউটন সে বছর ক্রিসমাসের দিন মাস্টার হিসেবে যোগ দিলেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি সরাসরি ওয়ার্ডেন থেকে মাস্টার হিসেবে নিযুক্ত হতে পেরেছিলেন। এই পদে তিনি ছিলেন জীবনের বাকি বছরগুলো। 


লন্ডনের বিখ্যাত বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান রয়্যাল সোসাইটির সঙ্গে অবশ্য তাঁর যোগাযোগ মোটেই শেষ হয়নি। মিন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পাশাপাশি তিনি নিজের লেখালিখিও চালিয়ে গিয়েছেন, ১৭০৪ সালে তাঁর বিখ্যাত বই ‘অপটিক্স’ প্রকাশিত হয়। আলো নিয়ে তাঁর গত পঞ্চাশ বছরের চিন্তাভাবনা ধরা ছিল এই বইয়ে। এর আগের বছরেই তিনি দায়িত্ব পেয়েছেন রয়্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট হওয়ার। এখন তিনি দারুণ ব্যস্ত লোক। দশ বছর আগের সেই ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত নিউটন যেন নতুন জীবন পেয়েছিলেন লন্ডনে এসে। 


বিজ্ঞানচর্চার বাইরে এই অচেনা নিউটনের খবর খুব বেশি মানুষ জানেন না, বা আমাদের এদিককার প্রচলিত জীবনীবইগুলোতেও লেখা থাকে না বিস্তারিতভাবে। অপরাধীদের শায়েস্তা করবার কাজে নিউটনের এই কৃতিত্ব সে দেশে সরকারীভাবে এখনও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়ে থাকে। 


লেখক পরিচিতি

অর্পণ পাল দক্ষিণ ২৪ পরগণায় থাকেন। পেশা শিক্ষকতা। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় গদ্য পদ্য নিয়মিত লেখেন। ভালোবাসেন বই পড়তে আর গান শুনতে।

No comments:

Post a Comment