ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য প্রায় পঁচিশ বছর ধরে বইয়ের প্রচ্ছদ অঙ্কন, কমিক্সের কাজ এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অলঙ্করণ করে আসছেন। পত্রপত্রিকার মধ্যে আছে আনন্দ পাবলিশার্স, পত্রভারতী, দেব সাহিত্য কুটীর, মিত্র ও ঘোষ, দেজ-এর মতো নামকরা প্রকাশনী এবং অমর চিত্রকথা-র মতো ভারত বিখ্যাত ম্যাগাজিন। ছবি আঁকাটা তাঁর পেশা আর নেশা দুইই।
আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে একটা ছোটদের বই-'ঝুম্মি'। এছাড়া আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশিত হয়েছে ব্যোমকেশ বক্সী কমিক্স সিরিজ। অদ্যাবধি এই সিরিজের মোট চারটে বই প্রকাশিত হয়েছে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিনটি গল্প নিয়ে সদ্য প্রকাশিত হয়েছে ‘শরদিন্দু অলৌকিক কমিক্স "। ব্যক্তিগত জীবনে মৃদুভাষী ও প্রচারবিমুখ এই শিল্পীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন রাহুল ভট্টাচার্য।
রাহুলঃ আপনার খ্যাতি প্রধানত কমিক্স শিল্পী এবং ডিজিটাল ইলাস্ট্রেটর হিসেবে। এই দুই ধরনের কাজেই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, পর্যবেক্ষন এবং উপস্থাপনায় আপনার ভূমিকা অনন্য। শ্রম, নিষ্ঠা ও পান্ডিত্যের সমন্বয়ে আজকাল এ ধরনের কাজ খুব একটা দেখা যায় না। তো এই ধরনের কাজে আপনার আদর্শ বা অনুপ্রেরণা হিসেবে কেউ কি ছিলেন?
ওঙ্কারনাথঃ আমি ছোট থেকে পত্রপত্রিকায় যাঁদের আঁকা দেখে মুগ্ধ হয়েছি তাঁরাই আমার আদর্শ। এঁদের মধ্যে প্রথমেই যে সদা হাসিমুখ মানুষ টির কথা মনে আসে , তিনি হলেন শ্রদ্ধেয় শ্রী নারায়ন দেবনাথ। তারপর প্রসাদ রায় , বিমল দাস, সুধীর মৈত্র , সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় ( ইনি আমার কাছে দ্রোণাচার্য। যদিও একলব্যের মত কোনো গুরু দক্ষিনা আমাকে দিতে হয় নি। শুধু দু হাত পেতে এনার থেকে শিক্ষা নিয়েই গেছি। আজ ও নিই। ) দেবাশীষ দেব , এবং অবশ্যই কৃষ্ণেন্দু চাকী। আর সবার শেষে পেয়েছিলাম এমন একজন শিল্পীকে, যিনি সবদিক থেকেই আমার শিক্ষক এবং দাদা । শ্রী সুমন চৌধুরী। এত সহজ করে যে কিছু শেখানো যায়,বন্ধুর মত মজা করতে করতেও যে কিভাবে একজনকে সঠিক রাস্তা টা দেখিয়ে দেওয়া যায় তা এনার কাছেই জেনেছি।
রাহুলঃ আপনার তো আর্ট কলেজের শিক্ষা বা এ বিষয়ে কোন প্রশিক্ষণ ছিলো না। তো আপনি কিভাবে এই পেশায় এলেন?
ওঙ্কারনাথঃ এটা অনেক লম্বা গল্প। শুধু বলি- একজন মানুষ আমাকে তুলে নিয়েছিলেন রাস্তা থেকে। বুঝেছিলেন, একে ঘষা মাজা করলে একদিন চকচকিয়ে উঠতে পারে।তিনি হলেন - কিশোর ভারতী পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক শ্রী ত্রিদিব কুমার চট্টোপাধ্যায়।আমি আজ যেটুকু পারি তার প্রায় সবটাই তাঁর কাছে শেখা। উনি আমাকে সাহায্য না করলে ওঙ্কারনাথকে কেউ চিনত না।
রাহুলঃ আপনার শিল্প কর্ম জুড়ে আছে বাঙালি এবং বাংলা সংস্কৃতি। সংস্কৃতির তো বিবর্তন হচ্ছে এবং এটাই স্বাভাবিক। এই বিবর্তন কি ইতিবাচক দিকে যাচ্ছে নাকি নেতিবাচক দিকে যাচ্ছে?
ওঙ্কারনাথঃ বাঙ্গালি চিরকালই সংস্কৃতিবান ।কিন্তু ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়ায় যা দেখি তাতে মনে হয় শুধু পরের ছিদ্রান্বেষণে ই তার আগ্রহ বেশি । শুধু পুরনো ঐতিহ্য নিয়ে জাবর কাটা আর নতুন প্রজন্ম কে দোষারোপ করা। এটাই যেন এখন আমাদের একমাত্র সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে।
রাহুলঃ আরেকটা জিনিস বলতে চাই, মানবিক মূল্যবোধের বিস্তার ঘটাবার জন্য সাহিত্য এবং শিল্পের তো একটা ভূমিকা থাকে।আপনার কি মনে হয় না সাহিত্য বিমুখতা, শিল্প বিমুখতা মানুষের অনুভুতিকে শৈশব থেকেই ভোতা করে রাখছে বা সেই কারনে নানারকম সামাজিক অবক্ষয় তৈরী হচ্ছে?
ওঙ্কারনাথঃ সাহিত্য, শিল্প এসব পরের কথা। আসল মূল্যবোধ কিন্তু তৈরি হয় বাবা-মা আর শিক্ষকের থেকে। সুতরাং গলদটা কোথায় সেটা আশা করি বুঝতে পারছেন।
রাহুলঃ ব্যোমকেশ বক্সী নিঃসন্দেহে বাঙ্গালীর আবেগ এবং মননের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তো সেই ব্যোমকেশ বক্সীর প্রচ্ছদ তৈরী করার সময় বা পরে আপনার কি অনুভুতি হয়েছিলো?
ওঙ্কারনাথঃ আমার বাবা যখন 'ব্যোমকেশ বক্সী' প্রথম এনে দিয়ে বলেছিলেন- এই বইটা পড়। তখন কিন্তু আমার অত ভাল লাগেনি।তখন আমি সবে মাধ্যমিক দিয়েছি। কিন্তু অনেক পরে যখন শরদিন্দু বাবুর লেখা নিজেই খুঁজে খুঁজে পড়তে শুরু করলাম, তখন বুঝলাম এই লেখার মজা। তারপর ছবি আঁকা , কমিক্স্ এইসব করে যখন উপার্জন করতে শুরু করলাম তখনও 'ব্যোমকেশ বক্সী'কে নিয়ে কিছু করব বলে ভাবিনি। আচমকাই প্রস্তাব টা এসেছিল 'এবেলা'কাগজের তৎকালীন কার্যনির্বাহী সম্পাদকের কাছ থেকে। বলেছিলেন- 'ব্যোমকেশ বক্সী'কমিক্স করতে পারবে? শুনেইআর দ্বিতীয় বার ভাবিনি।হ্যাঁ বলে দিয়েছিলাম। শুরু হয়েছিল 'ব্যোমকেশ বক্সী' কমিকসের এর ধারাবাহিক।
রাহুলঃ আপনি আপনার কোন্ সৃষ্টির জন্য সবচেয়ে বেশি গর্বিত?
ওঙ্কারনাথঃ আমার মনে হয় ' গর্ব ' করার মত আমি এখনো কিছুই করে উঠতে পারি নি। যা করেছি, যেটুকু করেছি নিজের তাগিদ থেকে। প্রথমে ছিল মনের তাগিদ, পরে হয়েছে পেটের তাগিদ। রোজ ঘষতে ঘষতে একটা ভোঁতা লোহাও কিছুটা ধারালো হয়ে ওঠে। আমি ঠিক সেটুকুই হয়েছি। আমার কাজ যদি কারো ভালো লাগে, সে আমার সৌভাগ্য।
রাহুলঃ আপনি প্রচ্ছদ, ইলাস্ট্রেশন, কমিক্স প্রভৃতি কাজে কোন্ কোন্ সফটওয়্যার ব্যবহার করেন?
ওঙ্কারনাথঃ আমি সেভাবে সফটওয়্যার পারঙ্গম নই। বহুদিন কাগজে তুলিতেই কাজ করেছি। ইদানীং প্রয়োজনে ফোটোশপ আর মেডি ব্যাং ব্যবহার করি।
রাহুলঃ ডিজিটালি ব্যবহৃত রঙ যদি ছাপাতে ভিন্ন রকম আসে তখন আপনার অনুভুতি কেমন হয়?
ওঙ্কারনাথঃ সাধারণত কম্পিউটারে দেওয়া রঙ ছাপাতে খারাপ আসে না, যদি প্রিন্ট আর ওয়েব এই দুটো মাথায় রেখে রঙের মোড ঠিকভাবে করা হয়। তবে অঘটন ঘটা অসম্ভব না। তাতে একটু মন খারাপ হয় বৈকি। কিন্তু সাথে সাথে এটাও ভাবি যে, আমি তো শুধু নিজের পরিশ্রম আর মন দিয়েছি। যিনি এটা ছেপেছেন আমার চেয়ে তো তার মনখারাপ বা কষ্ট আরও বহুগুণ বেশি। কেউ স্বেচ্ছায় নিজের কাজ খারাপ করতে চান না। সেটা দুর্ভাগ্য বলে মেনে নিতে হয়।
রাহুলঃ গল্প বা উপন্যাসের একটা বিষয়কে ইলাস্ট্রেশনে ফুটিয়ে তোলার জন্য যে বিকল্প গুলো থাকে সেগুলো নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে আপনি কিভাবে সমঝোতা করেন?
ওঙ্কারনাথঃ ইলাস্ট্রেশনে সমঝোতার কোনো জায়গাই নেই। পুরো দায়িত্ব শিল্পীর। যদি তাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়। ভাল হলেও কাজটা সেই শিল্পীর , খারাপ হলেও কাজটা তারই।
রাহুলঃ একটা অবস্থা বা পরিবেশ পরিস্ফুটনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলটি কি?
ওঙ্কারনাথঃ ভাল করে লেখাটা পড়তে হয়, গল্পের মেজাজটা বুঝতে হয়। বেশির ভাগ শিল্পীই নিজের সিগনেচার স্টাইল নিয়ে এত সচেতন থাকেন যে, গল্প কী ডিমান্ড করছে সেটা ভাবেন না। আমি অমুক চন্দ্র তমুক - এইটা লোকের সামনে তুলে ধরার জন্য গল্পের মেজাজের পিন্ডি চটকে দেন। এটা খুব খারাপ। এতে করে পাঠকের কাছে ছবিটা খাপছাড়া মনে হয়।
রাহুলঃ কমিক্স শিল্প বা ডিজিটাল ইলাস্ট্রেশন নিয়ে আপনি বর্তমান প্রজন্মকে কোন বার্তা দিতে চান?
ওঙ্কারনাথঃ এসব বার্তা-টার্তা অনেক হয়েছে। বেশির ভাগই দেখি জ্ঞান বিতরণ করতে ওস্তাদ। নতুন প্রজন্মকে এত অবোধ,দুগ্ধপোষ্য ভাবাটা এবার বন্ধ হোক। এরা অনেক বেশি দেখে,আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে ভাবেও। আমি বয়স্কদের থেকে নতুনদের সঙ্গেই বেশি স্বচ্ছন্দ। নতুন ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভান-ভনিতা কম। ভাল-মন্দ সরাসরি বলে দেয়। এই প্রজন্মকে কোনো বার্তা দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। এদের সাথে বন্ধুর মত মিশলে উল্টে অনেক কিছু শেখা যায়।
রাহুলঃ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ওঙ্কারনাথঃ আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments:
Post a Comment