দোকানের নামটা দেখে একটু চমকে গেলাম। হিন্দি হরফে একটা থামের গায়ে লম্বালম্বিভাবে লেখা 'গড়িয়া স্টোর্স'। আমি থাকি দক্ষিণ কলকাতায় গড়িয়ার কাছে, সেই জায়গার নাম উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ের ছোট্ট এই বাজার 'দেবল'এ কি করে এলো তা জানার কৌতূহল পেয়ে বসল আমায়। আজকে যাচ্ছি লোহাজং নামের একটা গ্রাম, আমাদের বেস ক্যাম্প। মূল গন্তব্য ব্রহ্মতাল। সেই পথেই পড়ে দেবল।
গতকাল আমরা ট্রেনে করে হালদোয়ানী পৌঁছনোর পর জানতে পেরেছিলাম, সেখান থেকে সরাসরি লোহাজং যাওয়ার কোনো শেয়ার গাড়ি পাওয়া যাবে না। একটা গোটা গাড়ি রিজার্ভ করে যাওয়া যায় বটে, কিন্তু দুজনের হিসেবে সে বিস্তর খরচ। দুজন বলতে আমি আর বোন। অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় টেন্ট, স্লীপিংব্যাগ, স্টোভ, রেশন বেঁধেছেদে বেরিয়ে পড়েছি। উদ্দেশ্য যতটা সম্ভব কম খরচ হয় তার খেয়াল রাখা। তাই এই গাড়ির সমস্যা যদি কোনোভাবে সমাধান করা যায়, এই ভেবে ফোন করলাম আমাদের গাইড মহিন্দরজি কে। দারুন মানুষ এই মহিন্দরজি। প্রচুর অভিজ্ঞতা, অমায়িক ব্যবহার আর সব সমস্যার মুশকিল আসান। জানলাম, ওনার একটা গাড়ি আজ হলদোয়ানি থেকেই একটা টিম নিয়ে যাবে। তাদের সাথে জুড়ে যেতে পারলেই আমরাও পৌঁছে যাবো লোহাজং। নিশ্চিন্ত মনে, কাকভোরে পৌঁছে গেলাম নির্দিষ্ট জায়গায়। গাড়িও চলে এলো। কথা মতো ওই গাড়িতেই রওনা হলাম। গাড়ি এগোলো ভিমতাল-আলমোড়া-কৌশানি হয়ে।
দেবল হল লোহাজংএর আগে ঠিকঠাক বড়োসড়ো একটা বাজার। প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রই পাবেন এইখানে। দু’তিনটে ওষুধের দোকানও আছে, আর আছে এটিএম। যথেষ্ট ক্যাশ সাথে না থাকলে এখান থেকে টাকা তুলে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
আমরাও নামলাম দেবলে এটিএমের খোঁজে। আর নেমেই চোখে পড়ল গড়িয়া স্টোর্স। খেজুরে আলাপ করা আমার ছোটবেলার স্বভাব। তা সে আপনি ভালই বলুন বা মন্দ। চলে গেলাম গড়িয়া নামের রহস্য উদঘাটনে। গিয়ে শুনলাম, না: দোকানের মালিক বাঙালি তো ননই, গড়িয়া কেন কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গেও উনি বা ওঁর তিন পুরুষের কেউ যাননি। ওদের গোষ্ঠীর নাম গড়িয়া। পদবীও তাই। আর সেই থেকেই দোকানের নাম। বেশ খানিকক্ষণ গল্প করে আবার গাড়িতে উঠে চলে এলাম।
সন্ধ্যে সন্ধ্যে পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের কোলে ছোট্ট গ্রামটায় যার নাম লোহাজং। এই নামের একটা বেশ ইতিহাস আছে। অনেকের মতে, এখানে খুব বৃষ্টি হয়, তাই লোহাতে খুব তাড়াতাড়ি জং ধরে যায়। সেই থেকেই এই জায়গার নাম লোহাজং। আবার অনেকের মুখে শোনা যায় অন্য এক কাহিনী। প্রাচীনকালে লোহাসুর বলে ছিল এক অত্যাচারী দৈত্য। তার অত্যাচারের হাত থেকে মানুষকে উদ্ধার করতে আবির্ভূতা হন স্বয়ং নন্দাদেবী। লোহাসুরের সাথে দেবীর এক 'ঘামাসান জঙ্গ' হয়। আর ঠিক এই জায়গাতেই লোহাসুর পরাজিত হয়। তাই এই জায়গার নাম লোহাজং।
এখানে বেশ কিছু দোকান আছে, যারা তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগ আর ট্রেকের টুকিটাকি জিনিস ভাড়া দেয়, বিক্রিও করে। অর্থাৎ আপনি যদি কোন প্ল্যান না করেই চলে আসেন ট্রেক করতে, সমস্যা হবে না।
ট্রেনে যেহেতু কোন দাহ্য পদার্থ নিয়ে ওঠার নিয়ম নেই, তাই ট্রেন থেকে নেমে কেরোসিনের খোঁজ করাই রীতি। কিন্তু আসার রাস্তায় বহু খুঁজেও কেরোসিন তেল পাইনি আমরা। এই সমস্যার সমাধানও করে দিলেন মহিন্দরজি। বললেন ডিজেল দিয়েও দিব্যি রান্না করে নেওয়া যাবে। কাল আমাদের গাইড হিসেবে যাবেন রাজু ভাই। মহিন্দরজি যাবেন বড় একটা টিম নিয়ে। আর যাওয়ার আগে রাজু ভাইয়ের হাতে পাঠিয়ে দেবেন ডিজেল। এই কথা দিয়ে উনি চলে যেতে, আমরাও খেয়েদেয়ে রাতের কম্বলের তলায় আশ্রয় নিলাম। ঠান্ডা বাড়ছে। তাড়াতাড়ি ঘুম চলে আসছে। আমরা এখনো জানিনা কাল ভোরেই কি স্বর্গীয় দৃশ্য অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য।
পরদিন ঘুম ভাঙতেই চটপট ব্যাগপত্র গুছিয়ে হোমস্টের ওপরের তলায় চলে গেলাম ব্রেকফাস্ট করতে। আলু পরোটা, আচার আর পাহাড়ী চা নিয়ে বারান্দায় বসেই সামনের দৃশ্যে চোখ আটকে গেল। ভোরের আলো এসে পড়েছে নন্দাঘুন্টি পর্বতশিখরের ওপর। সূর্যের আলোর ছটায় অপূর্ব রঙ ধরেছে পাহাড়ের গায়ে। নীল রঙের আকাশটা যেন ওই অয়েল পেইন্টিংটাকে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রেখেছে। ট্রেক শুরু করার আগেই এই দৃশ্য দারুন এনার্জি দিয়ে দিল।
ব্রেকফাস্ট সেরে রেডি হয়েই যেতে হল ফরেস্ট অফিসারের সাথে মোলাকাত করতে। একগাদা পারমিশন ফী, ট্যাক্স দিয়েথুয়ে হাঁটা শুরু হল গ্রামের রাস্তা ধরে। রাজু ভাই বুঝিয়ে দিলেন, ওই যে ডানদিকে নীচে গ্রামটা দেখা যাচ্ছে, ওটা দিদিনা। আর আমরা হাঁটছি মানডোলি গ্রামের মধ্যে দিয়ে। বাঁদিকে নিচের সবুজ ভ্যালিতে যে ছোট ছোট 'ঘর বার খেতি বাড়ি' দেখা যাচ্ছে ওগুলোও মানডোলি গ্রামেরই।
পাথুরে এবড়োখেবড়ো রাস্তায় আস্তে আস্তে উঠতে থাকলাম। বেশ খানিকক্ষণ গ্রামের মধ্যে দিয়ে, জলের পাইপের পাশ কাটিয়ে, এগোতে এগোতে দেখলাম, ঘরবাড়ি ক্রমশ কমে এসেছে আর আমরা পৌঁছে গেছি ঘাসে ঢাকা ছোট্ট একফালি জমির উপর। সেখান থেকে যতদূর দেখা যায় সবুজ ভ্যালি আর লেয়ারে লেয়ারে সাজানো পাহাড়। এখানে খানিক রেস্ট নিয়ে নেব। সামান্য শুকনো ফল, বিস্কুট আর জলও খেয়ে নিতে হবে শরীরকে চাঙ্গা রাখতে। এরপর একটু বেশিই চড়াই ভাঙতে হবে আর জঙ্গলের রাস্তা ধরে এগোতে হবে বেকাল তালের দিকে।
এই জঙ্গলে গাছ বলতে ওক আর রডোডেন্ড্রনের ছড়াছড়ি। উঁচুতে উঠতে গিয়ে হাঁফ ধরে গেলেও ঘন অরণ্যের ভিতর আলোছায়ার মধ্যে দিয়ে ধীর লয়ে এগিয়ে যেতে মন্দ লাগে না। এমন ভাবে আরো খানিক চড়াই ভেঙে আমরা পৌঁছলাম কাঠের খুঁটি পোতা ত্রিপল টাঙ্গানো এক চায়ের দোকানে। সে দোকান হঠাৎ দেখলে মনে হতেই পারে ঘন জঙ্গলের মধ্যে মেলা বসেছে। এই সময়টা ব্রহ্মতাল যাওয়ার জন্য সবচাইতে উপযুক্ত সময়। তাই লোকও কম নেই। আর সেই সব লোক গিয়ে ভিড় করেছে চায়ের দোকানে। হবে নাই বা কেন? জঙ্গলে ঠিক মাঝামাঝি যদি সুস্বাদু চা, গরম ম্যাগি, ঝাল ঝাল ডিম ভাজা পাওয়া যায়, তাহলে আপনিও হয়ত বলে উঠবেন, কইগো আমাকেও একটু চা বলো, আর ডিম টা একটু কড়া করে... ।
চা-টা খেয়ে আবার পিঠে ব্যাগ ফেলে একটু এগোতেই চোখ চকচক করে উঠলো। বরফ! আরে এর জন্যই তো আসা! দুদিন আগে এদিকে ভালো বরফ পড়েছিল। তারই খানিক খানিক রোদের চোখ বাঁচিয়ে গাছের পায়ের কাছে, পাথরের আড়ালে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। এখান থেকে আরও একটু উঁচুতে উঠলেই বোঝা গেল সেই বরফের প্যাচগুলোর সংখ্যা বাড়ছে। সেগুলো বাড়তে বাড়তে যখন পায়ের তলার পাথর আর দেখা যাচ্ছে না, পুরো রাস্তাটাই বরফে ঢাকা, রাজু ভাই বললেন, ‘আ গেয়ে’। মানে বেকাল তালের কাছে চলে এসেছি। আর মিনিট পনেরো দূরেই ক্যাম্প সাইট।
বেকাল তালের ক্যাম্পসাইট অনেকটা সমতল জমিতে ছড়ানো। তাতে সারি সারি খাটানো একএক ট্রেকিং এজেন্সির একএক রঙের টেন্ট। কোথাও একসারি হলুদ টেন্ট, কোথাও বা একসারি নীল। এক কোনায় গিয়ে আমরাও আমাদের টেন্ট পুঁতলাম। স্টোভ, বাসনপত্র বের করে একটা ছাউনি মত খুঁজে চটপট খিচুড়ি রাঁধতে বসে গেলাম।
তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া সেরে, যাব বেকাল তাল দেখতে। ক্যাম্প থেকে মিনিট পনেরো দূরে। বেকাল তালের আসল নাম 'ভৈঁকাল' তাল। প্রায় এক বর্গকিমি এলাকা জুড়ে এই তালটির আশ্চর্য্য একটা দিক হল ৯৮৮৫ ফুট উঁচুতেও এতে মাছ পাওয়া যায়। ট্রাউট জাতের মাছ। রাজু ভাইয়ের কথায় যদিও মাছগুলো 'একদম বেসওয়াদ'। নভেম্বরের শেষ থেকে দীঘির উপরের অংশ জমতে শুরু করে। আর শীতকালে তেমন ঠান্ডা পড়লে আপনি হাঁটতে পারবেন এর ওপর।
লেকের পাশেই আছে অতিপ্রাচীন ভৈঁকাল নাগের মন্দির। তাতে প্রতিষ্ঠিত আছেন নাগ দেবতা। আর আছে বেশ কিছু রূপকথা। সেই রূপকথাতে আছে লেকের জলের তলায় লুকোনো এক পাতাল লোকের কথা। কোনো এক নিষ্ঠাবান পূজারি বামুন, নাগ দেবতার আশীর্বাদে, নাকি একদিন সন্ধান পান সে রাজ্যের। সেই পাতাললোক থেকে নাগদেব প্রচুর ধনরত্ন উপহার দিয়ে বামুনকে ফেরত পাঠান মর্ত্যলোকে। শর্ত থাকে যেন কেউ না জানতে পারে এই পাতাল লোকের কথা। কিন্তু বামুনের বোকামিতে পরদিনই সারাগ্রামে রটে যায় সে খবর। ব্যাস তারপরেই সেই ধনরত্ন, সেই পাতাললোক, সেই বামুন - সবই উধাও হয়ে যায়।
এসব গল্প শুনতে শুনতে আর দীঘি পরিক্রমা করতে করতে সূর্য ডুবতে শুরু করলো। রাজু ভাই জলদি জলদি নিয়ে এলেন এরিয়ার এক উঁচু জায়গাতে। সে কি সূর্যাস্ত দেখলাম, আহা! পশ্চিম আকাশের ফালি ফালি মেঘগুলোকে নানান রঙে রাঙিয়ে ডিমের কুসুমের মতো লাল সুয্যিমামা মুখ লোকালেন পাহাড়ের গাছগুলোর আড়ালে। আর যাওয়ার আগে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে লম্বা লম্বা কিরণ বুলিয়ে আদর করে গেলেন আমাদের গালে মুখে।
সূর্য ডুবতে আমরা চলে এলাম চা বানাতে। তারপর দুপুরের করা খিচুড়ি গরম করেই ডিনার সেরে তাঁবুতে সেঁধোলাম-ঠান্ডা বাড়ছে যে। কিন্তু শহর থেকে ভাড়া করে আনা স্লিপিং ব্যাগটায় যেন কিছুতেই শীত মানছে না। একটু করে বাইরে বেরোই, পনেরো কুড়িটা বৈঠক দিই, তারপর আবার স্লিপিং ব্যাগের ভিতর ঢুকি। কিন্তু খানিকক্ষণ যেতে না যেতেই আবার যে কে সেই। বেশ খানিক্ষণ কি করি কি করি করে, আরো একজোড়া মোজা, একটা জ্যাকেট আর আরো একটা প্যান্ট পরে তবে শীত মানলো। আর একটু ঘুমোতে পারলাম। তখন কি জানি ছাই, এই স্লিপিং ব্যাগ আগামী দু'দিন কি তুর্কি নাচন নাচিয়ে ছাড়বে!
ঘুম থেকে উঠে খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়ে চটপট বেরিয়ে পড়লাম। আজকেই ব্রহ্মতালের দেখা পাব।
আজকের পথটার প্রথম অংশ বেশ চড়াই আর জঙ্গলের ভিতর। আগের দিনের মতো এ জঙ্গলেও রডোডেনড্রন আর ওক গাছের প্রাচুর্য চোখে পড়ে। হাঁপাতে হাঁপাতে এই বনটা পেরোলেই পৌঁছে যাওয়া যায় অপরূপ শোভামন্ডিত এক শাদ্বল প্রান্তরে। কবি সাহিত্যিকদের এই রূপের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে আলবাৎ বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করা সাহিত্য সৃষ্টি হবে। কিন্তু আমার কেন জানিনা আশির দশকে হিন্দি সিনেমার কথা মনে পড়ল। যে সব পাহাড়ি এলাকায় নায়ক নায়িকা দূর থেকে দৌড়ে এসে একে অপরের আলিঙ্গনবদ্ধ হ'ত, আর তারপর ঘাসের ঢালে গড়াগড়ি খেতো, এযেন হুবহু সেই জায়গায় চলে এসেছি।
এই স্থানটির নাম টিলান্ডি। এর সামনে মাথা তুললেই দেখা যায় সবুজ ঘাসে ঢাকা পাহাড়। ঘাস মাড়িয়ে উঠে যেতে হবে সেই পাহাড়ের মাথায়। সেই পাহাড়ের মাথায় উঠে দেখি, সামনে একটা সুন্দর বাঁক খাওয়া রিজ। দু'দিকের ঢালই খাদে নেমে গেছে আর ঠিক মাঝখানের উঁচু পাঁচিলের মতো অংশটা এঁকে বেঁকে এগিয়েছে আরো উঁচু পাহাড়ের দিকে। এখানে আবার বরফের দেখা মিলল। বরফের ওপর হাঁটতে হাঁটতে খানিক বাদেই এসে পড়লাম আর এক মনমুগ্ধকর অংশে। ঝান্ডি টপ। এটি এই চত্বরের সবথেকে উঁচু জায়গা। খুব বেশি বরফ পড়লে এখান থেকে আর এগোনো যায় না। এই অংশ থেকে আশেপাশের পুরো এলাকার ৩৬০˚ ভিউ পাওয়া যায়। আর সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নন্দাঘুন্টি, ত্রিশূল, মৃগথুনি প্রভৃতি শৃঙ্গ।
শান্ত হয়ে বসে পড়লাম, হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে। অনেকক্ষণ নাকি অল্পক্ষণ মনে নেই, পাহাড়ের সেই অপরূপ সৌন্দর্য মুগ্ধ করে রেখেছিল আমায়। এমন জায়গায় এসে একবার বসলে আর উঠতে মন চায় না। কিন্তু এগোতে তো হবেই।
ঝান্ডি টপের পর রাস্তাটা বেশ ট্রিকি। পাহাড়ের এই ঢালটা ছোট নুড়ি থেকে শুরু করে ইয়াব্বড় বড়, নানা সাইজের পাথরে ঢাকা। খুব সন্তর্পনে পাথরের খাঁজ খুঁজে পেরোতে হবে এই রাস্তা। তাহলেই পৌঁছে যাব বিশাল সবুজ মাঠের মধ্যিখানে। আর তারপর এগোতে হবে হালকা চড়াই বেয়ে। এখানে রাস্তা দুটো। একটা সোজা নিয়ে ফেলবে আজকের ক্যাম্পসাইটে আর অন্যটা-ডানদিক ধরে একটু ঘুরপথে ব্রহ্মতাল হয়ে। আমরা যাবো ডানদিকেরটাতেই। যাওয়ার পথে পড়বে একটা মন্দির, ভারতবর্ষের খুব কম সংখ্যক ব্রহ্মা মন্দিরের মধ্যে এটিও একটি।
ব্রহ্মতাল সম্বন্ধে শোনা যায় যে এই নিশ্চুপ নিরিবিলি দীঘির পাড়ে, চতুরানন ব্রহ্মদেব ধ্যানে বসতেন। আর তাঁর নামানুসারেই দীঘির এই নাম।
এখানে উচ্চতা সাড়ে দশ হাজার ফুট। তিন দিকের উঁচু পাড় ব্রহ্মতালকে আসার পথে থেকে আড়াল করে রেখেছে। হাঁটতে হাঁটতে কাছে এসে পৌঁছলে হঠাৎই দৃষ্টিগোচর হয় অনিন্দ্যসুন্দর লেকটি। সুন্দর অথচ কেমন জানি রহস্যময়। চারিদিকে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। হাওয়াও চলছে না। দীঘির ঘন নীল জল কি জানি এক জাদুমন্ত্রে জমাট বেঁধে গেছে। লেকের পাড়ে একটা মাত্র গাছ রহস্যটাকে যেন আরও ঘনীভূত করেছে। সেই গাছ দীঘির জলের মতই স্থির, নিথর। সময় কি তবে এখানে থমকে গেছে? কিংবা এহয়তো কোনো রহস্যই নয়, হয়তো সম্মোহন অথবা এই হয়তো উপযুক্ত আবহ নিজেই নিজের কাছে পৌঁছে যাওয়ার, আপন অন্তরের গভীরে ডুব দেওয়ার আদর্শ পরিমণ্ডল। সেজন্যই হয়ত প্রজাপিতার এই স্থানটি পছন্দ ধ্যানে বসার জন্য। এসব কথা ভাবতে ভাবতে কেমন একটা ঘোর মতন লেগে এসেছিল। হঠাৎ ঠকাস্ করে একটা আওয়াজ পেয়ে সম্বিৎ ফিরল। দেখলাম রাজুভাই লেকের মধ্যে পাথর ছুঁড়ে পরীক্ষা করছেন জল কতটা জমেছে।
আরও বেশ খানিকক্ষণ লেকের পাশে বসে তারপর এগোনো গেল। ব্রহ্মতাল থেকে আরেকটু এগিয়ে একটা শুকনো খাল পেরিয়ে আজকের ক্যাম্পসাইট। সেখানে এসে একটা আধভাঙ্গা বাড়ির পাশে তাঁবু ফেললাম। চটপট স্টোভ ধরিয়ে ম্যাগি বানিয়ে খেয়ে নিলাম।
বিকেল হতে না হতেই আমার ভেতরের বাঙালি খুঁজছে একটা চায়ের দোকান আর তাতে আঁটিচাঁটি পেড়ে আড্ডা। অদ্ভুতভাবে এখানেও একটা চায়ের দোকান খুঁজে পাওয়া গেল। বেশকিছু ভিনরাজ্যের লোকের সাথে আমার ভাঙ্গা হিন্দিতে চুটিয়ে আড্ডাও মেরে নিলাম।
আজ রাতের আকাশে এক চিলতে মেঘেরও দেখা নেই ।এই ঝকঝকে আকাশে, আকাশ গঙ্গা কে সাক্ষী রেখে খেতে খেতে ভাবছি, -পরিষ্কার আকাশ মানে রাতে পারদ নামবে হুহু করে। পারব কি আজ ঘুমোতে? আমাদের স্লিপিং ব্যাগগুলো তো বেকাল তালেই জবাব দিয়ে দিয়েছিল। না:, সারারাত ছটফট করলাম, তাঁবুর বাইরে এলাম, ডন বৈঠক লাগালাম, লেয়ারের পর লেয়ার চাপালাম। কিছুতেই কিছু হল না। শেষ পর্যন্ত পা ভাঁজ করে ঠাণ্ডা পায়ের পাতা পেটে চেপে বসে, ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে, সূর্য ওঠার অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় রইল না।
ভোর হতেই সবার আগে দৌড় লাগালাম মহিন্দরজির কাছে। 'কিছু একটা ব্যবস্থা করুন না হলে আজ রাতে স্রেফ ঠাণ্ডায় জমে মারা পড়বো।' মুশকিল আসান বললেন ‘আজ ঘুরে আসুন না। কুছ না কুছ ইন্তেজাম হো জায়গা’।
মহিন্দরজির হাতে আজ রাতের বাঁচা-মরার ভবিষ্যৎ ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম। আজ যাবো খামিলা টপে। কালকের রাস্তায় ব্রহ্মতাল পৌঁছে তাকে ডান হাতে ফেলে উঠতে হবে খাঁড়া চড়াই। আজকের রাস্তায় মেলাই বরফ। সবুজ ঘাস আর দেখাই যাচ্ছেনা। দেখা যাচ্ছে শুধু অভিযাত্রীদের ছেলেমানুষি। কেউ বরফের গোলা পাকিয়ে লোফালুফি খেলছে। কেউ আবার সেটা নিয়ে সটান ছুড়ে মারছে। কেউ কাত হয়ে শুয়ে কনুইয়ের ভর দিয়ে ছবি তোলাচ্ছে, তো কেউ আবার সাঁ-ধড়াস্ আছাড় খাচ্ছে। আমরা সমতলের প্রাণী। এই এত এত বরফ দেখে একটু আদেখলেপনা করতে কার না মন চাইবে!
১২ হাজার ফুট ওপরে খামিলা টপে এসে ধপ করে বসে পড়লাম। বরফের সাথে কোস্তাকুস্তি করে বেজায় হাঁপিয়ে গেছি। রাজু ভাই পাশে বসে একটা একটা করে পাহাড়চূড়া চিনিয়ে দিতে থাকলেন। এখান থেকে চৌখাম্বা, হাতি, ঘোড়ি, নীলকন্ঠ, ত্রিশূলের তিন চূড়া, নন্দাঘুন্টি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অনেকক্ষণ বসে রইলাম পাথরে পা ঝুলিয়ে। মন শান্ত হয়ে এলো। হিমালয়ের এই বিশালতার সামনে নিজের অস্তিত্বকে খুবই অকিঞ্চিতকর, ক্ষুদ্র মনে হল। মনে হল আমাদের এই জীবন, রাগ, অভিমান, দুঃখ, উদ্বেগ সবই মিথ্যে, সত্যি শুধু এই বর্তমানটা, এই ভালোলাগাটা। সে এক অদ্ভুত উপলব্ধি। ফিরতি পথে ব্রহ্মতালের পাশে বসে দু'দন্ড কাটানোও সেই একই উদ্দেশ্যে ।
ফেরত আসতেই মাহিন্দরজি বললেন দুটো স্লিপিং ব্যাগের ইনার উনি আমাদের জন্য আলাদা করে রেখেছেন। ধন্য আমাদের মুশকিল আসান। তারপর ওকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে রাজু ভাইকে পাকড়াও করলাম। রান্না করতে করতে আর রাজু ভাইয়ের গল্প শুনতে শুনতে রাত নেমে এল।
আজকের রাতই এখানে শেষ রাত। কালকে নামার পালা।
পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে ক্যাম্পের সবাইকে টাটা বলে আগের রাস্তায় ঝান্ডি টপ পর্যন্ত চলে এলাম। এরপরের রাস্তাটা একটু আলাদা। বেকাল তালের দিকে না গিয়ে এখান থেকে বাঁদিকে একটা রাস্তা হুড়মুড়িয়ে নেমে গেছে জঙ্গলের ভেতরে। তাতে নামার উপায়ও ওই হুড়মুড়িয়েই, গোড়ালী চেপে। কারণ রাস্তা বেশ ঢালু আর ঝুরো মাটিতে ভরা।
এই একঘেয়ে ঢালু জঙ্গুলে রাস্তার মধ্যে চমক বলতে আবার একটা চায়ের দোকান। পরে জেনেছি এই বনের মাঝে রমরমিয়ে চলা চায়ের দোকান দুটিরই মালিক একই লোক। ধন্য তার বৈষয়িক বুদ্ধি।
এই জায়গাটার নাম খরুরাই। এখানেও একটা ক্যাম্প সাইট আছে। অনেকেই দুদিন ব্রহ্মতাল ক্যাম্পে না থেকে দ্বিতীয় দিন খামিলা ছুঁয়ে চলে আসেন এইখানে। খরুরাই পেরিয়ে এ রাস্তা জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে আসে, আর আবার জুড়ে যায় প্রথমদিনের গ্রামের রাস্তাটায়। সেইখান থেকেই লোহাজং স্পষ্ট দেখা যায়।
আর ঘন্টাখানেক হাঁটলেই পৌঁছে যাব সেখানে। পেয়ে যাব গরম জল, নরম বিছানা। তারপর কাল ভোরে গাড়ি আসবে, আমাদের পৌঁছে দেবে হলদোয়ানি।
আমাদের যে ফিরতেই হবে শহরের কোলাহল আর ব্যস্ততার দুনিয়ায়। তবে সে আগামীকালের কথা। আজ বেকাল তালের পাতাল লোক, ব্রহ্মতালের নিস্তব্ধতা আর বরফের রেশটুকু মনে লেগে থাক। স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে থাক পাহাড়ি লোকগুলোর সারল্য, ভালোবাসা।
রইল একটুকরো ভিডিও
লেখক পরিচিতি
No comments:
Post a Comment