প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র




 

সূচিপত্র


শ্রদ্ধ্যাঞ্জলি

সম্পাদকীয়


প্রবন্ধ

মৃত্যুঞ্জয়ী সৈনিক সায়ক সেন

হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন? স্বপন সেন

শেষ চিঠি আনন্দ চট্টোপাধ্যায়

মূল্যবোধ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে কৃষ্ণেন্দু দেব

তথ্যগুপ্তিবিদ্যা, মঙ্গলের দুই চাঁদ ও ইনটারনেট গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

বাঁকুড়ার লোকদেবদেবীর প্রেক্ষিতে কিছু আলোচনা তুলসীদাস মাইতি

তাওয়াং উপত্যকার অধিবাসী মনপা কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

চাইলে যেতে পারেন শক্তিচট্টোপাধ্যায়, কিন্তু কেন যাবেন অনুপম হাসান

প্রবাসের পাঁচালি অরুণদ্যূতি মৈত্র

আলো দিয়ে আঁকা সুগত বন্দ্যোপাধ্যায়

ধর্ষকের চরিত্র বদলায় না রিনি গঙ্গোপাধ্যায়

বেহুলার দ্বিতীয় বাসর জাকির তালুকদার

ছয়-এ ঋতু মণিশংকর বিশ্বাস

ঠাকুরবাড়ির ব্যবসা ও সমৃদ্ধির ইতিহাস খালিদ আল হাসান


গল্প

স্থলপদ্মের কুঁড়ি বাসুদেব মালাকর

ঘোর চুমকি চট্টোপাধ্যায়

ওগো বন্ধু আমার দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

রূপান্তর কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

হাসি হাসি রাশি রাশি সুমন ঘোষ

একটি চোরের কাহিনি সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী

ব্যর্থ অঙ্কন মিত্র

উপলব্ধি অরিন্দম আচার্য

জন্নত সুদীপ চ্যাটার্জী

নায়িকার ভূমিকায় নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী

মোম জোছনায় সাগরিকা রায়

তমসো ম জ্যোতির্গময় কস্তুরী মুখার্জী

মাঙ্গলিক শেলী ভট্টাচার্য

বিশ্বাস তমোঘ্ন নস্কর

আক্ষেপ দেবারতি ভৌমিক

মেলবন্ধন দেবব্রত দাশ

ভিনগ্রহী অনিরুদ্ধ সেন

ফিফটি-ফিফটি অরিন্দম দেবনাথ 

গালগল্প বৈশাখী ঠাকুর

অনীক প্রোজ্জ্বল পাল

গোধূলির আলো রণিত ভৌমিক 


কবিতা

নিবারণ গোপেশ রায়

তুমি এক অলৌকিক অক্ষর আসিফ আলতাফ

এখনো সময় আছে রেহান কৌশিক

নয়নতারা শ্যামাচরণ কর্মকার

স্বপ্ন ছড়াই, চিতাও ধরাই সজল বন্দ্যোপাধ্যায়

সরলরেখা থেকে দূরে হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

কী যায় আসে দেবীস্মিতা দেব

শব্দগুলো রাম রায় সরকার

ছবি সুমন ব্যানার্জি 


    ধারাবাহিক উপন্যাস

হারানো চেয়ার রাজশ্রী বসু অধিকারী


অবলোকন

ইমান চয়ন সমাদ্দার


 বিশেষ রচনা

জরুরি অ-জরুরি গপ্পো অম্লানকুসুম চক্রবর্তী


অণুগল্প

নলেজ হোম সমৃদ্ধ দত্ত

মোগলী বিমল লামা

দাফন মধুমিতা ভট্টাচার্য

ঘর বনশ্রী মিত্র


হাল ছেড়ো না বন্ধু

সিঁড়িভাঙ্গা অঙ্ক অতনু প্রজ্ঞান


লোককাহিনি

যখন বৃষ্টি এল অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়


রম্যরচনা

মিষ্টিরিয়াস গৌতমেন্দু রায়

মাদাম কুরির রান্নাবান্না সুষমা ব্যানার্জী


ভ্রমণ

দিনান্তে দিনান্ত-এ সাবর্ণ্য চৌধুরী


    সাক্ষাৎকার

‘নিশিপালনের প্রহর’ এবং ‘বিশ্বনাথ মাঝি ও বিভূতিভূষণের গ্রাম’ -স্রষ্টা লুৎফর রহমান –এর সঙ্গে কথোপকথনে রাহুল ভট্টাচার্য


খেলা

ভালো থেকো ঈশ্বর ইশিতা চক্রবর্তী 


প্রধান সম্পাদিকা


পারমিতা মালী


অতিথি সম্পাদক


দেবব্রত দাশ


প্রধান কর্মাধ্যক্ষ


রাহুল ভট্টাচার্য


প্রচ্ছদ


সুদীপ্ত সরকার


অলঙ্করণ


সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী, সাবর্ণ্য চৌধুরী, সায়ন্ন্যা দাশদত্ত, টিম পঞ্চালিকা



প্রবন্ধঃ শেষ চিঠিঃ আনন্দ চট্টোপাধ্যায়

শেষ চিঠি 


আনন্দ চট্টোপাধ্যায়



দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক বাধ্যবাধকতার কারণে অক্ষশক্তি অর্থাৎ জার্মানি, ইতালি আর জাপানের সৈনিকদের অসংখ্য বীরত্বের কাহিনিগুলো সেভাবে জনসমক্ষে আসেনি। বেশির ভাগ লেখায়, উপন্যাসে কিংবা হলিউডি সিনেমায় মিত্রপক্ষ মানে আমেরিকা, সোভিয়েত রাশিয়া আর গ্রেট ব্রিটেনের সেনানীদের বীরত্বের কাহিনিগুলোকে অনেক বেশি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে। আশ্রয় নেয়া হয়েছে অনেক কাল্পনিক চরিত্রের। তাছাড়াও যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অবনতির ভয়ে হেরে যাওয়া দেশগুলির সৈনিকদের অসম সাহসিকতার কাহিনিগুলিকে অনেক সময়ই সেন্সর করে রাখা হয়েছিল। আসলে যে কোনও যুদ্ধেই পরাজিত পক্ষের সেনানীদের বীরত্বের অমর কাহিনিগুলিকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। তাই বিশ্বযুদ্ধের শেষে বেশ কয়েকটা ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল বা টোকিও ট্রায়ালে অসংখ্য জার্মান, ইতালিয়ান কিংবা জাপানি সেনানায়কদের প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হলেও জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে এটম বোমা ফেলে কয়েক লক্ষ সাধারণ ও নিরপরাধ মানুষকে মেরে ফেললেও জয়ী পক্ষের কারো কোনও বিচার হয়নি। যাক, সেটা অন্য প্রসঙ্গ।

কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার অনেক পরে বিজিত পক্ষের সেনানীদের বীরত্বের আর আত্মত্যাগের ঘটনাগুলো যখন ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে থাকে তখন সারা দুনিয়াই স্তম্ভিত হয়ে যায়। তার মধ্যে বেশ কিছু রুদ্ধশ্বাস কাহিনি তো শিউরে ওঠার মতো। যেমন জাপানের ইম্পিরিয়াল আর্মির হাজিমে ফুজি আর তার পরিবারের কাহিনি। বেশ কয়েক দশক জাপান সেনা কতৃর্পক্ষ এই ঘটনাটা সামনে আসতে দেননি। কারণ মহাযুদ্ধের শেষ দিকে আমেরিকা আর জাপানের বিতর্কিত কামিকাজে প্যাসিফিক ওয়ার। শেষে ১৯৯০ সালের গোড়ার দিকে হাজিমে ফুজির সাহসিকতা ও তার পরিবারের চরম আত্মত্যাগের এই কাহিনি প্রকাশ করা হয়।


হাজিমে ফুজি

১৯১৫ সালের ৩০শে আগস্ট হাজিমে ফুজির জন্ম হয় জাপানের ইবারাকি অঞ্চলে। তিনি ছিলেন তার সাত ভাই বোনের মধ্যে সবার বড়ো। কলেজ থেকে বেরিয়ে তিনি জাপানের সেনা বাহিনীতে যোগ দেন। সেই সময় চীনের সাথে জাপানের ভয়ঙ্কর যুদ্ধ চলছে। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার বেশ কিছু আগে থেকেই ১৯৩৭ সালের ৭ই জুলাই থেকে চীনের সাথে জাপানের বিরাট রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলছিল। ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২ তারিখে আমেরিকানদের কাছে জাপানের আত্মসমর্পণের শেষ দিন পর্যন্ত এই যুদ্ধ থামেনি। আধুনিক ইতিহাসে এশিয়া মহাদেশে এত দীর্ঘ সামরিক যুদ্ধের আর কোনও নিদর্শন নেই। দুই দেশের প্রায় আড়াই কোটি সাধারণ মানুষ এই ভয়ংকর যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন। চায়না আর জাপান মিলিয়ে চল্লিশ লক্ষের বেশি সৈনিক এই লড়াইয়ে মৃত্যু বরণ করেন।

দক্ষ মেশিন গান চালক হিসাবে হাজিমে ফুজির নাম জাপানের সেনা বাহিনীতে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি। অবিলম্বে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাকে চীনের সমরাঙ্গনে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু একদিন যুদ্ধক্ষেত্রে মর্টার শেলের আঘাতে তিনি গুরুতর ভাবে জখম হন ও অবিলম্বে তাকে একটা মিলিটারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে বেশ কিছুদিন চিকিৎসা চলার পর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন কিন্তু তার বাঁ হাতটা অনেকটাই অকেজো হয়ে যায়। হাসপাতালে থাকাকালীন তাকে শুশ্রূষা করেছিলেন জাপানের তাকাসাকি শহর থেকে আসা একজন নার্স। তার নাম ফুকুকো। দুজন ততদিনে পরস্পরকে ভালোবেসে ফেলেছেন। বিয়েও হয়ে গেল। আর দুজনেই জাপানে ফিরে এসে টোকিও শহরে ঘর বাঁধলেন। একটা কথা এখানে বলে নেওয়া ভালো যে সেই সময়ের প্রেক্ষিতে জাপানে নিজেদের পছন্দে বিয়ে করাটা কিন্তু যথেষ্ট সাহসী পদক্ষেপ হিসাবে গণ্য করা হত। বছর দুয়েকের ব্যবধানে দুই কন্যা সন্তানের জন্ম দিলেন ফুকুকো। কাজুকো আর চিকো।

ফুকুকো আর তার কোলে বড়ো মেয়ে তাজুকো

ততদিনে যুদ্ধটা আর চীন আর জাপানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ১৯৪১ সালের ৭ই ডিসেম্বর জাপান আমেরিকার নৌ বন্দর পার্ল হারবার আক্রমণ করলে আমেরিকা জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তার পরেই জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পুরোপুরি জড়িয়ে যায়।

জাপানের সেনা কর্তারা হাজিমেকে আর চীনের রণাঙ্গনে পাঠালেন না। বরং তাকে আর্মি এয়ার কর্পোরেশন একাডেমিতে ভর্তি করে দেওয়া হল। ১৯৪৩ সালে সেখানে ট্রেনিং শেষ করার পর তাকে টোকিও শহর থেকে অনেক দূরে কুমাগায়া আর্মি এভিয়েশন স্কুলের একজন ট্রেনার হিসাবে নিয়োগ করা হয়। সেখানে তখন বৈমানিকদের যুদ্ধে ব্যবহৃত উড়োজাহাজ চালানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হত। এদিকে ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্তালিনগ্রাদে জার্মানদের শোচনীয় পরাজয়ের পর অক্ষ শক্তি সব কটা ফ্রন্টেই ক্রমাগত পিছু হটতে আরম্ভ করে আর ১৯৪৪ সালের মধ্যভাগে যুদ্ধের ভাগ্য মোটামুটি ভাবে নির্ধারিত হয়ে যায়। জার্মানদের পতন শুধু তখন সময়ের অপেক্ষা।

জাপান কিন্তু তখনও মিত্র শক্তি, বিশেষ করে আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রাণপণে লড়ছে। কিন্তু একটা সময় তাদের যুদ্ধ বিমানের সংখ্যা কমতে থাকে। জাপানে তখন ভয়ানক আর্থিক মন্দা চলছে। উন্নত মানের ফাইটার প্লেন তৈরি করা যাচ্ছে না। এছাড়াও সহযোগী দেশ জার্মানি আর ইতালি থেকে কোনও সাহায্য পাওয়ার আশাও নেই। তারা তখন নিজেদের আত্মরক্ষা করতেই ব্যস্ত। সবচাইতে বড়ো সমস্যা ছিল দক্ষ সৈনিক আর বৈমানিকের অভাব। এদিকে আমেরিকা প্রশান্ত মহাসাগরে প্রচুর যুদ্ধ জাহাজ ভর্তি সৈন্য নিয়ে জাপানকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলতে চাইছে। সেই সমস্ত যুদ্ধ জাহাজগুলো এত বিশাল আর তাদের দেয়াল গুলো এত মোটা ইস্পাত দিয়ে তৈরি ছিল যে সাবমেরিন থেকে টর্পেডো বা জাহাজ থেকে মিসাইল ছুড়ে সেগুলিকে ঘায়েল করা যাচ্ছিল না। কোনও উপায় নেই দেখে জাপান একটা আশ্চর্য রণকৌশল ঠিক করে। অপারেশন ‘কামিকাজে’। এক ভয়ঙ্কর রণনীতি। আজও ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সুইসাইডাল মিশন। আমেরিকান জাহাজগুলির দুর্বল জায়গা ছিল ধোঁয়া বেরোনোর চিমনি। জাপান প্রথমে ওকা ভি ওয়ান আর পরে আরেকটু উন্নত ধরনের ওকা ভি টু বলে এক ধরনের খুব ছোট এরোপ্লেন বানিয়ে ফেলে। এই প্লেন গুলোতে ককপিটে মাত্র একজন মানুষেরই বসার আসন ছিল। প্লেনগুলির সামনের দিকটা দেখতে ছিল অনেকটা চুরুটের মতন আর সম্পূর্ণটাই বারুদে ঠাসা। এগুলিকে সাধারণ যুদ্ধ বিমানের তলায় জুড়ে দেয়া হত। বিপক্ষের যুদ্ধ জাহাজের অনেকটা কাছে এলে ওপরের বিমান থেকে একজন নেমে আসত নিচের ছোট প্লেনটায়। সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৫০০০ ফিট উপরে প্রায় ১ টন বারুদে ঠাসা গ্লাইডার প্লেনগুলোকে লক্ষবস্তু থেকে ৮০ কিলোমিটার দুরে মূল উড়োজাহাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হত। এরপর নিজস্ব গতিতে টার্গেটের থেকে তিন কিলোমিটার দুরে এসে গ্লাইডারের তিনটি রকেট ইঞ্জিন চালু করে ঘন্টায় প্রায় ৯৬০ কিমি গতিতে আত্মঘাতী বৈমানিক প্লেনের মাথাটা একেবারে নিচের দিকে গোত্তা মেরে বিপক্ষের যুদ্ধ জাহাজের চিমনির মুখ লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। শেষ দিকে মার্কিন জাহাজগুলিতে অ্যান্টি এয়ারক্রাফট বসিয়ে কিছু কামিকাজে প্লেনকে আকাশেই ধ্বংস করে ফেললেও বেশির ভাগ গুলোই সঠিক লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম হচ্ছিল। সেই সময় জাপান ওকা ভি টু প্লেনগুলির ককপিটে একজন চালক ছাড়াও এয়ারক্রাফ্টের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্যে একজন করে শুটার বসার ব্যবস্থা করে। এইভাবে যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত জাপানিরা আমেরিকার প্রায় ৩৪টি যুদ্ধ জাহাজকে সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়। আমেরিকা ও তার সহযোগী দেশের আরও কয়েকশো জাহাজ প্রচণ্ড ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিপক্ষের প্রায় সাত হাজার নৌবাহিনীর সৈনিকের সলিল সমাধি ঘটেছিল। এই সুইসাইডাল মিশনে জাপানের প্রায় ৩৮০০ বৈমানিক মারা যান।


কামিকাজে আক্রমণ

যাক এবার মূল কাহিনীতে ফিরি। কুমাগায়া আর্মি এভিয়েশন সেন্টারে হাজিমে ফুজি পাইলটদের সময়ানুবর্তিতা আর চারিত্রিক গঠনের ট্রেনিং ক্লাস নিতেন। তখন ১৯৪৪ সালের শেষ দিক। দলে দলে জাপানি যুবকেরা আত্মঘাতী কামিকাজে বৈমানিক বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে। আর্মি এভিয়েশন সেন্টারে বসে হাজিমে খবর পাচ্ছেন কীভাবে প্রতিদিন তার অনেক নির্ভীক ছাত্রেরাও কামিকাজে অপারেশনে আত্মঘাতী হচ্ছেন। হাজিমে ফুজি টোকিওতে জাপানের সেনাবাহিনীর প্রধান দফতরে চিঠি পাঠিয়ে জানালেন যে তিনিও এই আত্মঘাতী মিশনে নাম লেখাতে চান। তার আবেদন খারিজ হল। এর প্রধান কারণ ছিল মোটামুটি ভাবে যাদের কোনও পিছুটান নেই তাদেরই এই বাহিনীতে নিয়োগ করা হত। হাজিমে ফুজি দ্বিতীয়বার আবেদন করলেন। এবারও সেটা মঞ্জুর হল না। কর্তৃপক্ষ জানালেন যে তিনি বিবাহিত। স্ত্রী ছাড়াও তার দুই শিশু কন্যা রয়েছে। তাই তাকে কামিকাজে বাহিনীতে নাম লেখাতে দেওয়া যাবে না। হাজিমে ফুজির মন তখন ভেঙে গেছে। এর মধ্যে তিনি মাঝে কয়েকদিনের জন্যে ছুটিতে টোকিওতে তার বাড়িতে ফিরলেন। কিন্তু স্বামীর মনমরা ভাব দেখে স্ত্রী বুঝতে পারলেন যে কোথাও কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। অনেকবার জিজ্ঞেস করার পর ব্যাপারটা জানা গেল। সমস্যাটাও বুঝলেন। প্রিয় ছাত্রদের প্রতিদিন মরতে দেখে প্রচণ্ড আত্মগ্লানিতে ভুগছেন স্বামী। ছুটি শেষ হলে কুমাগায়াতে স্বামী ফিরে যাওয়ার সময় স্ত্রী বললেন আরও একবার আবেদন পত্র পাঠাতে। মিথ্যা সান্ত্বনা ভেবে হাজিমে তার ট্রেনিং সেন্টারে ফিরে এলেন।

দিনটা ছিল ১৯৪৪ সালের ১৪ই ডিসেম্বর। টোকিওতে তখন প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়েছে। খুব ভোরে উঠে হাজিমের স্ত্রী ফুকোকো তার সবচাইতে সুন্দর কিমোনোটা গায়ে দিয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে কুয়াশার মধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। বেলা দশটার সময় টোকিও পুলিশ কাছের আরাকাওয়া নদীর হিমশীতল জল থেকে যখন ফুকুকোর মৃতদেহ উদ্ধার করছে তখনও তার পিঠে এক বছরের শিশু চিকো কাপড় দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচানো। আর তিন বছরের কন্যা তাজুকোর হাত দড়ি দিয়ে শক্ত করে নিজের হাতের সাথে বাঁধা। পুলিশ তিনটি মৃতদেহের সাথে একটা সুইসাইডাল নোটও খুঁজে পায়। স্বামীর উদ্দেশে এক দীর্ঘ চিঠি। ফুকুকো লিখে গেছেন তাকে মন খারাপ না করতে। মৃত্যুর পরেও যদি কোনও জীবন থাকে তবে সেখানেও তিনি তার মেয়েদের দেখে রাখবেন। এবার আর কোনও বন্ধন নেই। হাজিমে যেন দেশের জন্যে তার ঈপ্সিত দায়িত্ব পালন করতে এগিয়ে যান। আগের দিন সন্ধ্যায় ফুকুকো তার দিদির কাছেও একটা চিঠি লিখেছিলেন। অনুরোধ করেছিলেন তার মা আর তার অবিবাহিতা ছোট বোনকে দেখাশোনা করার জন্যে।


ফুকুকোর সেই শেষ চিঠি

টেলিগ্রামে খবরটা পেয়ে হাজিমে ফুজি চমকে যান। প্রথমে মানসিক ভাবে প্রচণ্ড ভেঙে পড়লেও কিছুদিন বাদে আবার জাপানের ইম্পিরিয়াল আর্মির সদর দফতরে কামিকাজে পাইলট হিসাবে যোগদানের জন্যে ইচ্ছাপত্র পাঠান। এবার আর তার আবেদন নাকচ হল না। ১৯৪৫ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি হাজিমেকে ক্যামিকাজে শিনবু স্কোয়াড্রনের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। ১৯৪৫ সালের ২৮শে মে হাজিমে ফুজির নেতৃত্বে ৯টা যুদ্ধবিমানের একটি দল সূর্য ওঠার অনেক আগে প্রশান্ত মহাসাগরের ওকিনাওয়া দ্বীপের অদূরে মোতায়েন ড্রেক্সলার আর লাউরি নামের দুটো আমেরিকান যুদ্ধ জাহাজকে ধ্বংস করার জন্যে রওয়ানা দেয়। প্রত্যেকটা কামিকাজে প্লেনে একজন করে বৈমানিক আর একজন শুটার ছিলেন। দুটো বিমান আছড়ে পড়ে ড্রেক্সলারের উপর। একটাতে পাইলট ছিলেন হাজিমে ফুজি। ১৫৮ জন নৌসেনা শুদ্ধ ড্রেক্সলার জাহাজ টুকরো টুকরো হয়ে সমুদ্রের জলে তলিয়ে যায়। জীবনের ওপারে স্ত্রী ও দুই মেয়ের সাথে ওঁর কোনওদিন দেখা হয়েছিল কিনা সেটা জানার কোনও উপায় নেই।

ফুকুকোর লেখা সেই চিঠি এখন রাখা আছে জাপানের রাজধানী টোকিও শহরের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক স্মারক সংগ্রহশালায়। এই লেখার সাথে জাপানি ভাষায় লেখা ফুকুকোর সেই শেষ চিঠির একটা ফটোকপিও দিলাম। হাজিমে ফুজির ছবির সাথে আরেকটা ছবিতে রয়েছে ফুকুকো আর তার কোলে বড়ো মেয়ে তাজুকো।


……………………


প্রবন্ধঃ মৃত্যুঞ্জয়ী সৈনিকঃ সায়ক সেন

মৃত্যুঞ্জয়ী সৈনিক


সায়ক সেন



১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে তিলে তিলে এক অসামান্য মুক্তির গাঁথা গড়ে উঠেছিল। ভারতবর্ষের এই মহাবিপ্লবের সন্ধিক্ষণে বাংলার অবদান ছিল অনস্বীকার্য। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের নতুন প্রভাতে বাংলার অগ্নিযুগের সূচনা। আর সেই অগ্নিযুগের যে সব অসামান্য ব্যক্তিত্ব বিপ্লবের এক নতুন ধারাকে বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁদের নাম আজকের ভারতবর্ষ আর মনে রাখেনি। এমন-ই এক অসামান্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন ডঃ পবিত্র মোহন রায়। আজ তাঁর নাম কেউ মনে না রাখলেও , ভারতবর্ষের প্রতি নিবিড় প্রেমে প্রায় ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে এসেছিলেন এই অসামান্য যোদ্ধা। না, স্বাধীন ভারতবর্ষ তাঁর খোঁজ ও রাখেনি। 

১৯০৮ সালের ২-রা জুলাই পবিত্র মোহন রায় ঢাকার বিক্রমপুর পরগনায় জন্ম গ্রহণ করেন। অত্যন্ত মেধাবী এই ব্যক্তিত্ব ঢাকা ন্যাশানাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেন। কলেজে পড়াশোনা চলাকালীন নানা বৈপ্লবিক কাজে জড়িয়ে পড়েন, তাই তাঁর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। সেখান থেকে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে সোজা মালয় পৌঁছন। সেই থেকেই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। মালয়তে তাঁর সংসার বলতে ছিলেন স্ত্রী ও পুত্র। সেখানে ইংরেজদের একটি রবার বাগানে কর্মরত ছিলেন তিনি। 

এরপর এলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪১ সালের ৮-ই ডিসেম্বর জাপানি সৈন্যরা আক্রমণ করে বসল কোটাবারু বলে মালয়ের একটি শহরকে। এই কোটাবারুতেই ছিল পবিত্র মোহন রায়ের সংসার। ইংরেজ সৈন্যরা যখন বুঝল জাপানিরা কোটাবারু দখল করবেই, তখন সব আনাজ, অফিস-কাছারি, বাড়ি-ঘর ইত্যাদি পুড়িয়ে দিয়ে কয়েক হাজার ভারতীয়, চীনা ও মালয়ীকে ফেলে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে ছুটল। জাপানিরা এসে কিছুদিনের মধ্যেই পেনাং, হংকং, কোটাবারু ইত্যাদি দখল নিল। নতুন শাসক কেমন হবে, এই পরিকল্পনা তে যখন দিন কাটছে তখন পবিত্রর মনের এক অবচেতন কোণে একটা ভাবনা উঁকি দিয়ে যায়। পরাধীন ভারতের দাসত্ববন্ধন কি কাটবে না? এশিয়ায় তো ইংরেজ শক্তি ম্লান হয়ে আসছে। ভারত থেকে কি তারা বিতাড়িত হবে না? স্বাধীনতা সংগ্রাম তাঁর জীবনে এক নতুন প্রভাতের রশ্মি নিয়ে আবির্ভূত হল। সমগ্র পূর্ব এশিয়া নবজীবনের প্রাণের স্পন্দনে মূর্ত হয়ে উঠল। 

পবিত্র মোহন রায় দেশ ছাড়বার বেশ কিছু বছর আগে আরেক অগ্নি যুগের নেতা রাসবিহারী বসু নিজের গ্রেফতারি পরোয়ানা এড়িয়ে সিঙ্গাপুর পৌঁছে ছিলেন। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ। জাপান যখন মালয়ের দায়িত্ব নিল, পবিত্র এই সুযোগে লিগে যোগদান করলেন। আর সেই থেকে নানা সাংগঠনিক কাজে নিজেকে ব্যস্ত করে তুলেছিলেন। তাঁর মনের কোনও এক নিভৃত কোণে স্বাধীন ভারত দেখবার এক অসামান্য জেদ যেন তাঁর অজান্তেই জেগে উঠেছিল। 

১৯৪৩ সালের ৩ জুলাই। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু সিঙ্গাপুর এসে পৌঁছলেন। সেই সাথে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে স্বাধীনতার এক ঢেউ খেলে গেল। প্রত্যেক ভারতীয়র মনে হতে লাগল স্বাধীনতা যেন এক দূরের লক্ষ্য নয়। বরং হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে। নেতাজি আসার পর পর আজাদ হিন্দ বাহিনী এবং আজাদ হিন্দ সরকার গঠনের কাজে মনোযোগ দিলেন। তিনি জানতেন একমাত্র একটি সশস্ত্র সংগ্রাম-ই ভারতবর্ষ কে মুক্তির পথে নিয়ে যেতে পারবে। আজাদ হিন্দ বাহিনীতে পবিত্র মোহন রায় যোগদান করলেন। আর সেই থেকে তাঁর জীবনের গতিপথ কেবলমাত্র নেতাজির দ্বারাই নির্ধারিত হতে থাকল। দীর্ঘ সময় ধরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন আজাদ হিন্দের বিভিন্ন শিবিরে। নেতাজি তাঁকে আজাদ হিন্দ বাহিনীর গুপ্তচর বিভাগে যুক্ত হওয়ার কথা জানালে পবিত্র সানন্দে তা গ্রহণ করলেন। গুপ্তচর বিভাগের বিশেষ প্রশিক্ষণ যখন চলছে, তখন নেতাজি নিজে পবিত্র ও তাঁর সঙ্গীদের সাথে দেখা করতে আসতেন। কথা চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। 

১৯৪৪ সালের ৪ মার্চ, পবিত্র মোহন রায়, মহেন্দ্র সিংহ, অম্রিক সিং গিল এবং তুহিন মুখার্জিকে নিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের মেজর স্বামী একটি সাবমেরিনের সামনে এসে দাঁড়ালেন। মেজর স্বামী আগে থেকেই বলে দিয়েছেন কী করতে হবে তাঁদেরকে। উদ্দেশ্য ভারতবর্ষ পৌঁছে বাংলায় গিয়ে একটি বেস তৈরি করা এবং সেই বেস থেকে দেশে কী চলছে তা বেতার মাধ্যমে জানানো। এ ছাড়া ও দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরা আজাদ হিন্দ ফৌজের অসম্ভব বিক্রম এবং বলিদানের কথা। 

দীর্ঘ দশ দিনের সাবমেরিন যাত্রার পর শেষ পর্যন্ত কোনার্কের মন্দিরের সামনের নামার চেষ্টা করল এই বিপ্লবী দল। কিন্তু উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ তাঁদের বেলাভূমি থেকে বহুদূরে ডিঙি সমেত ছিটকে ফেলল। সারারাত সাঁতার কেটে শেষ রাতের ঠিক আগে তাঁরা বেলাভূমিতে এসে পৌঁছলেন। পুরী পর্যন্ত একসাথে চলে দলটি দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদিকে তুহিন মুখার্জি আর মহেন্দ্র সিং এবং অন্য দিকে পবিত্র মোহন রায় এবং অম্রিক সিং গিল। কিছুদিন পরে পুরী তে তাঁরা আলাদা হয়ে গেল, পবিত্র চলে এলেন কলকাতায়। কলকাতায় নিজেকে এক জমিদার বলে পরিচয় দিয়ে একটি হোটেলে উঠলেন। এই সময় তিনি বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে আলাপ করে তাঁর সাহায্য করতে বলেন, কিন্তু প্রায় কেউ-ই রাজি হল না। একদিন পবিত্র দেখলেন অম্রিক সিং কে। তাঁর কাছ থেকে নেতাজির দাদা সুরেশ চন্দ্র বসুর মেয়ে বেলা মিত্র এবং তাঁর স্বামী হরিদাস মিত্রের কথা শুনলেন। বেলা মিত্র যখন শুনলেন পবিত্রদের স্বয়ং নেতাজি পাঠিয়েছেন, তখন তাঁর আনন্দের বাঁধ ভাঙল। হরিদাস মিত্র যথাসম্ভব সাহায্য করলেন এই গুপ্ত বিপ্লবী দলটিকে। এদিকে একটা বিষয়ে পবিত্রদের ভাবিয়ে তুলল। তুহিনের দেখা করার দিন পেরিয়ে গেছে, কিন্তু সে আসেনি। তবে কী সে ব্রিটিশ গোয়েন্দার হাতে ধরা পড়ল? মহেন্দ্র সিং ও এর মধ্যে কলকাতা এসে পৌঁছেছেন। কিন্তু তুহিনের দেখা নেই। 

অনেক খোঁজ করে শেষ পর্যন্ত বেহালার একটি বাড়ি কে নির্বাচন করা হল আজাদ হিন্দ ফৌজের বেতার স্টেশন রূপে। নানা রকম খাটাখাটনি করে শেষ পর্যন্ত নেতাজির আদেশ পালন করলেন পবিত্রদের দল। বেস তৈরি হয় নিয়মিত খবর যেতে লাগল আজাদ হিন্দ সরকারের হেড কোয়ার্টারে। কিন্তু সুখ বেশি দিন স্থায়ী হল না। কিছু দিনের মাথায় হরিদাস মিত্রকে পুলিশ গ্রেফতার করল গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগে। ফলে পবিত্রকে সেই মুহূর্তে কলকাতা ত্যাগ করে পুরী তে গিয়ে আবার উঠতে হল। ইতিমধ্যে অম্রিক সিং গিল এবং মহেন্দ্র সিং ও ধরা পড়লেন পুলিশের কাছে। পুরীতে গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন একমাত্র পবিত্র। সেখানেও এবার পুলিশের নজর গেল। এক হোটেলের মালিকের সন্দেহ হওয়াতে পুলিশ নিয়ে সোজা পবিত্রর কাছে হাজির হন। আর সেখান থেকে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালাতে যান ভারতবর্ষের এই বাস্তব জীবনের জেমস বন্ড। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। কিছু দূর গিয়েই ধরা পড়লেন পবিত্র মোহন রায়। 

আদালতে কেস উঠল। কিন্তু বিচারের নামে প্রহসন হত সেটা আলাদা করে বলে দিতে হয় না। আদালতে সরকার পক্ষের প্রথম সাক্ষী দেখে পবিত্রর মাথা ঘুরে গেল। তুহিন মুখার্জি! বিশ্বাসঘাতক!

আদালতের সেই প্রহসনে পবিত্র মোহন রায়, হরিদাস মিত্র এবং অম্রিক সিং গিলের ফাঁসির সাজা হল। তাঁদের নিয়ে যাওয়া হল জেলখানার ভিতর ফাঁসির ঘরে। কিন্তু পবিত্রর মনে তখন অপার্থিব শান্তি। কারণ ততদিনে আজাদ হিন্দ ফৌজের নামে দেশে ঝড় বয়ে গেছে। সবাই জেনেছে নেতাজি ঐ মালয়, সিঙ্গাপুর আর জাপানের মাটি থেকে ভারতবর্ষের জন্যে কী অসামান্য কাজ করে গেছেন। ব্রিটিশ সেনা বাহিনীতে ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে তখন আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতি এক সহানুভূতি দেখা দিয়েছে। 

মৃত্যু যখন অবধারিত জেনে নিয়েছেন, ঠিক তখন -ই পবিত্রর জীবনে আরেকটি মোড় এল। বেলা মিত্র (যার নামে বেলানগর স্টেশন) নিজের স্বামী ও তাঁর বৈপ্লবিক বন্ধুদের ছাড়াতে উদ্যত হলেন। তিনি সোজা ছুটলেন গান্ধিজির কাছে। গান্ধিজি কে রাজি করিয়ে সোজা ভাইসরয় কে চিঠি লেখালেন। একবার নয়, বহুবার। বেলা মিত্রের অকাট্য যুক্তির সামনে দাড়িয়ে ব্রিটিশ সিংহ মাথা নত করল। ফাঁসির সাজা মকুব হয়ে তা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশে পরিণত হল। তখন দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়ায় দ্রুত বদল ঘটছে। ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার প্রত্যূষে দাড়িয়ে। সেই আবহাওয়ার সুরেই তাল মিলিয়ে পবিত্র মোহন রায় এবং তাঁর সঙ্গীরা ছাড়া পেলেন। 

স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে পবিত্র মোহন রায়ের ভূমিকা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি তাঁর ‘লিডার’–এর খোঁজ পেয়েছিলেন উত্তর প্রদেশের এক অখ্যাতনামা জায়গায়। কিন্তু সে অন্য কথা। শুধু এইটুকুই বলা চলে, পবিত্র মোহন রায় নিজের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নেতাজির জন্যে কাজ করে গেছেন।


………………




সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়


বইমেলা এসে যাচ্ছে। আসবো না আসবো না করেও এসে যাচ্ছে ঠিক। যেন খুব রাগী লোক হাসবো না হাসবো না করেও হেসেছে কিঞ্চিৎ। হয়তো কিছুটা ভয়ে, কিছুটা সংকোচে, তবুও হেসেছে তো! ওই একচিলতে হাসিতেই লক্ষ আলোর রোশনাই। আমরা, যারা বই ভালোবেসে, বইয়ের আশেপাশেই বাঁচি তাদের কাছে এই বইমেলাটুকু এক টুকরো তাজা অক্সিজেন। প্রতিদিন অফিস ফেরতা ক্লান্ত শরীরেও ঘন্টাখানেক আড্ডা, পুরোনো বন্ধুদের সাথে বাৎসরিক দেখাসাক্ষাৎ, টুকটাক বই দেখা অথবা কেনা, লিটিল ম্যাগাজিনের জটলা, সব মিলিয়ে বড্ড বেশি প্রাণের কাছে থাকে এই বইমেলা। কোভিডের ভয়ে এবারে হয়তো ততখানি জমাটি হবে না বইমেলা, তবুও কিছু তো হবেই। সেই স্নিগ্ধ পরশটুকু নিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যাবে পরের বছরটুকু। সেই বইমেলার উপলক্ষেই সেজেছে আমাদের এই সংখ্যা। আমাদের পঞ্চালিকা পত্রিকাটা ওয়েব ম্যাগাজিন। ছাপা অক্ষরে আপনাদের হাতে আমরা নাই বা থাকলুম, তবুও, এই আন্তর্জালের দুনিয়ায়, আপনাদের আশেপাশে রইলুম আমরা। 

এবার আসি চারপাশের খবরে। চারপাশের পরিস্থিতি ভালো নয়। গুগাবাবার ভূতের রাজার মতো বলতে ইচ্ছে করছে, দিনকাল ভালো নয়, গ্রহতারা ভালো নয়, সোজাপথে থাকা চাই। তবুও দিনকাল যেন খারাপই হয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবেই তার থেকে রেহাই পাচ্ছি না। আমার দেশটা স্বাধীন। আর গণতন্ত্র খোঁড়া হলেও এতোদিন অন্তত সে নীরোগ ছিলো। তার প্রমাণ, আমরা যা খুশি বলতে পারি। আমাদের বাক স্বাধীনতা আছে। আমি আজ হয়তো সাদাকে ভালো বললুম, কালকে বেগুনিকে বললুম আরো বেশি ভালো। অথবা পরশু বললাম, আগেরটা ভুল, আমার বেস্ট চয়েজ ব্রাউন।

বলতেই পারি এমন। আমার সংবিধানে পারমিশন দেওয়া আছে। আমার ইচ্ছে অনিচ্ছে, আমার মত অমত পালটাতে পারে। আমার মতামত দেওয়ার অধিকার, আমার দল নির্বাচনের অধিকার, খাদ্যাভ্যাসের অধিকার, ধর্মাচরণের অধিকার, এমনকি সমালোচনা করার অধিকারের কথাও বলা আছে সংবিধানে। এই সমস্ত অধিকারের ওপর এখন ঢ্যাড়া পড়েছে। প্রহসন হয়ে দাঁড়িয়েছে সংবিধানের এই বেসিক নীতিগুলি। এখন জোর যার, মুলুক তারই। বাকিদের মতপ্রকাশেরও অধিকার নেই। 

ভলতেয়ার বলতেন, “আমি রাজনৈতিকভাবে তোমার কথার সঙ্গে দ্বিমত করতেই পারি, কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকারের জন্য জীবন দিতে পারি।”

এই উন্মত্ত ধর্মান্ধ দেশ, এসব তত্ত্বকথা বোঝে না। সে চায় দাঙ্গা, সে চায় বিধর্মীদের হত্যা, আর নিজ ধর্মের প্রভুত্ববিস্তার। সহনশীলতার নীতির কোনো মূল্য নেই তাদের কাছে। প্রতিবেশী ছাড়া যে বেঁচে থাকা দুস্কর তা তারা বোঝে না। এতোগুলো বিশ্বযুদ্ধ, নৃশংস দেশভাগ, মানবতার এতো চূড়ান্ত অবমাননার পরেও আমরা শিখে উঠতে পারিনি যে পাশের লোকটির হাত না ধরলে আমারও বেঁচে থাকা দুস্কর হয়ে উঠবে। ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলছে হিংসা, আর ধর্মীয় আগুন। এর অবধারিত ফল মৃত্যু। আমার পাপ, আমার হিংসার দায় বহন করবে আমারই সন্ততিরা। কেউ ছাড়া পাবে না। কেউ ছেড়ে দেবে না! দু'পক্ষই টিকে থাকবে জ্বলজ্বলে চোখে প্রতিহিংসার ঘৃণাটুকু লাগিয়ে। প্রতিহিংসা  আর অপমানের জ্বালা তো একজীবনে মেটে না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরেই সেই গ্লানি বয়ে যায়। সেই গ্লানিকেই যেন জোর করে খুঁচিয়ে তুলছে এই দেশের সরকার। বর্তমান রাজনীতিতে আজকাল ঘনঘন সাম্প্রদায়িক হুংকার শোনা যাচ্ছে শাসকদলের মুখে। ভিন্ন ধর্মের লোককে বিদেশি তকমা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এন আর সি করে আতঙ্কের ছায়া ছড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের রোজকার জীবনে। আমরা ভালো নেই। কেউ ভালো নেই আজ। সর্বত্র আতঙ্কের ছোঁয়া। কৃষক মরছে ঋণের বোঝায়, অথচ বড় বড় ব্যবসায়ীরা স্বচ্ছন্দে ঋণ খেলাপ করে লক্ষ কোটি টাকার বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে আমাদের ঘাড়ে। কুটিরশিল্প হারিয়ে যাওয়ার পথে, এদিকে মহাকাশযান পাঠিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচা করে আমাদের মেকি জাতীয়তাবাদকে উসকে দেওয়া হচ্ছে। দেশের অর্থনীতি তলানিতে। রোজগারপাতি নেই চারদিকে, কি করে টিকে থাকবো আমরা? কি করে বাঁচবে আমাদের সন্ততি? কোন আশা নিয়ে? 

জনগণ ভাবুক। জোয়ারে গা না ভাসিয়ে আরো বেশি চিন্তিত হোক প্রতিটি মানুষ। আরো বেশি ভাবুক, নিজের মতো করে। নিজের ঘাম রক্ত বোধবুদ্ধি দিয়ে বিচার করুক সে। সিদ্ধান্ত নিক নিজের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে। আমার দেশ আমাদেরই হাতে গড়া হবে। হয়তো একদিন এই অন্ধকার কাটিয়ে সূর্যের ভোর আসবে। আমরা আবার হয়তো বলতে শিখবো, 

দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে/

এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে/

আমরা আশাবাদী। 

ভালো থাকবেন সকলে। আমাদের পত্রিকার সমালোচনা আমরা পেতে আগ্রহী। ভালো মন্দ যেমনই লাগুক, আমাদের ইমেলে জানান। আমরা প্রতীক্ষায় থাকলুম।


ধন্যবাদান্তে


পারমিতা মালী

প্রধান সম্পাদক

পঞ্চালিকা আন্তর্জাল সাহিত্য পত্রিকা


শ্রদ্ধ্যাঞ্জলি

শ্রদ্ধ্যাঞ্জলি


২৩শে জানুয়ারি বাঙালি তথা সকল ভারতবাসীর কাছেই এক পবিত্র দিন। সুভাষচন্দ্র দেশপ্রেম, বীরত্ব, আদর্শ ও অনুপ্রেরণার সমার্থক। কিন্তু এটা অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপার যে এখনও পর্যন্ত এই দিনটি জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি এবং সুভাষচন্দ্রের জীবনের শেষ পরিণতি কী হলো সে সত্য আজও সরকারি ভাবে জানানো হচ্ছে না। সুভাষ-চর্চার একটা সার্বিক অভাবও লক্ষণীয়। 

এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার জন্যই মিশন নেতাজির পথ চলা শুরু ২০০৫-এ। কাজ অনেকটাই এগিয়েছে, সাফল্যও বেশ কিছু এসেছে। তবু এখনও অনেকটাই পথ বাকি। 

এই শুভ দিনে পঞ্চালিকা আন্তর্জাল সাহিত্য পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশ খুবই আনন্দের কথা। মিশন নেতাজির পক্ষ থেকে জানাই শুভেচ্ছা। শুভকামনা রইল। পাঠকদের জিজ্ঞাসু মনকে সমৃদ্ধ করুক এই কামনা করি। 


চন্দ্রচূড় ঘোষ

মিশন নেতাজির প্রতিষ্ঠাতা এবং Conundrum -এর লেখক



ছবিসূত্র- আন্তর্জাল

প্রবন্ধঃ হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজনঃ স্বপন সেন

 হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন?


স্বপন সেন



২১শে অক্টোবর ১৯৪৩....

আজাদ হিন্দ ফৌজের তরফে সিঙ্গাপুর রেডিয়ো থেকে মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন নেতাজী। এরই মাঝে চলতে লাগল অর্থ ও রসদ সংগ্রহ। সিঙ্গাপুরের প্রাচীন চেট্টিয়ার মন্দির পরিষদের সভাপতি ব্রিজলাল জয়সওয়াল একদিন এলেন নেতাজির কাছে। উদ্দেশ্য মন্দির পরিষদের তরফে আজাদ হিন্দ ফান্ডে অর্থ দান। তবে যেহেতু হিন্দু মন্দির, তাই কিছু শর্ত আছে।

শুনেই নেতাজি বললেন, “দান হবে নিঃশর্ত। হাজার হাজার ভারতীয় যেখানে বুকের রক্ত দিচ্ছে সেখানে শর্ত কীসের? আর আমি তো অর্থ চাইছি, রক্ত নয়।”

সবিনয়ে তখন ব্রিজলালজি বলেন, “আজ্ঞে শর্ত ঠিক নয়, আমাদের একটা আবেদন আছে। আপনি যদি অনুগ্রহ করে ট্যাঙ্ক রোডে আমাদের মন্দিরে পদধূলি দেন, তাহলে সেখানেই আমরা আপনার হাতে টাকার তোড়াটা তুলে দিয়ে ধন্য হই।” 

নেতাজি হেসে বলেন, “মন্দিরে আমার পদধূলি দেব কী? ভক্তদের পদধূলি নিজেই তুলে নেব মাথায়। তবে আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক হিসেবে কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের মন্দিরে আমার যাওয়া উচিত হবে না।”

“কেন নেতাজি? আপনি তো হিন্দু।”

“না, সুভাষ বোস হিন্দু। নেতাজি শুধু ভারতীয়।”

“তবে সুভাষ বোস হিসেবেই যাবেন।”

“যাব, তবে ফৌজি পোশাকে নয়, আর তখন টাকাও নিতে পারব না আমি।”

এবার একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন ব্রিজলালজি। শেষে বলেন, “কিন্তু আমরা চাইছিলাম আপনি নেতাজি হিসেবেই যাবেন, সেখানে আমাদের সম্বোধন করে কিছু উপদেশও দেবেন। তা কি কিছুতেই হতে পারে না নেতাজি?”

চোখ দুটি ধক করে জ্বলে উঠল নেতাজির। বললেন, “পারে। এক শর্তে। নেতাজি হিসেবে আমি যদি যাই, তাহলে আমার সমস্ত সহকারী যাবেন আমার সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে শিখ আছেন, খ্রিস্টান আছেন, আছেন অনেক মুসলমান। এঁদের সবাইকে যদি মন্দির চত্বরে প্রবেশ করতে দেন, তবেই যেতে রাজি। কী, পারবেন?”

একেবারে নিভে গেলেন ব্রিজলাল জয়সওয়াল। তিনি জানেন, এ অসম্ভব কথা। গুজরাটি চেট্টিয়ারদের এ মন্দিরে কোনও বিধর্মী কখনও প্রবেশ করেনি। ব্রাহ্মণ ছাড়া উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ ছেড়ে কেউ কখনও অন্তরালে দাঁড়িয়ে দেবদর্শন করেনি, পূজারী ব্রাহ্মণ ছাড়া গর্ভগৃহে কেউ কখনও প্রবেশ করেনি। নেতাজি বললেন, “না হয় মন্দির কমিটির সঙ্গে কথা বলে পরে আমাকে জানাবেন।” মাথা নিচু করে উঠে চলে গেলেন ব্রিজলাল জয়সওয়াল। যে সময় অর্থের ভীষণ প্রয়োজন তখন একটা ভাল অনুদান ফসকে গেল, ভাবলেন নেতাজির কিছু ছায়াসঙ্গী। নেতাজি তাঁদের হেসে বলেছিলেন, ‘আমার বিবেকের দাম ওই লক্ষাধিক টাকার অনুদানের চেয়েও বেশি’।

আশ্চর্য, পরের দিনই আবার ফিরে এলেন ব্রিজলালজি। সঙ্গে মন্দির কমিটির আরও চার–পাঁচজন কর্মকর্তা। হাত জোড় করে ব্রিজলালজি বললেন, “আমরা নিমন্ত্রণ করতে এসেছি নেতাজি ও তাঁর সহকর্মীদের। কবে আপনাদের সুবিধা হবে বলুন?”

“আমার মুসলমান ও খ্রিস্টান বন্ধুরাও কিন্তু আমার সঙ্গে যাবেন।” 

“আমরা বিবেচনা করে দেখেছি নেতাজি, যে ওঁরা মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর চোখে মুসলমানও নন খ্রিস্টানও নন। ওঁরা মায়ের সেবক। আমরা ফুল দিয়ে অর্ঘ্য দিই, ওঁরা বুকের রক্ত দিয়ে মায়ের পূজা করছেন, ওঁরা আরও বড় ভক্ত।”

ট্যাঙ্ক রোডের মন্দিরের দ্বার সেদিন উন্মুক্ত— যেন ভারততীর্থ। নেতাজি প্রায় একশত জন তাঁর সমরসচিব ও অনুচর–সহ মন্দির প্রাঙ্গণে উপস্থিত হলেন। মন্দিরদ্বারে এঁরা উপস্থিত হলে গুজরাটি মেয়ের দল উলুধ্বনি দিয়ে খই আর ফুল ছুঁড়তে থাকে। প্রত্যেককে চন্দনতিলক পরিয়ে বরণ করে নিল এক অপরূপা, ব্রিজলালজির কন্যা। নেতাজি টপবুট খুলে রেখে মন্দিরে প্রবেশ করলেন, অন্য সবাই সেভাবেই অনুসরণ করলেন। খ্রিস্টান আইয়ার, মুসলমান শাহনওয়াজ, জামান কিয়ানী আর হবিবর রহমন–সহ পাঁচজনের হাতে নৈবেদ্য ও প্রসাদী ফুল তুলে দিলেন পুরোহিত।

উদাত্তকণ্ঠে নেতাজি সেদিন বক্তৃতা দিলেন। অনেক মানুষের সমাগম হয়েছে মন্দির চত্বরে। স্তব্ধ হয়ে শুনল সবাই। নেতাজি বললেন, “ভারতমায়ের সন্তান আমরা, আমাদের ধর্ম আলাদা হতে পারে, কর্ম আলাদা হতে পারে, বর্ণ আলাদা হতে পারে, কিন্তু আমরা একই মায়ের সন্তান। মা আজ শৃঙ্খলিত। আমরা সবাই মিলে প্রতিজ্ঞা করেছি, মাকে শৃঙ্খলমুক্ত করব। তুমি হিন্দু আমি মুসলমান, তুমি শিখ আমি খ্রিস্টান, বেশ তো, কেউ কারও ধর্মে আমরা হাত দেব না। এ মরণপণ যুদ্ধে আমাদের পুকার হবে ‘জয়হিন্দ’।” 

ধ্বনি উঠল— হর হর মহাদেব, আল্লাহ–উ–আকবর নয়— একমাত্র আওয়াজ ‘জয়হিন্দ’।

ওঁরা নেতাজির হাতে তুলে দিলেন লক্ষ টাকার চেক।

জানি না ধর্মনিরপেক্ষতার এমন নিদর্শন আর কোনও ভারতীয় দেশনায়ক কখনও রাখতে পেরেছেন কিনা। কিন্তু ভারতীয় জাতির ধর্মনিরপেক্ষতার বুনিয়াদ সেদিনই গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। নেতাজি ছিলেন সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের অদ্বিতীয় মহানায়ক, যিনি রূপকথাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন।


……………..


    


প্রবন্ধঃ মূল্যবোধ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনেঃ কৃষ্ণেন্দু দেব

মূল্যবোধ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে


কৃষ্ণেন্দু দেব

      

  

প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়, ইনটারনেটে বা পথেঘাটে নিত্যদিন আমরা হাজারো বিজ্ঞাপনের মুখোমুখি হই। কোনও সংস্থা বা ব্যক্তিবিশেষ নিজের প্রোডাক্ট বা পরিষেবা সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই দিয়ে থাকে ঐ বিজ্ঞাপনগুলো। এতে দোষের কিছু নেই। ব্যবসার খাতিরে এমনটা কেউ করতেই পারে। কিন্তু বিজ্ঞাপনে মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করে মানুষকে আকৃষ্ট করতে চাইলে তা প্রতারণারই নামান্তর। সেটা কিছুতেই মেনে নেওয়া উচিত নয়। তাই বিশেষত মানবস্বাস্থ্য নিয়ে এই লোক-ঠকানোর প্রবণতা রোধ করার উদ্দেশ্যেই ১৯৫৪ সালে তৈরি হয়েছিল ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস (অবজেকশনেবল অ্যাডভার্টাইজিং) অ্যাক্ট।        

আইনটা তৈরি হয়েছিল বটে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ঐ আইনের প্রয়োগ বিশেষ একটা হয়নি। তাই অমুক শ্যাম্পু চুলের পুষ্টি জুগিয়ে চুল পড়া বন্ধ করে বা তমুক ক্রিম ব্যবহার করলে তিন সপ্তাহের মধ্যে গায়ের রং ফর্সা হয়ে যায়, কিংবা অমুক হেলথ ড্রিঙ্ক খেলে বাচ্চার মেধার দ্রুত বিকাশ ঘটে-এমন অনেক বিজ্ঞাপনে মানুষ ঠকে এসেছে দীর্ঘদিন ধরে। এমনিতেই ছাপার অক্ষরে কিছু পড়লে, বা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে কিছু দেখলে বেশিরভাগ লোকই তা ধ্রুব সত্য বলে মনে করে। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তো এই প্রবণতা আরও বেশি। তাই ‘বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে’---এই মিথ্যা ভাষণ দিয়ে শ্যাম্পু, ফেয়ারনেস ক্রিম বা হেলথ ড্রিঙ্কের ঐসব বিজ্ঞাপন দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে বোকা বানিয়ে এসেছে।

আসলে কোনও তথ্য কেউ বিশ্বাস করবে কী করবে না, তা নির্ভর করে যে লোকের সামনে তথ্যটা পেশ করা হচ্ছে সে কতটা যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক, তার ওপর। চুল আমাদের দেহত্বক থেকে উৎপন্ন হলেও তা আদতে জড় পদার্থ ছাড়া আর কিছুই নয় (তাই চুল কাটলে রক্ত পড়ে না, ব্যথাও লাগে না) এবং সেই কারণে বাইরে থেকে প্রোটিন বা ভিটামিন সমৃদ্ধ তেল বা শ্যাম্পু প্রয়োগ করে চুলের পুষ্টি সাধন বা বৃদ্ধি ঘটানো আদৌ সম্ভব নয়। এমনটা যদি বাস্তবে ঘটত, তাহলে কাঠের একটা টুকরোর গায়ে প্রতিদিন সার দিলে সেটাও ধীরে ধীরে লম্বা হয়ে যেত। এই সরল সত্যিটা বোঝার মতো বিচারবুদ্ধি, বলতে বাধা নেই, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে আমাদের দেশের বহু মানুষেরই নেই। থাকলেও কার্যক্ষেত্রে তারা সেটা প্রয়োগ করে না। তাই করোনা রুখতে কেউ গোমূত্র সেবন করে, আবার কেউ করে যজ্ঞের আয়োজন! সেই কারণে এ দেশের সিংহভাগ মানুষ বিজ্ঞাপনের যেকোনও আজগুবি দাবিও যে বিশ্বাস করবে, তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে!

এই সমস্ত ব্যাপার মাথায় রেখেই গত ৩ ফেব্রুয়ারি (২০২০) কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক ১৯৫৪ সালের ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস (অবজেকশনেবল অ্যাডভার্টাইজিং) আইনটিকে আরও কঠোর করে একটি খসড়া বিলের প্রস্তাব করেছে। তাতে বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে প্রতারিত করার চেষ্টা করলে সর্বোচ্চ পঞ্চাশ লাখ টাকা জরিমানা আর সর্বাধিক পাঁচ বছর কারাবাসের বিধান আছে। প্রস্তাবিত এই বিলে সময় ও প্রযুক্তির পরিবর্তনকে মাথায় রেখে বদলানো হয়েছে বিজ্ঞাপনের সংজ্ঞাও। আগে এইডস, ছানি পড়া, হার্নিয়া সহ ৫১টি অসুস্থতা নিরাময়ের অবৈজ্ঞানিক দাবি করা ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতির বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ ছিল। এই সংশোধনীতে ঐসব রোগ-ব্যাধির সংখ্যা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৭৮।

অতঃপর ওষুধের গুণে সেরে যাবে ক্যানসার, মধুমেহ, তোতলামো বা পারকিনসন ডিসিজ, হেয়ার অয়েল বা শ্যাম্পুর ছোঁয়ায় চুল পড়া বন্ধ হবে কিংবা নারী-পুরুষের যৌন অঙ্গ হবে বিবর্ধিত, ক্রিমের জাদুতে কালো মেয়ে মাত্র তিন সপ্তাহে হয়ে উঠবে ধবধবে ফরসা (কালো ছেলের কিন্তু সেটায় আবার কাজ হবে না, তার জন্য অন্য ফেয়ারনেস ক্রিম)---বিজ্ঞাপনে এমন সব অবাস্তব, অবৈজ্ঞানিক দাবি আর করা যাবে না। বিলটি যদি ভবিষ্যতে সত্যিই আইনসভায় পাশ এবং কঠোরভাবে কার্যকরী হয়, তাহলে দেশের মানুষ প্রতিনিয়ত প্রতারণার হাত থেকে কিছুটা হলেও যে রক্ষা পাবেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। আইনটা কঠোরভাবে কার্যকরী না হলে কিন্তু মানুষ সেই আগের মতো প্রতারিত হতেই থাকবে।

তবে শুধু স্বাস্থ্য নয়, ইদানীংকালে এমন অনেক বিজ্ঞাপন নিয়মিত প্রচারিত হয় যেগুলো আমাদের শিক্ষাজগতেও যথেষ্ট কুপ্রভাব ফেলছে। ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ছাত্রসমাজ। সমস্যাটা তুলে ধরতে গেলে পুরোনো কিছু স্মৃতি রোমন্থন আবশ্যক। মনে পড়ে ছেলেবেলায় মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিকের ফলপ্রকাশের পরদিন খবরের কাগজের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তাম। যারা মেধাতালিকায় একেবারে ওপরে, তাদের নাম, পরিচয়, ছবি আর বিভিন্ন বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বর ছাপা হত কাগজে। কেউ অঙ্কে একশোয় একশো পেয়েছে তো কেউ ইংরাজিতে একানব্বই।

ঐ ছেলে-মেয়েগুলোকে তখন মনে হত কোনও অন্য গ্রহের জীব বুঝি। বাড়িতে বাবা-কাকা আর স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকা---সবাই ওদের প্রসঙ্গ তুলে বলতেন, ওরা শুধু মেধাবি নয় দারুণ পরিশ্রমীও বটে। ওরা একটা বিষয়ের অনেকগুলো বই পড়ে, সিলেবাসের বাইরেও অনেক কিছু অধ্যয়ন করে, সারা বছর কঠোর অনুশীলনের মধ্যে থাকে। তবেই না আসে এমন সাফল্য। বলতে বাধা নেই, মফস্সল এলাকায় থাকতাম বলেই হয়তো, কলকাতার কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে পর্যন্ত কাগজে ছবি ওঠা অমন কোনও নক্ষত্রকে সামনাসামনি দেখার সুযোগ হয়নি আমার। প্রথম যাঁর সাথে আলাপ হয়েছিল তিনি পেশায় অধ্যাপক, আশির দশকের প্রথমভাগে মাধ্যমিকে তৃতীয় এবং উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। তখন তো আর স্কুলে পড়া নবীন কিশোরটি নই, রীতিমতো কলেজের ক্লাস বাঙ্ক করে কফিহাউসে আড্ডা জমানো তরুণ আমি---তাও সেদিন ভদ্রলোককে চোখের সামনে দেখে মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত শিহরন খেলে গিয়েছিল। এলিয়েন দেখার অনুভূতি যেন!

কিন্তু একুশ শতকে পা দিতেই সব কিছু বদলে যেতে শুরু করল অতি দ্রুত। আমরা আগে লেখকের নাম দেখে পাঠ্যপুস্তক কিনতাম। দেখলাম ধীরে ধীরে লেখককে ছাপিয়ে উঠে এল কয়েকটা প্রকাশনা সংস্থার নাম। তারপর বোর্ড বা কাউন্সিলের পরীক্ষায় র‍্যাংকধারীদের প্রায় সকলকেই নির্দিষ্ট কিছু প্রকাশনা সংস্থা বা কোচিং সেন্টারের প্রোডাক্ট বলে ভ্রম হতে লাগল। ইদানীংকালে তো মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পর থেকে বছরভর খবরের কাগজের পাতায় কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় কেবল ঐ কৃতী প্রোডাক্টদের মুখই চোখে পড়ে। একেক দল কৃতী একেকটা সংস্থার বই হাতে টানা বিজ্ঞাপন দিয়ে চলেছেন, ঐ বই পড়েই তাঁরা নাকি পেয়েছেন অমন আকাশ ছোঁয়া সাফল্য এবং স্কুলে ভর্তি হওয়া ইস্তক তাঁরা শুধুমাত্র ঐ প্রকাশনার বইপত্রই পড়ে আসছেন!

এই বিজ্ঞাপন দেখে মনে প্রশ্ন জাগে---তাহলে কি এখন আর জীবনের এই বড়ো পরীক্ষাগুলোতে সেরা হওয়ার জন্য আগের মত মেধা, পরিশ্রম বা অধ্যবসায়ের প্রয়োজন হয় না? মাত্র একটা সংস্থার প্রকাশিত বই পড়েই এত সহজে পৌঁছে যাওয়া যায় সাফল্যের চূড়ায়? এই সমস্ত প্রশ্নের জবাব অবশ্য আমাদের সকলেরই জানা। আমাদের কৃতীরা বিজ্ঞাপনে যা-ই বলুন, বাস্তবে তাঁরা কঠোর পরিশ্রম করেই অর্জন করেছেন ঐ সাফল্য, তাঁদের পূর্বসূরীদের মতোই। আর এই কারণেই, কোনও প্রকাশনার বই হাতে নিয়ে সেরা ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া ঐ বিজ্ঞাপনগুলোকে টাক-মাথায় চুল গজানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া লোক ঠকানো বিজ্ঞাপনের থেকে আর যেন আলাদা করা যায় না।

কেউ অবশ্য এক্ষেত্রে যুক্তি সাজাতেই পারেন, বিরাট কোহলি বা সৌমিত্র চ্যাটার্জির মত বিখ্যাত মানুষরাও তো সিমেন্ট বা সরষের তেলের বিজ্ঞাপন করেন। ওঁরা নিশ্চয়ই ঐ সিমেন্ট বা ভোজ্যতেলের গুণমান যাচাই করে তারপর বিজ্ঞাপনগুলো করেননি। অমিতাভ বচ্চন কোনও ডিটারজেনণ্ট বা মাথা ঠান্ডা করার তেলের বিজ্ঞাপন করার আগে নিশ্চয়ই সেগুলোর কার্যকারিতা ল্যাবরেটরিতে গিয়ে পরীক্ষা করেননি। তাহলে এই মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের কৃতীরা কোনও বিশেষ পাঠ্যপুস্তকের গুণগান করলে অত আপত্তির কী আছে? তাতে কী মহাভারতটা অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে? 

আপত্তির কারণ, দু’রকম বিজ্ঞাপনের মধ্যে নীতিগত ফারাক। বিরাট কোহলি, সৌমিত্র চ্যাটার্জি বা অমিতাভ বচ্চনরা যে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, নামি রেস্তোরাঁর শেফ বা কোনও প্রখ্যাত বায়োকেমিস্ট নন, সেকথা সবাই জানে। কেবল ওঁদের বিপুল জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে লোকের কাছে ঐ প্রোডাক্টগুলোকে চিনিয়ে দেওয়ার জন্যই যে বিজ্ঞাপনগুলো বানানো হয়েছে, সেটা বুঝতে তাই কারো অসুবিধা হয় না। অর্থাৎ নৈতিকতার প্রশ্নে ওগুলোকে কখনোই লোক ঠকানো বিজ্ঞাপন বলা যায় না। তবে হ্যাঁ, আজ যদি বিরাট কোহলি, সৌমিত্র চ্যাটার্জি বা অমিতাভ বচ্চন কোনও বিজ্ঞাপনে বলতেন যে অমুক ক্রিকেট কোচিং অ্যাকাডেমিতে খেলা শিখে কিংবা তমুক ড্রামা ইনস্টিটিউট বা ফিল্ম সেন্টারে অভিনয় শিখে ওঁরা ঐ আকাশ-ছোঁয়া সাফল্য পেয়েছেন, তবে সেটাকে অবশ্যই অনৈতিক, মূল্যবোধহীন কাজ বলা যেত।

আমাদের আজকের কৃতী ছাত্রছাত্রীরা কিন্তু নির্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তক বা কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন দিয়ে সেই অনৈতিক কাজটাই করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। আগামীদিনে যে সমস্ত ছেলেমেয়ে বোর্ড বা কাউন্সিলের পরীক্ষায় বসবে, তাদের অনেকেই এমন বিজ্ঞাপন দেখে নিশ্চয়ই বিভ্রান্ত হচ্ছে। তারা অনেকেই নিশ্চয়ই ভাবছে কোনও বিষয়ের পাঁচটা বই ঘেঁটে পড়াশোনা করার দরকারটা কী? স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ যেভাবে নিয়মিত অনুশীলনের কথা বলেন, সেসবেরও প্রয়োজন নেই। সহজে সাফল্যলাভের চাবিকাঠি তো আমাদের দাদা-দিদিরা দেখিয়েই দিয়েছে। শুধু অমুক কোম্পানির বই পড়ো আর তমুক কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে যাও। তাহলেই সাফল্য চলে আসবে হাতের মুঠোয়।

তাই আমার মনে হয়, তাই এই ধরনের বিজ্ঞাপন রোধেও প্রবল জনসচেতনতা গড়ে ওঠা উচিত। আর কেন্দ্রেরও উচিত ঐসব বিজ্ঞাপন আটকাতে কঠোর আইন প্রণয়ন করা। নাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিক্ষালাভ করতে এসেও বিজ্ঞাপনী মিথ্যাচারে প্রতারিত হতেই থাকবে। আর তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ার স্বপ্ন তলিয়ে যাবে বিজ্ঞাপনের চোরাবালিতে।  


……………………

                                                                                                                                                                                               

 

প্রবন্ধঃ তথ্যগুপ্তিবিদ্যা, মঙ্গলের দুই চাঁদ ও ইনটারনেটঃ গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

তথ্যগুপ্তিবিদ্যা, মঙ্গলের দুই চাঁদ ও ইনটারনেট


গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


 

SMAISMRMILMEPOETALEUMIBUNENUGTTAUIRAS

উপরের শব্দটা পড়ে ঘাবড়ে গেলেন তো! এটা ছিল এক চিঠিতে, এটা বুঝতে গেলে লাতিন জানা দরকার। অবশ্য শুধু লাতিন জানলেই হবে না। পত্রপ্রাপক ভাষাটা ভালোই জানতেন, কিন্তু তিনিও প্রথমে বুঝে উঠতে পারেননি, কারণ লাতিন ভাষায় এরকম কোনও কথা নেই। যখন বুঝলেন এই অক্ষরগুলোর মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের কথা লুকিয়ে আছে, তখন তিনি তার অর্থ উদ্ধারের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমরা সেই কাহিনিতে ফিরব, কিন্তু তার আগে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যুগে যুগে কেমনভাবে লুকিয়ে রাখা হত, সেদিকে একটু চোখ রাখি।

এক্ষেত্রে না হলেও অনেক সময়েই সমস্যাটা শুধু তথ্য লুকিয়ে রাখা নয়, তা উদ্ধার করারও বটে। আমরা অনেকেই ইনটারনেটের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করি। এটা নিশ্চিত হওয়া দরকার যে মাঝপথে কেউ আমার অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড ইত্যাদি জেনে যাবে না, অথচ ব্যাঙ্কের কম্পিউটার সহজেই তা পড়তে পারবে। এ জন্য আমার পাঠানো সমস্ত তথ্যকে এনক্রিপ্ট অর্থাৎ সংকেতবদ্ধ করে পাঠাতে হয়। একই রকম প্রয়োজন হয় যুদ্ধক্ষেত্রে। ধরা যাক রেডিওর মাধ্যমে কোনও সৈন্যদলের কাছে বার্তা পাঠানো হচ্ছে, স্বাভাবিক ভাবেই বিপক্ষও সেই বার্তা শুনতে পাচ্ছে। তাই আসল খবরটাকে এমনভাবে সংকেতবদ্ধ করে পাঠাতে হবে যে কোড ভাঙার চাবিকাঠি ছাড়া কেউ যেন তার মর্মোদ্ধার করতে না পারে। এই বিষয়কে বলে ক্রিপ্টোলজি বা তথ্যগুপ্তিবিদ্যা।

গোয়েন্দা গল্পে এরকম অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। উদাহরণ স্বরূপ বইয়ের মাধ্যমে সংকেতবদ্ধ করার কথা ভাবা যায়। বার্তাটির শব্দগুলিকে কোনও বইয়ের থেকে বেছে নেওয়া হল, তারপর লিখে দেওয়া হল যে বইয়ের কোন পাতার কোন শব্দ পড়তে হবে। এখানে ওই বিশেষ বইটিই হল চাবিকাঠি; কোন বই না জানা থাকলে সংকেতের অর্থ উদ্ধার শক্ত। দি ভ্যালি অফ ফিয়ার উপন্যাসে শার্লক হোমস কোন বই ব্যবহার করা হয়েছে সে কথা অনুমান করে সহজেই বার্তাটা বুঝতে পেরেছিলেন।

তথ্যগুপ্তিবিদ্যার ইতিহাস বহু প্রাচীন। মিশরের চার হাজার বছরের পুরোনো সমাধির দেয়ালে ক্রিপ্টোগ্রাফির নমুনা পাওয়া গেছে, যদিও তার কারণটা ঠিক পরিষ্কার নয়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে গুপ্তচরদের কাছে সংকেতের মাধ্যমে বার্তা পাঠানোর কথা আছে। তারও আগে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে প্রাচীন গ্রিসে স্পার্টার অধিবাসীরা তাদের সৈন্যদলের কাছে যে পদ্ধতিতে বার্তা পাঠাত তার নাম ছিল Scytale। একটা ফিতে একটা কাঠের বেটনের পাশে জড়ানো হল, এবার ওই জড়ানো ফিতের উপর পাশাপাশি লিখে গেলাম। ফিতেটা খুলে নিলে অক্ষরগুলো আর পাশাপাশি থাকবে না, তখন বার্তাটা পড়া শক্ত। বার্তাপ্রাপকের কাছে একটা একই মাপের বেটন থাকবে, সে আবার ফিতেটা জড়িয়ে নিলো। নিচের ছবিটা থেকে বিষয়টা পরিষ্কার হবে।




এই কোড ভাঙা একেবারেই সহজ, কারণ ফিতের উপর অক্ষরগুলো পরপর না হলেও নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর থাকবে। সেইটা আন্দাজ করতে পারলেই বার্তা উদ্ধার করতে সময় লাগবে না। নিচে দেয়া বর্ণগুলো বিশ্লেষণ করে সহজেই দেখা যাবে নিচের সংকেত বাক্যটার মাধ্যমে কী বোঝানো হল। (`-' চিহ্ন দিয়ে শূন্যস্থান বোঝানো হয়েছে।)

নিসক্যমাকীনোচেঙ্কেটাধ্য--রতরমেবোহ-বা--ঝাল

স্পার্টানদের শত্রুরা অবশ্য অত চিন্তা করত না, ফিতেটা হাতে পেলে বিভিন্ন সাইজের বেটন নিয়ে দেখত কোনটা দিয়ে বার্তাটা পড়া যাচ্ছে।

ইতিহাসে এর পরে যে সংকেতের কথা বিখ্যাত হয়ে আছে, শোনা যায় সেটার আবিষ্কারক হলেন জুলিয়াস সিজার। এটা আরও সোজা, বর্ণমালার অক্ষরগুলোকে তিন ঘর সরিয়ে লিখতে হত, অর্থাৎ A-র জায়গায় D, B-এর জায়গায় E, এই রকম। জুলিয়াসের পরে যিনি রোমের শাসনভার নিয়েছিলেন, সেই অগাস্টাস সংকেতটাকে আরও সোজা করেছিলেন, মাত্র এক ঘর সরিয়ে লিখতে হত। এগুলোর পাঠোদ্ধারও খুবই সহজ।  

উপরের গ্রিক ও রোমান উদাহরণগুলোর মধ্যে একটা মিল আছে। স্পার্টানদের সংকেতে অক্ষরগুলো নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর থাকে, সিজারের কোডে বর্ণগুলোকে বর্ণমালার মধ্যে নির্দিষ্ট দূরত্ব সরানো হয়। সিজারের কোডকে আরও শক্ত করা যায়, যদি কোন বর্ণের জায়গায় কোন বর্ণ লিখেছি তা উলটে-পালটে বসানো হয়। যেমন ধরুন A-র জায়গায় D, কিন্তু B-এর জায়গায় X, আবার C–এর জায়গায় P, এইরকম। সিজারের কোড বা এই ধরনের সংকেত, যেখানে এক বর্ণের জায়গায় আর এক বর্ণ বসানো হয়, তাকে বলে প্রতিস্থাপন সংকেত। প্রাপকের কাছে চাবিকাঠিটা থাকবে, সে তার সাহায্যে সহজেই আসল বার্তাটা উদ্ধার করতে নিতে পারবে।

চাবিকাঠি না থাকলেও এই সংকেতের মর্ম উদ্ধার করা সম্ভব, সেই কথা  আছে এডগার অ্যালান পো-এর ছোট গল্প দি গোল্ড বাগ-এ। প্রথমে কোনও অক্ষর বা অক্ষর সমষ্টি কতবার আসছে দেখতে হবে। যেমন ইংরাজিতে সবথেকে বেশি ব্যবহৃত অক্ষর হল E, তারপরেই A। কাজেই বার্তাটির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে এই দুটি অক্ষরের জন্য কোন চিহ্ন ব্যবহার হয়েছে তা সহজেই বোঝা সম্ভব। এবার যদি দেখা যায় যে তিনটি বর্ণের সমষ্টি বারবার আসছে, এবং তার শেষটা হল E, তাহলে অনুমান করা যায় ওই শব্দটি হল THE; অর্থাৎ T ও H বর্ণগুলিকেও উদ্ধার করা গেল। অবশ্য এভাবে এগোনোর জন্য বার্তাটি যথেষ্ট বড় হতে হবে, যাতে পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ কাজ করে। খুব ছোট বার্তার জন্য অক্ষরের পরিসংখ্যান না মিলতেই পারে। সংকেত উদ্ধারের এই পদ্ধতি উদ্ভাবন হয়েছিল অষ্টম শতাব্দীতে, আরব গণিতবিদ আল-কিন্দি এর স্রষ্টা। মনে রাখতে হবে পরিসংখ্যানবিদ্যার জন্ম কিন্তু তার অনেক পরে।

আমাদের বাংলা বর্ণমালার ক্ষেত্রেও এইরকম প্রতিস্থাপন কোড তৈরি করা যায়, তবে আ-কার ই-কার যুক্তাক্ষর ইত্যাদি থাকার জন্য সেটা এই সমস্ত কোডের থেকে আরও দীর্ঘ হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অবশ্যই উপরের সমস্ত উদাহরণের থেকে অনেক বেশি জটিল কোড ব্যবহার করা হত। তারও উপরে মার্কিন সৈন্যবাহিনীর রেড ইন্ডিয়ান সদস্যরা বার্তাকে সংকেতবদ্ধ করার সময় তাদের নিজেদের ভাষা ব্যবহার করত। সেই ভাষা জানা না থাকলে কোড ভাঙা দুঃসাধ্য, কারণ ইংরাজি ভাষার অক্ষরের পরিসংখ্যান অন্য ভাষার সঙ্গে মিলবে না। নাজেভো ইন্ডিয়ানদের তৈরি করা কোড জাপানিরা কখনোই ভাঙতে পারেনি, ফলে মার্কিন সৈন্যবাহিনীর সংকেত উদ্ধার করা তাদের পক্ষে হয় নি।

আধুনিক যুগের জটিল সংকেতের কথাও আমাদের গল্পে আসবে, তার আগে এই লেখা যেখানে শুরু করেছিলাম সেখানে ফিরে যাই। আজকের দিনে কোনও বিজ্ঞানী নতুন কিছু আবিষ্কার করলে তা গবেষণা পত্রিকা বা জার্নালে ছাপান, কেউ কেউ হয়তো খবরের কাগজ টেলিভিশন বা ইনটারনেটের মাধ্যমেও সেটা প্রকাশ করেন। মধ্যযুগে এরকম কোনও সুযোগ ছিল না, বই ছাপাতে হত, কিন্তু তা ছিল অত্যন্ত খরচসাপেক্ষ। অন্য বিজ্ঞানীদের চিঠি লিখে জানানো যেত, অনেকেই সেই পথ নিতেন।

অনেক সময় কিন্তু বিভিন্ন কারণে বিজ্ঞানী হয়তো তখনি তাঁর আবিষ্কারের কথা প্রচার করতে চাইতেন না, তিনি তার আগে নিশ্চিত হতে চাইতেন বা সে বিষয়টাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইতেন। কিন্তু ইতিমধ্যে যদি অন্য কেউ সেই আবিষ্কার করে ফেলে! সেজন্য চিঠিতে আবিষ্কারের কথা সংকেতের মাধ্যমে পাঠাতেন, পরে ঘোষণা করার সময় সেই সংকেতটা সবাইকে বুঝিয়ে দিতেন। মাঝে অন্য কেউ আবিষ্কারের ঘোষণা করলে বিজ্ঞানী তখনই সংকেতটা ভেঙে দেখাবেন যে তিনি আগেই কাজটা করেছেন।

সপ্তদশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানীদের মধ্যে যে পদ্ধতি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল তা হল অক্ষরগুলোকে উলটে-পালটে লেখা, অর্থাৎ অ্যানাগ্রাম। উদাহরণ স্বরূপ আমরা হুকের সূত্রের কথা জানি, তাতে বলা হয় স্থিতিস্থাপকতার ক্ষেত্রে বল বা পীড়ন (লাতিনে vis) বিকৃতি (লাতিনে tensio)-র সমানানুপাতী। রবার্ট হুক লাতিন ভাষায় এই সূত্রকে লিখলেন, Ut tensio sic vis, তারপর বাক্যটাকে বর্ণানুক্রমিক ভাবে সাজালেন, হল ceiiinosssttuv। এটা তিনি পরিচিতদের সবাইকে পাঠালেন। কয়েক বছর পরে তার মানে সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন, ইতিমধ্যে আরও পরীক্ষানিরীক্ষা করে তিনি তাঁর সূত্র সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছিলেন। 

আধুনিক বিজ্ঞানের স্রষ্টা বললে অনেকের মনেই গ্যালিলিও গ্যালিলির কথা আসে। গ্যালিলিও ১৬০৯ সালে দূরবীন দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন বৃহস্পতির চারটি চাঁদ আছে, তার থেকে তিনি সৌরজগতের কেন্দ্রে আছে সূর্য এবং পৃথিবী তার চারদিকে ঘোরে সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছিলেন। এই নিয়ে রোমান ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে তাঁর বিরোধের ইতিহাস সকলেরই জানা, আমরা সেই প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। তিনি দূরবীন দিয়ে আকাশে আরও অনেক কিছু পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, কিন্তু একটা বিষয় তিনি ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেননি। সেই জন্য সেই সময় তিনি তা প্রকাশ করেন নি। কিন্তু তাঁর অনুসরণে অনেকেই তখন দূরবীন দিয়ে আকাশ দেখছেন, অন্য কেউ তাঁর আগে বিষয়টা দেখেছেন বলে ঘোষণা করে দিতে পারেন। সুতরাং তিনি যা দেখছিলেন, তাকে লাতিন ভাষায় লিখলেন এবং অ্যানাগ্রাম আকারে অনেকের কাছে চিঠিতে লিখে পাঠালেন। সেটা ছিল ১৬১০ সাল। সেই অ্যানাগ্রামই হল SMAISMRMILMEPOETALEUMIBUNENUGTTAUIRA যা দিয়ে এই লেখা শুরু হয়েছে।

প্রাপকদের মধ্যে ছিলেন সেযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ জোহানেস কেপলার। কেপলার ঠিক করলেন যে তিনি গ্যালিলিও কী লিখেছেন তা বার করবেন। ওই বর্ণ সমষ্টি থেকে অনেক রকম বাক্যই গঠন করা যায়। নানা রকম ভাবে সাজিয়ে কেপলার যে বাক্যটা ঠিক বলে সিদ্ধান্ত করলেন, তা হল Salve, umbistineum geminatum Martia proles। লাতিন গ্রামার খুব মেনে চলেনি কথাটা। সে যা হোক, বাংলায় এর মানে দাঁড়ায় মঙ্গল গ্রহের দুই সন্তানকে স্বাগত। কেপলারের মনে হল গ্যালিলিও মঙ্গল গ্রহের দুটি উপগ্রহ আবিষ্কার করেছেন।

মঙ্গলের সত্যিই দুটি উপগ্রহ, ডিমোস আর ফোবোস। তাহলে কি গ্যালিলিও সেগুলো দেখতে পেয়েছিলেন? উত্তর হল না; সে চাঁদ দুটো এতই ছোট যে গ্যালিলিওর দূরবীনে তাদের দেখতে পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ১৮৭৭ সালে তাদের প্রথম সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। গ্যালিলিও আসলে লিখেছিলেন, altissimum planetam tergeminum observavi, এর মানে হল দূরতম গ্রহ (অর্থাৎ শনি) তিনভাগে বিভক্ত। গ্যালিলিও শনির বলয় দেখতে পেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর দূরবীনের শক্তি কম থাকার ফলে কী দেখছেন বুঝতে পারেন নি, তাঁর মনে হয়েছিল শনির দুপাশে ঢিপির মতো কিছু বেরিয়ে আছে। গ্যালিলিও কোনওদিনই শনির বলয়ের কথা জানতে পারেন নি।

কেপলার যে ঐ অ্যানাগ্রাম থেকে মঙ্গলের দুটি চাঁদের কথা ভেবেছিলেন তার কারণ আছে। বৃহস্পতির চাঁদের সংখ্যা চারের অনেক বেশি, কিন্তু সে সময় তা জানা ছিল না। আজ যাকে আমরা প্যাটার্ন রিকগনিশন বলি, কেপলারের সেই ক্ষমতা ছিল অসাধারণ, সে কারণেই তিনি তাঁর গ্রহদের গতিবিধি সংক্রান্ত সূত্র আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। কিন্তু অনেক সময়েই প্যাটার্ন না থাকলেও আমাদের মন সেখানে প্যাটার্ন তৈরি করে নেয়। বুধ বা শুক্রের উপগ্রহ নেই, পৃথিবীর একটা, বৃহস্পতির চারটে, অতএব কেপলারের মনে হল মঙ্গলের দুটো উপগ্রহ থাকবে।

কেপলারের কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের মিলটা নেহাতই সমাপতন, উপগ্রহের সংখ্যা গুণোত্তর প্রগতিতে বাড়ার কোনও কারণ নেই। কেপলারের সমর্থনে বলা যায় যে তখন জ্যোতির্বিদ্যার শৈশব, তাই কোনটা ঠিক কোনটা ভুল বোঝা সহজ ছিল না। জোনাথন সুইফটের গল্পে লাপুটাদের দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গালিভারকে মঙ্গলের দুটি চাঁদের কথাই বলেছিল। সেই গল্প লেখা হয়েছিল ১৭২৬ সালে, আর আমরা আগেই দেখেছি তার দেড়শো বছর পরে চাঁদ দুটি আবিষ্কার হয়েছিল। এক সময় এমন কথাও উঠেছিল যে সুইফটের সঙ্গে মঙ্গলগ্রহের অধিবাসীদের যোগাযোগ ছিল, না হলে তিনি সেই দুই চাঁদের খবর পেলেন কেমন করে। আসল কারণ হল গ্যালিলিওর সেই অ্যানাগ্রাম এবং কেপলারের কল্পনা -- সুইফট কেপলারের লেখার খবর জানতেন।

দেখা যাচ্ছে সংকেত শুধুমাত্র লেখাই যথেষ্ট নয়, তাকে উদ্ধার করার জন্য চাবিকাঠিটাও জরুরি। অথচ সেই চাবিকাঠি অনাকাঙ্ক্ষিত হাতে চলে গেলে বিপদ আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সরকার মেক্সিকোর জার্মান রাষ্ট্রদূতকে সাংকেতিক টেলিগ্রাম করে মেক্সিকোকে তাদের পক্ষে যুদ্ধে যোগদানের জন্য অনু্রোধ জানাতে বলেছিল। ব্রিটিশ পক্ষ সেই বার্তা উদ্ধার করতে সক্ষম হয় এবং মেক্সিকোর ঠিক উত্তরের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দেয়। মার্কিন পক্ষ তার অল্পদিন পরেই জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান করে, তার পিছনে এই বার্তাটির বিশেষ ভূমিকা ছিল। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের জয়ের পিছনেও এই কোড ভাঙার এক ভূমিকা আছে। যদি প্রতিস্থাপন কোডটা বার্তার মধ্যে পালটাতে থাকে, অর্থাৎ প্রথম কিছুটাতে A-র জায়গায় লিখলাম B, তারপর কিছুক্ষণ লিখলাম G, তাহলে পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ কাজ করবে না। জার্মানরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করত, তারা এ জন্য যে মেশিন ব্যবহার করত তার নাম ছিল এনিগ্মা (Enigma) অর্থাৎ হেঁয়ালি। সেই যন্ত্র নিয়ে আলোচনার সুযোগ এই লেখাতে নেই, কিন্তু মিত্রপক্ষ এনিগ্মার কোড ভাঙতে সক্ষম হয়েছিল। ঐতিহাসিকরা অনেকেই মনে করেন যে মিত্রপক্ষের জয় তার ফলে ত্বরান্বিত হয়েছিল। কম্পিউটার বিজ্ঞানের জনক মনে করা হয় অ্যালান টুরিঙকে, তিনি এই কোড ভাঙাতে এক বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন।

তাহলে কি যে কোনও কোডই ভাঙা সম্ভব? ইনটারনেটের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন কি তাহলে নিরাপদ নয়? বার্তাপ্রেরক ও প্রাপকের মাঝখানে কেউ যাতে আড়ি পেতে তথ্য চুরি করতে না পারে তার জন্য ইনটারনেটে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আপনি যখন কোনও ওয়েবসাইটে ঢোকেন, একটু খেয়াল করলে দেখবেন অধিকাংশ সময় সাইটের নামের বাঁদিকে একটা তালার চিহ্ন আছে, ওই চিহ্ন থাকা মানে ওয়েবসাইটটি নিরাপদ। (নিচের ছবিটা দেখুন, তালার চিহ্নকে গোল করে দেখানো আছে।) ওয়েবসাইটে ওই চিহ্নের উপরে ক্লিক করলে দেখতে পাবেন আপনার পাঠানো ক্রেডিট কার্ডের নাম্বার, পাসওয়ার্ড ইত্যাদি তথ্য মাঝে অন্য কেউ জেনে নিতে পারবে না।



এই নিরাপত্তার জন্য একটি খুব পরিচিত পদ্ধতির কথা বলি। এই উদ্ভাবন করেছিলেন রোনাল্ড রিভেস্ট, আদি শামির ও লিওনার্ড অ্যাডলম্যান নামের তিন বিজ্ঞানী, তাঁদের পদবী অনুসারে একে বলে আরএসএ(RSA) অ্যালগরিদম্। গণিতের এমন এক শাখা এখানে ব্যবহার করা হয় কয়েক দশক আগেও যার কোনও ব্যবহারিক প্রয়োগের কথা কেউ কল্পনা করতে পারতেন না। আমরা জানি যে পূর্ণ সংখ্যাকে ১ ও সেই সংখ্যা ছাড়া অপর যে কোনও পূর্ণসংখ্যা দিয়ে ভাগ দিলে ভাগশেষ থাকে তাকে বলে মৌলিক সংখ্যা। যেমন ২, ৩, ৫, ৭, ১১, ১৩ এরা সবাই মৌলিক সংখ্যা। কেমনভাবে আরএসএ অ্যালগরিদম্ কাজ করে তা সহজে লিখতে গেলেও আরও একটা প্রবন্ধ লাগবে, কিন্তু মূল কথাটা হল এখানে দুটি বড় মৌলিক সংখ্যার গুণফলকে ব্যবহার করা হয়। ধরা যাক গুণটা করতে আমার ডেস্কটপ কম্পিউটারের লাগে এক সেকেন্ড, কিন্তু একটা সংখ্যাও জানা না থাকলে আমাদের আধুনিকতম কম্পিউটার লক্ষ লক্ষ কোটি বছরেও ওই বড় গুণফলটাকে উৎপাদকে বিশ্লেষণ করতে পারবে না। বার্তাকে সংকেতবদ্ধ করতে ওই মৌলিক উৎপাদক দুটিকে ব্যবহার করা হয়, ইনটারনেটের মাধ্যমে যায় ওই গুণফলটি। কেউ যদি গুণফল জানতেও পারে, তার পক্ষে উৎপাদক দুটি নির্ণয় করা কার্যত অসম্ভব। মনে পড়ে এই পদ্ধতির কথা প্রথম পড়েছিলাম আর্থার সি ক্লার্কের লেখা টু থাউজ্যান্ড টেনঃ ওডিসি টু বইতে।

ইনটারনেটের মাধ্যমে তথ্য তাহলে সম্পূর্ণ নিরাপদ? এখনও পর্যন্ত এই প্রশ্নের উত্তর হল হ্যাঁ; সাধারণ কম্পিউটার কোনওদিনই ওই সংকেত ভাঙতে পারবে না। কিন্তু সংবাদে মাঝে মাঝে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কথা শোনা যায়। কোয়ান্টাম কম্পিউটার সৃষ্টি এখনও পর্যন্ত খুব বেশি এগোয়নি, কিন্তু তত্ত্ব বলছে যে ঐ ধরনের বড় সংখ্যাকে উৎপাদকে বিশ্লেষণ করতে তার সময় লাগবে কয়েক সেকেন্ড বা তারও কম। একবার কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি হলে তথ্যগুপ্তির নতুন কায়দা ভাবতে হবে। সে বিষয়েও কাজ শুরু হয়েছে; কোয়ান্টাম জগতের বিচিত্র ধর্মকেই কাজে লাগিয়ে এমন পদ্ধতির প্রস্তাব করা হয়েছে যেখানে জানা যাবে মাঝপথে কেউ আড়ি পাতছে কিনা। তথ্যগুপ্তিবিদ্যাতে কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রয়োগ আমাদের আলোচনার পরিধির বাইরে, কিন্তু স্পার্টানদের কাঠের বেটনের যুগ থেকে আমরা অনেকটা এগিয়েছি সন্দেহ নেই।


………………..