প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র

 


প্রচ্ছদঃ অভিজিৎ সেনগুপ্ত
প্রচ্ছদ অলঙ্করণঃ সুলেমান দারানি


সূচিপত্র

সম্পাদকীয়

কর্মাধ্যক্ষের নিবেদন

গল্প

চখাচখি দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

অভিনেত্রী অদিতি সরকার

সুন্দরের কাছে সুমন মহান্তি

দুর্গা সুদীপ চ্যাটার্জী

মেডেল বিভাবসু দে

ফেসবুকের ভূত অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

নিশিডাক সায়ন্তন ঠাকুর

দেবদূত রুমেলা দাস

বিচার দেবব্রত দাশ

রাজবাড়ির দুর্গোৎসব প্রদীপ কুমার বিশ্বাস

কো মাইয়া পল্লবী গুহ সাহা

উপহার শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

রুপাই এবং দোলা সেন

ফার্স্ট প্রাইজ বাসু মুখোপাধ্যায়

লকডাউন ও একটি আষাঢ়ে প্রেমকাহিনি অত্রি গোলুই

না পাঠানো চিঠিরা অদিতি ঘোষ রায়

রোদ্দুরকে লেখা চিঠি শ্রীজা গুপ্ত

অনুবাদ গল্প

বাগানে রূপকথার একশিঙ্গা ঘোড়া ভাস্বরজ্যোতি ঘোষ

কবিতা

আর্তি শক্তিপ্রসাদ ঘোষ

ওজিম্যান্ডিয়াস (অনুবাদ) শওকত হাসান

ক্ষমতানায়কদের প্রতি সন্মাত্রানন্দ

তিরন্দাজ আসিফ আলতাফ

চিলেকোঠায় অনির্বাণ ঘোষ

নারী ও নাড়ি স্বপঞ্জয় চৌধুরী

প্রিয়দর্শিনীর শহরে সাবিনা পারভীন লীনা

বিরহবাস রোনক ব্যানার্জী

মনাস্ত্র পিডি বিজয়

দূরত্ব সুমন ব্যানার্জী

সত্যকাম তোমারই সন্তান দুখু বাঙাল

সহমরণের প্রশান্তি শিপ্রা রহমান

অণুগল্প কারণ দাস

জাতিস্মর শম্ভু সরকার

এই বর্ষাকালে শাহীন মোমতাজ

প্রেস নোট মামুন সুলতান

বন্ধু দিনে নির্মাল্য কুমার মুখোপাধ্যায়

চিতা তানিয়া চক্রবর্তী

জাদুঘর সার্থক রায়চৌধুরী

আগমনীর ঘণ্টা মায়া চক্রবর্তী

প্রবন্ধ

প্রদীপের খোঁজে আলাদিন অর্পণ গুপ্ত

জন্ম শতবর্ষে হেমন্ত... শ্রুতায়ু ভট্টাচার্য

কনৈয়ালাল মুনশির... জয়ন্ত ভট্টাচার্য

কোন পথে এগোচ্ছে... তারেক অণু

নবারুণের হারবার্ট... সৌভিক ঘোষাল

বিশ্ব ধরিত্রী... ইন্দ্রনীল মজুমদার

মুদ্রা জালিয়াতি... অর্পণ পাল

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পূর্ববঙ্গ... খালিদ আল হাসান

শ্মশান বোলান অভিজিৎ দাশগুপ্ত

হ্যাকিং সব্যসাচী মুস্তাফি

‘আদি’ সপ্তগ্রাম শ্রীদীপ তালুকদার চৌধুরী

মুক্তগদ্য

টাইফয়েড মেরীর গল্প জীবক

নাটক

পালা কুন্তলা রজত দাস

ভ্রমণ

রাথো গ্রামের খুনি ও... অরিন্দম আচার্য

জুলে সুগত চক্রবর্তী

ব্রহ্মতালের পথে দেবব্রত মুখার্জী

মোনালিসার বাড়ি সুগত বন্দ্যোপাধ্যায়

সাক্ষাৎকার

ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য


প্রধান সম্পাদিকা

পারমিতা মালী

সহ-সম্পাদকবৃন্দ

সৌকত আলি, জয়ন্ত ভট্টাচার্য, ভাস্কর ঘোষাল, প্রদীপ কুমার বিশ্বাস

প্রধান কর্মাধ্যক্ষ

রাহুল ভট্টাচার্য


নাটক ও কবিতার অলঙ্করণঃ স্মিতা দাস ও সায়ীনি দাস

সম্পাদকীয়


সম্পাদকীয়


 

পৃথিবীর বিপন্নতা বেড়েই চলেছে। আমাদের লোভ লালসার তো সীমা পরিসীমা নেই! ধর্মের নামে অধর্মের দুরাচার, সবল দুর্বলকে মারবে, দুর্বল আরও দুর্বলকে মারবে, এ তো চলেই আসছে! যে আমার ধর্মের নয়, যে আমার বিশ্বাসের নয়, আমার সহমতের নয়, সেই আমার শত্রু! তাকেই আমার মারার অধিকার! আমার থেকে অসহায় লোককে যদি আমি না মারি, তাহলে আমার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ হবে কি করে? প্রচুর ভুল আমরা ইতিমধ্যে করে ফেলেছি।

 

আমরা ভেবেই নিই যে, পৃথিবীটা শুধু আমাদেরই। তারপর একদিন আবিষ্কার করি, যে কিছুই আমাদের জন্য এক্সক্লুসিভ নয়। অন্যদের থেকে আমরা কিছুমাত্র আলাদা নই। গরু, ছাগল, ভেড়া, মোষ, হাতি, গন্ডার, সাপ, ব্যাঙ, পৃথিবীতে লক্ষ কোটি প্রাণীর যতটুকু অধিকার, আমাদের অধিকার তার থেকে এক কণাও বেশি নয়।এ কথাই বোধহয় ঈশ্বর এক পরমাণু সদৃশ জিনিসের আস্ফালন দিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দিলেন, যা নাকি কোন অনুজীবও নয়। সে এসেছে শমন নিয়ে। সারা বিশ্বে  ২৪ অগাস্ট পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ২,৩৬,৭৫,৭৭৬। মৃতের সংখ্যা ৮,১৪,০৩১। এই সংখ্যা প্রতিদিন হু হু করে বেড়েই চলেছে। মানুষ আপন আপন কোটরে বন্দি। স্বাভাবিক জীবনযাপনের ওপর পড়েছে নিষেধাজ্ঞার চাবুক। আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপন প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে আজ।এই বিপদ আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে যে, সবাই সবার পাশে দাঁড়াতে হবে, তা নইলে কেউ নিরাপদ নয়। প্রকৃতির সব প্রাণী-অপ্রাণী সবকিছুকে সাথী করে বাঁচা শিখতে হবে আমাদের। তবেই বাঁচবে পৃথিবী, বাঁচবে মানবসভ্যতা।

 

এই মহামারীর কালো ছায়ার মধ্যেই ঘরের দুয়ারে এসে গেল এবারের দুর্গোৎসব। সবকিছু এলোমেলো। কিন্তু কোনকিছুই থেমে থাকে না। এর মাঝেই বাঙালি তাদের জননীকে পরম ভক্তিভরে বন্দনা করবে, আহ্বান করবে সুখ, শান্তি, নিরাপত্তা ও রোগমুক্তি।

 

শারদীয় দুর্গোৎসবকে সামনে রেখে আমাদের ‘পঞ্চালিকা’ পরিবারের পক্ষ থেকে পাঠকের হাতে তুলে দিচ্ছি আমাদের প্রথম শারদসম্ভার। সাহিত্যের মজলিশে এটিই আমাদের প্রথম পদক্ষেপ। কিছু গল্প, কবিতা, ভ্রমণ, সাক্ষাৎকার ও কিছু ফোটোগ্রাফি দিয়ে সাজিয়েছি আমাদের ডালা।  আপনাদের সহযোগীতা ও অনুপ্রেরণা আমাদের আগামী পথ চলার পাথেয় হবে।

 

ওঁ সহনাববতু, সহ নৌ ভুনক্তু, সহ বীর্যং করবাবহৈ

তেজস্বী নাবধীতমস্তু, মা বিদ্বিষাবহৈ॥

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ 


পারমিতা মালী


কর্মাধ্যক্ষের নিবেদন

কর্মাধ্যক্ষের নিবেদন


কোভিড-১৯-এর অতিমারি এবং এর পরিণতিজনিত লকডাউনে সারা পৃথিবীর মনুষ্যকুল যখন ঘরবন্দী, কোটি কোটি মানুষ একঘেয়ে জীবনে হতশ্বাস, ঠিক সেই সময়ে বাঙালির জ্ঞানস্পৃহা আর অন্যতম বিনোদন বইপড়ার প্রতি লক্ষ্য রেখে একটা আন্তর্জাল পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। পত্রিকার নাম ঠিক হয় ‘পঞ্চালিকা’। পঞ্চালিকা নামে একটা ফেসবুক গ্রুপও খোলা হয়। এই গ্রুপে কয়েকজন বিশিষ্ট লেখক গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি লিখে চলেছেন। গ্রুপটি সকলের জন্য উন্মুক্ত। পত্রিকার সম্পাদনা, লেখা সংগ্রহ, প্রুফ দেখা, ইলাস্ট্রেশন প্রভৃতি কাজে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে এগিয়ে আসেন  কয়েকজন বিদগ্ধ ব্যক্তি, যাঁরা কেউ আমার বন্ধু, কেউ আমার নমস্য গুরুজন। আমাকেও এই কাজে প্রচুর সময় ব্যয় করতে হয়েছে। লেখা দিয়ে সাহায্য করেছেন সাম্প্রতিককালের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কবি, লেখক, গবেষক। আমরা নতুন লেখকদের কিছু লেখাও নিয়েছি তাদের উৎসাহিত করতে। সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। গল্প, কবিতা ও অন্যান্য বিভাগের পূর্ণাঙ্গ তালিকা ফেসবুক গ্রুপে প্রকাশ করা হয়েছিল। নানা সমস্যা পিছনে ফেলে দুই বাংলার লেখকদের গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, ভ্রমণ, আরও নানা বিষয়ের সম্ভার নিয়ে মহালয়ার পুণ্য তিথিতে প্রকাশিত হল আপনাদের সকলের জন্য নিবেদিত পঞ্চালিকা। এ সংখ্যাটি বিনামূল্যে দেওয়া হল। পত্রিকার লিঙ্ক আপনারা যথেচ্ছ শেয়ার করতে পারেন। আপনাদের কাছে অনুরোধ, আপনারা পত্রিকাটা পড়ুন ও পঞ্চালিকার ফেসবুক গ্রুপে আপনাদের মূল্যবান মতামত জানান। আপনাদের সমর্থন ও আশির্বাদ পেলে ভবিষ্যতেও এই প্রচেষ্টা আমাদের অব্যাহত থাকবে। 


রাহুল ভট্টাচার্য

প্রধান কর্মাধ্যক্ষ


গল্পঃ চখাচখি - দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য


চখাচখি


দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য



“তিয়াস, এই তিয়াস—”

বেশ খানিকক্ষণ ধরে ডাকাডাকিটা চলছিলই। তিয়াস বারকয়েক কানের ওপর বালিশ চাপা দিয়ে ডাকটা এড়াবার চেষ্টা করল। শেষমেষ না পারতে বালিশ থেকে মুখ তুলে চোখ পিটপিট করে রাগ রাগ গলায় বলে, “উঃ আর জ্বালিও না তো মা! কাল কত রাতে শুয়েছি জানো তো-”

বলতে বলতেই মায়ের মুখের দিকে চোখ পড়তে একটু সন্ত্রস্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

“তোর ঠাম্মাকে পাওয়া যাচ্ছে না রে।”

ধড়মড় করে উঠে বসল তিয়াস, “সে কী? কেক, পার্টি, সব সেলিব্রেশান রেডি আর বিয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর সকালে নায়িকা উধাও?”

“মজা করিস না তিয়াস,” মা’র গলায় উদ্বেগের ছোঁয়া, “একাএকা পথেঘাটে বুড়োমানুষ--”

“কেসটা বলো,” উঠে তাড়াতাড়ি শার্টটা গায়ে গলাতে গলাতে তিয়াস বলল।

“সকালবেলা সদরে তালা দিয়ে রেখে রায়কতপাড়ার কালীবাড়িতে ওঁদের নামে পুজো দিতে বেরিয়েছিলাম। খানিক আগে ফিরে প্রসাদ নিয়ে ওঁদের ঘরে গিয়ে দেখি মা বিছানায় নেই। খিড়কির দোরটা খোলা হা হা করছে।” 

“মর্নিং ওয়াকে বেরোয়নি তো?”

উঁহু। বিয়ে হয়ে এসে ইস্তক কোনদিন তো দেখিনি সকালে তোর দাদুকে চা না দিয়ে কোথাও গেছেন। বেছে বেছে শেষে আজকের দিনটাতেই এরকম করবেন নাকি?” 

“দাদু-”

“সে আর এক মুশকিল। একটু আগে জেগেছেন। চা নিয়ে যেতে বললেন, ‘বৌমা তুমি কেন? অণু কোথায়?’ তারপর সব শুনে চা টা না খেয়েই একেবারে বাসিমুখে বেরিয়ে চলে গেলেন খুঁজতে। একটা কথা শুনলেন না। সঙ্গে মোবাইল টোবাইলও কিছু নেই, চোখেও দেখেন না ভালো! আমি যে কী করি!”

“দাদুর সাথে কোন ঝগড়াটগড়া মনকষাকষি হয়নি তো?”

মা ঠোঁট ওলটালেন, “সে তো রোজকার ব্যাপার। খিটিরমিটির লেগেই আছে সকালবিকেল। কালকেও তোর দাদুর ওষুধ খেতে ভুলে যাওয়া নিয়ে খানিক বকাঝকা হল। কিন্ত ওতে করে-” 

 “হুম।তা-ও বটে। তা আমায় বা বাবাকে আগে ডাকলে না কেন?”

“তোর বাবা অনেকক্ষণ আগেই ঘুম থেকে উঠে খুঁজতে বেরিয়ে গেছে স্কুটার নিয়ে। আর তোকে আমি কতক্ষণ ধরে ডাকছি জানিস? আয় এখন। তাড়াতাড়ি কর--”  

তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এল তিয়াস। মনামী ডেকরেটার্সের গোপীনাথদা ঠোঁটে একটা বিড়ি ঝুলিয়ে প্যান্ডেলের তদারক করছিল উঠোনে। ওকে দোতলা থেকে নামতে দেখে বলে, “তিয়াসবাবা দেইখা যাও দাদুগোর লাইগ্যা কী জব্বর বেদি বানাইছি একখান! তুমার ছুটকাকার নকশার সঙ্গে মিলাইয়া লও। চুক পাইবা না কোন। শিলিগুড়ি থেইক্যা স্পেশাল সিংহাসন আনাইছি-” 

বেদিটা সত্যিই বেশ জমকালো হয়েছে। সিংহাসনটাও। এ সবই হচ্ছে ছোটকাকার প্ল্যান অনুযায়ী। ওর উৎসাহেই দাদু-ঠাকুমার বিয়ের সুবর্ণজয়ন্তীটা করা। সিয়াটলে বসে বসে গোটা অনুষ্ঠানটার প্ল্যান, নেমন্তন্নের লিস্ট থেকে শুরু করে কেক-এর ডিজাইন, রাতের লোক খাওয়াবার মেনু সবকিছু পাঠিয়ে চলেছে গত একমাস ধরে। আজ দুপুরের মধ্যে কাকিমাকে নিয়ে এসে পৌঁছোবার কথা ছোটকাকার। এতক্ষণে দিল্লি পৌঁছে গেছে প্রায়। নেমেই তো প্রথমে বাড়িতে ফোন করে ঠাম্মাকে চাইবে। বাড়ি জুড়ে প্যান্ডেল, একপাশে বেদির ওপরে ‘শুভ সুবর্ণজয়ন্তী’ লেখা বোর্ড, সব কেমন ফ্যাকাশে ঠেকছিল তিয়াসের। 

ফোনটা বেজে উঠল একবার। হাসপাতাল থেকে বাবার কল। ওখানে কিছু নেই। কাছাকাছি আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতেও যাননি। মন্দিরটন্দিরে খুঁজে লাভ নেই। ঠাম্মা আর দাদু দু’জনই ঘোর নাস্তিক। বাবা থানায় খবর দিতে যাচ্ছেন এখন। বললেন, “তুই সাইকেলে একটু বের হয়ে এদিক ওদিক দ্যাখ তো!”

।২।

বান্ধব নাট্য সমাজের একহারা গড়ণের দোতলা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা দুজন। বৃদ্ধের চোখে বহুকালের চেনা সেই হাসিটা তিরতির করছে। “সেই প্রথমবারের কথা মনে আছে অণু?”

“মনে নেই আবার? কী যে রাগ হয়েছিল তোমার ওপর! অত কষ্ট করে পার্ট মুখস্ত করলাম, আর স্টেজে উঠে তুমি কিনা কিউ গুলিয়ে বেমালুম পরের ডায়ালগে চলে গেলে! কথাগুলো বলবার সুযোগই পেলাম না আমি।”

“ভাগ্যিস করেছিলাম। শোয়ের পরে রণরঙ্গিনী হয়ে তেড়ে এলে, আর আলাপটাও অমনি হয়ে গেল।”

“সেই বুদ্ধি করেই অমনটা করেছিলে নাকি?”

হেমেন্দ্র হাসলেন একটু। জবাব দিলেন না। একটু রহস্য থাক না!  

বেলা বাড়ছে। অণুশীলা একটু চঞ্চল হচ্ছিলেন। হেমেন্দ্রর হাত ধরে মৃদু টান দিয়ে বললেন, “একসঙ্গে ঘুরে সুবর্ণজয়ন্তী সেলিব্রেশান হল তো? এবার চলো। দেরি কোরো না। বাড়িতে ওদিকে ওরা-”

“ড্যাম ইয়োর বাড়ি। সন্ধের পরে কেক কাটবে, মালা পরিয়ে চেয়ারে বসাবে। তখন গিয়ে সং সেজে বসলেই হবে’খন। এখন আমরা হাঁটব। শুধু আমরা দুজন।”

অণুশীলা মুখ লুকিয়ে হাসলেন একটু। দেখিয়ে হাসা যাবে না আবার। যা মেজাজি মানুষ! খারাপ লাগছে না অবশ্য। কতকাল পরে—সেই প্রথমদিকের বছরগুলোর মতন—

“কামরাঙা মাখা কিনবে?”

হেমেন্দ্র একটু থমকে দাঁড়ালেন। ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞাগুলো একদল বেয়নেট উঁচনো পুলিশের মত ভাসছে চোখের সামনে। বড়বউমা এসব ব্যাপারে বড় শক্ত শাসনে রাখে আজকাল। কামরাঙার নুন লংকা মেশানো টুকরোগুলো কেমন উলসে উলসে খেতো অণু। তিনিও দু একটা টুকরো তুলে নিতেন মাঝেমাঝে কাঠিতে করে। পকেট থেকে দশ টাকার একটা নোট বের করে দিলেন তিনি, “নিয়ে নাও—” 

*****

“আর একটা নেবে নাকি?”

কাঠিতে করে একখানা তারামাছের মত দেখতে নুনলংকায় জারানো টুকরো তুলে মুখে পুরলেন হেমেন্দ্র। গাল ব্যথা করে লালা বের হয়ে আসছে। 

“সরে এসো একটুখানি এদিকে,” অণুশীলা খাওয়া বন্ধ করে শক্ত করে তাঁর হাতটা ধরেছেন। বড় ভিড় রাস্তায়। আগে এত ভিড় ছিল না। শীতের দুপুরে কতদিন এই করলার সেতুর ওপর দিয়ে একাকি সম্রাট হয়ে হেঁটে গেছেন তিনি তাঁর রাজ্ঞিকে পাশে নিয়ে। সেসময় সবার সামনে হাত ধরবার চল ছিল না। ভালই হয়েছে সময় পাল্টে। 

করলার সেতুর গায়ে শ্বেতপাথরের স্মৃতিফলকটার সামনে গিয়ে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ালেন হেমেন্দ্র। “১৯৬৮র চৌঠা অক্টোবর রাতে যাঁরা তিস্তার বন্যায় হারিয়ে গেলেন, তাঁদের স্মরণে—”

সুধীন তখন পেটে। জল উঠেছিল কোমর ছাপিয়ে। আসন্নপ্রসবা অণুশীলাকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে নিয়ে দিকশূন্য জলজমির বুক পাড় খোঁজবার যাত্রা। মৃত্যুকে সেই একবারই মুখোমুখি দেখেছিলেন তাঁরা দুজন—

“মনে পড়ে অণু?”

অনুশীলা মাথা নাড়লেন। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছেন। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, “হীরণকে মনে আছে তোমার? ও না থাকলে সেদিন—”

বড় প্রিয় ছাত্র ছিল সে অণুশীলার। সেই দুর্যোগের রাত্রে প্রিয় শিক্ষিকার সামনে সামনে সে-ও হেঁটেছিল রাক্ষসী তিস্তার জল ভেঙে, পায়ের স্পর্শে নিরাপদ পথ খুঁজে খুঁজে। তিস্তা তাকে সে রাত্রে ক্ষমা করেনি—


*****

“এসো, ভেতরে গিয়ে বসি।”

যাযাবর রেস্তোরাঁর ছোট্ট একচালা বাড়ি। হেমেন্দ্রর পিছু পিছু ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে অণুশীলা ঠোঁট কামড়ালেন। বাড়িতে তোলপাড় হচ্ছে নিশ্চয় এতক্ষণে। কী যে ভূত চেপেছে আজ এঁর মাথায়! কিন্তু তার পরেই একটা আশ্চর্য বেপরোয়া আনন্দের অনুভুতি ছড়িয়ে গেল তাঁর শরীরেও। একটা প্রায় ভুলে যাওয়া শিরশিরে অনুভুতি ঝংকার তুলছিল তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে।

স্টিলের থালায় একূল অকূল ছাপানো একটি চিতল মাছের পেটি—সুগন্ধী চালের ভাত—ম্যানেজারের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে যাযাবর মানুষটি তাঁদের সঙ্গে বসেছেন। বত্রিশ বছরের বন্ধুত্ব। তখন তাঁদের মধ্যযৌবন। স্কুলের টিফিন টাইমে সময় চুরি করে নিয়ে কতদিন দুজনে মিলে নতুন খোলা সেই দোকানের সুগন্ধী খাদ্যের স্বাদ নিয়েছেন—

পেটিটাকে দু’টুকরো করে বড়ভাগটা হেমেন্দ্রর পাতে তুলে দিলেন অনুশীলা।

হেমেন্দ্র হাসছিলেন, “গোটা একখানা করে পেটি আর কোনদিন আমাদের খাওয়া হল না অণু। আগে সামর্থ্য ছিল না, আর এখন—” 

“দাঁড়ান বৌদি। আজ ভাগযোগ চলবে না। বিয়ের পঞ্চাশ বছর বলে কথা। আজ আমার অ্যাকাউন্টেই দুজন একটা করে গোটা—” 

বৃদ্ধ মানুষটির হাত ছুঁয়ে হেমেন্দ্র নিরস্ত করলেন, “ছেড়ে দেন দাদা। শরীরে সইবে না এখন আর। চিরটাকাল ভাগযোগ করেই তো খেয়ে এলাম দুজনে। আমাদের কপালে ও ছাড়া আর কিছু লেখাই নেই--”


*****


“হাতটা ধর-”

“উঁহু, পারব।” 

পাড়ের উঁচু বাঁধ থেকে নেমে বালির চরের মধ্যে ইতিউতি জল বয়ে যায়। শীতের দুপুরে গা এলিয়ে ঘুমিয়ে আছে তিস্তা। 

“পারবে জানি। তাও-হাতটা ধর অণু। ফর ওল্ড টাইমস সেক-” হেমেন্দ্র হাতটা বাড়িয়েই রয়েছেন একটু নীচু থেকে।

“তোমার আজ কী হয়েছে বল দেখি? কে কখন দেখে ফেলবে কোত্থেকে-” বলতে বলতেই স্বামীর হাতটা ধরে জলের বুকে এলেন অণুশীলা। এখানে হাঁটুজল। হেমেন্দ্রর কবোষ্ণ হাত। বেশ কিছু স্মৃতি ঘিরে আসে। সেই প্রথমদিকের দিনগুলো—কত অলস শীতের দুপুর কেটে গেছে এই তিস্তার জলে-খোলা আকাশের নীচে-”

“অণু-একবার সেই আগের মত-”

     তাঁর চোখের কোণে পাখির পায়ের ছাপ। তাঁর রুপোলী চুলে রুপোলি রোদ্দুর। চোখের জানালায় সেই পুরোনো দুষ্টুমির ঝিকিমিকি একবার খেলে গিয়েই ফের পর্দা নেমে এল, “তৈরি হয়ে আসিনি যে! বাড়িভর্তি লোকজনের সামনে ভেজা কাপড়ে ফেরা—তাছাড়া শীতের অবেলায় স্নান করে শেষে একটা অঘটন ঘটুক আরকি! ”

“বুড়ো হয়ে গেলাম তাহলে?”

“নয়ত কী? শোনো, অবুঝপনা না করে, চলো উঠি। একটুক্ষণ পাড়ে বসে থেকে তারপর বাড়ি যাই।”

বেলা তিনটে বাজে প্রায়। রোদ ঢলছিল। ধূ ধূ তিস্তার রুপোলি বালিভরা বুকে একফালি নীল টুকটুকে জল। তার পাশে দু’জন বৃদ্ধবৃদ্ধা । তাঁদের পা গুলি তিস্তার জল স্পর্শ করে আছে। চোখ সামনের দিগন্তে স্থির। 


“ভারী ফাঁকি দিয়েছি ওদের আজ। কী দারুণ প্ল্যানটা করেছিলাম বল তো?”

“সে করেছ। পারোও বটে তুমি। তা, শখ তো মিটল। এবারে উঠবে কী? রোদ ঢলছে যে! সুশীলও বোধ হয় বাগডোগরা থেকে বাড়িতে পৌঁছে গেছে। কী যে হচ্ছে ওদিকে এতক্ষণে--”

“উঁহু। আমাদের প্রোগ্রাম এখনো শেষ হয়নি।”

বালিতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াচ্ছিলেন অণুশীলা। কোমরে পুরনো ব্যথাটা একটু একটু জানান দিচ্ছে এতক্ষণে। 

“ঢের হয়েছে। ভিমরতি ধরা বুড়ো, তুমি একা একা বসে তোমার প্রোগ্রাম পুরো কর তাহলে। আমি চললাম।”

সামনে ছড়িয়ে থাকা দিগন্তবিস্তৃত নীল আকাশের গায়ে চোখ রেখে অনেকক্ষণ ধরেই কী একটা যেন খুঁজছিলেন হেমেন্দ্র। উঠে দাঁড়াতে উদ্যত বৃদ্ধার হাতটি ধরে তাঁকে পাশে টেনে নিলেন তিনি, “আর বেশিক্ষণ নেব না অণু। এইখানে আজ আমাদের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে যে! আর জাস্ট একটুক্ষণ প্লিজ।” 

“কে আসবে এখানে এই ভরা দুপুরে? কী বলছো তুমি ক্ষ্যাপার মত বল তো?”

হেমেন্দ্র আকাশ থেকে চোখ না সরিয়েই হাসলেন এক চিলতে, “একটু অপেক্ষা করো। দেখলেই ঠিক চিনতে পেরে যাবে তুমি। সময় হয়ে এল। আমি জানি ওরা আজ আসবেই--”

বলতে বলতেই তাঁর মুখটি উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, “ওই যে। দেখো দেখো— কিপ স্টিল অণু। একদম নড়বে না। ওরা নীরবতা ভালোবাসে--”  

রোদমাখা নীল আকাশের বুকে তখন দেখা দিয়েছে একজোড়া চখাচখি। মাথার ওপর চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে একসময় তাঁদের খানিক দূরে তারা বালির ওপর নেমে এল। পক্ষিণীটিকে ঘিরে পাখিটি লেজ নাচিয়ে ঘোরে। মেটিং ডান্স। 

“এইবারে মনে পড়েছে অণু? পঞ্চাশ বছর আগে, আজকের দিনটার কথা? রেজিস্ট্রির ঠিক আগে এইখানটায় বসে আমার হাত ধরে ওইরকম একটা চখাচখির জুড়িকে সাক্ষি রেখে কী বলেছিলে?”


অণুশীলার চোখে স্নিগ্ধ বিদ্যুৎ খেলছিল। ঘাড় নেড়ে, জরাকুঞ্চিত দুটি হাতে বৃদ্ধের হাতদুটি ধরে তিনি ফিসফিস করে বললেন, “ভালোবাসি--”

স্তব্ধ চরাচরে নতুন করে বলে ওঠা সেই কথাগুলো কেউ শুনল না। সাক্ষি রইল শুধু তিস্তার চর আর সেই চিরকালের পক্ষিদম্পতি।


অলঙ্করণঃ ডাঃ সায়ন্ন্যা দাশদত্ত



লেখক পরিচিতি



জন্ম ও বড়ো হয়ে ওঠা নৈহাটিতে। শিশুদের জন্য প্রথম পূর্ণাঙ্গ ওয়েব ম্যাগাজিন ‘জয়ঢাক’-এর প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। বাংলাভাষার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছোটো ও বড়োদের জন্য দীর্ঘকাল নিয়মিত লেখালিখি। মোট প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পঁচিশটিরও বেশি।


গল্পঃ অভিনেত্রী - অদিতি সরকার



অভিনেত্রী


অদিতি সরকার



শৌভিক বিখ্যাত লেখকের ইন্টারভিউয়ের কপিটা জমা দিতে করিডর ধরে দ্রুত হেঁটে আসছিল। সাধারণত আজকাল যাবতীয় লেখাপত্তর মেল করে দিলেই হয়ে যায়, কিন্তু এই কাগজ এখনও ডাইনোসর যুগেই পড়ে আছে। এরা সবেরই হার্ড কপি চায়। সাংঘাতিক নামী কাগজ, সার্কুলেশনও মারাত্মক। অতএব হেলাফেলাও করা চলে না।  

তাকে পেরিয়ে যেতে যেতে অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর সমীর দাভে হঠাৎই পাশ থেকে তার টিশার্টের হাতাটা ধরে একটা টান দিলেন। মাথা হেলিয়ে নিজের অফিসের দরজার দিকে ইঙ্গিত করে বলতে বলতে গেলেন, “এক মিনিট আমার অফিসে এসো তো চক্রবর্তী। একটা ছোট্ট কাজ আছে তোমার জন্য।’’ শৌভিক চক্রবর্তী বহুদিন ধরেই নিয়মিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ফ্রিল্যান্স ফিচার লিখে থাকে, বেশির ভাগই নামজাদা পাবলিকেশন হাউসগুলোর সপ্তাহান্তিক ক্রোড়পত্রের জন্য। একটু সতর্কভাবেই দাভের পেছন পেছন তাঁর ঘরে ঢুকল। অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটরের ভাষায় ছোট্ট কাজ যা খুশি হতে পারে। এ ব্যাপারে তার তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে।

পচা দিন পড়েছে একটা। মরা মরা ঘোলাটে আকাশ থেকে এক নাগাড়ে সোজা সোজা ফোঁটায় বৃষ্টি পড়েই চলেছে। বৃষ্টির জলে পোড়া ডিজ়েলের গন্ধ। কাদামাখা রাস্তা ধরে মুড়ির টিন মার্কা বাসগুলো আরও কালি আর ধোঁয়া ছড়াতে ছড়াতে বেরিয়ে যাচ্ছে। এমন স্যাঁতসেঁতে মিয়োনো বিস্কুটের মতো দিনে কাজফাজ করার ইচ্ছেই থাকে না । শৌভিক ভেবেছিল কপিটা ধরিয়ে দিয়েই কেটে পড়বে, কিন্তু বিধি বাম।

 “ঠিক দশ মিনিট সময় আছে আমার, সুতরাং খুব মন দিয়ে শোনো’’ সমীর দাভে হাত নেড়ে শৌভিককে বসতে ইশারা করেন। নিজে অবশ্য বসেন না। পায়চারি করতে করতেই কথা বলতে থাকেন।  “করোনেশন থিয়েটার ভেঙে সুপারমল হচ্ছে জানো তো। যে সপ্তাহে প্রোমোটারের ডিমলিশন টিম ঢুকবে সেই সপ্তাহের ইস্যুতেই আমরা ওল্ড অ্যাকট্রেসদের নিয়ে একটা ফিচার বার করব। যদ্দূর জানি ওটা বোধহয় নভেম্বর নাগাদ হবার কথা, কাজেই খুব তাড়াতাড়ি কপি লাগবে। এই নাও ধরো লিস্টটা- পাঁচজন নামকরা অভিনেত্রী, এককালে যাঁদের ছবি ওখানে রমরম করে চলেছে। এক একজনের ওপরে হাজার ওয়ার্ড মত হলেই হবে। ধারালো টানটান লেখা চাই। নাকে কান্না চলবে না। নো হার্টস অ্যাণ্ড ফ্লাওয়ার্স। “ 

 “নাম কী দিচ্ছেন লেখাটার- অতীতের ধ্বংসস্তূপ?’’ সমীর দাভের চৌকো মুখে একটু হিমেল হাসির আভাস দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। “তুমি ফ্রেঞ্চ জানো তো, না?”

“ওই একটু আধটু। স্কুলবয় ফ্রেঞ্চ। কেন বলুন তো?”

 “সুবিধে হবে। প্রথমেই ললিতা মিশেলকে ধরো। সবথেকে বেশি বয়েস, সবথেকে নটোরিয়াস। অভিনয় ছাড়ার পরে পণ্ডিচেরিতে সেটলড। তুমি দুদিনেই মেরে দিতে পারবে। ধরো বুধবার সকালে বেরিয়ে গেলে, থার্সডে কপি নিয়ে ফিরে এলে। ওয়ান মোমেন্ট প্লিজ।“ দাভের মোবাইল বাজছিল।

 “পণ্ডিচেরি? চেন্নাই হয়ে যেতে হবে তো? ওটা টু নাইটস করুন। বুড়োবুড়িগুলো প্রচণ্ড আনপ্রেডিক্টেবল হয়। হাতে একটা দিন থাকা ভালো। সেফ সাইডে থাকা যাবে। “ শৌভিক দাভের এগিয়ে ধরা কাগজের টুকরোটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

 “এক্সট্রা খরচা নিয়ে প্রশ্ন করলে চিফকে কী জবাব দেব বলে দিয়ো।’’ ফোন কানে হনহন করে দরজার দিকে এগোতে এগোতে থেমে ঘাড় ঘোরান দাভে।  “ওকে ওকে, টু নাইটসই রইল। ফোটোগ্রাফার লাগবে তো তোমার একজন। ফ্যাবুলাস ছবি চাই আমার শৌভিক। ওটাই আসল জিনিস।’’ 

 “কুলকার্নিকে নিলে কেমন হয়? ছেলেটার ট্যালেন্ট আছে।’’ 

 “ঠিক বলেছ। দেখো যদি পাও ওকে। আমাকে জানিয়ে দিয়ো। রিসেপশনে মধুরাকে বলা আছে, ফ্লাইট টিকিট ফোনে পাঠিয়ে দেবে তোমার। আর কুলকার্নির কনফার্মেশন মধুরাকেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জানিও, ওর টিকিট করা হয়নি এখনও।’’

“মানে ? আপনি জানতেনই আমি যাচ্ছি?” 

দাভে উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না।


শৌভিক অফিস থেকেই নাগেশ কুলকার্নিকে ফোন করে নিয়েছিল। কনফার্মড। 

বুধবার সকালে এয়ারপোর্টে এসে দেখল শ্রীমান আগেই পৌঁছে সর্বাঙ্গে ক্যামেরাশোভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শৌভিককে দেখতে পেয়ে একগাল হেসে এগিয়ে এল।  “ফ্লাইট ডিলেড দাদা, বসতে হবে।’’

শৌভিকের কপালে আলগা বিরক্তির ভাঁজ পড়ল। বেরোনোর আগে মোবাইলে মেসেজ আসার বিপ্ বাজছিল বার বার, ফালতু মেসেজ ভেবে দেখেনি, দেখে নিলেই এই হয়রানিটা এড়ানো যেত। ধ্যাৎ, এর থেকে ট্রেনই ভালো ছিল। কিন্তু আজকাল আর ট্রেনে চড়ছে কে। কাগজ কোম্পানিও তো সময় বাঁচাতে প্লেনের টিকিটই ধরাচ্ছে। এতগুলো সস্তার এয়ারলাইন এসে প্লেনে ট্র্যাভেলটা জলভাত করে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু মিসম্যানেজমেণ্টের চূড়ান্ত। এয়ারপোর্টে কুম্ভ মেলার ভিড়। 

 “কতক্ষণ লাগবে কিছু বলেছে? “

 “আরে দূর, কেউ কিচ্ছু জানে না। গ্রাউণ্ড স্টাফগুলো তো এক্কেবারে ওয়ার্থলেস। “

 “কী করা যায় তাহলে এখন? “

 “কী আবার করবেন, সিকিউরিটি চেক সেরে চলুন দুটো বিয়র মেরে দিয়ে আসি। “

 “এখন? এই সকালবেলা? “

 “অমৃতের আবার সকালবিকেল আছে নাকি দাদা? “ কুলকার্নি হো হো করে হাসে। এই হল নাগেশ কুলকার্নি, আজাদ পঞ্ছী। ছবি তোলার অসাধারণ প্রতিভা, কিন্তু মদিরাসুন্দরীর প্রতি আকর্ষণটা কিঞ্চিৎ বেশিই। এই একটা কারণে অনেকেই তাকে নিতে চায় না। অথচ কাজের সময় কুলকার্নিকে পিপে পিপে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্কচ এনে দিলেও সে তা ছুঁয়েও দেখবে না, এটা যারা তার সঙ্গে কাজ করেছে তারাই জানে। আর ছবি যা তুলে আনবে তা এক কথায় অনবদ্য। এই জন্যই শৌভিক বেশির ভাগ অ্যাসাইনমেণ্টেই চেষ্টা করে নাগেশকে নিতে। 


প্লেন টেক অফ্ করার সময়েও মুম্বইয়ে ঘ্যানঘেনে বৃষ্টি পড়ছিল, চেন্নাইতে কিন্তু খটখটে চোখে বিঁধে যাওয়া রোদ। এখান থেকে পণ্ডিচেরি পৌঁছতে কিছু না হোক আরো ঘণ্টা চারেক। হায়ার করা ইন্ডিকা গাড়িটার পিছনের সীটে মাথা হেলিয়ে দিতে দিতে শৌভিকের একটু অবাক লাগে। আগে আগে এসব অ্যাসাইনমেণ্ট করতে কী দারুণ উৎসাহ হত, এখন কই সেরকম কিছু লাগছে না তো। বরং একটু বোরই লাগছে যেন। কোনোরকমে কাজটা শেষ করে ফিরতে পারলে বাঁচা যায়, এরকমটাই মনে হচ্ছে না ? বয়স হয়ে গেল না কী? এখনই? এই ছত্রিশেই? মাখনমসৃণ ইস্ট কোস্ট হাইওয়ের পাশাপাশি বিছিয়ে থাকা ভারত মহাসাগরের রোদ ঠিকরোনো নীল জলের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে চোখ বোজে শৌভিক। বন্ধ চোখের পিছনে প্লেনে চোখ বোলানো ললিতা মিশেলের ফাইলটা আর একবার খুলে যায়।

ললিতা মিশেল। পিতৃদত্ত নাম লতিকা গুহরায়, জন্ম উনিশশো আটাশ, ঢাকা। পিতা বঙ্গসন্তান, মা ফরাসিনী। লতিকার বেড়ে ওঠা ও শিক্ষার বেশিটাই বিদেশে। অপরূপ সুন্দরী, একাধিক ভারতীয় ও বিদেশি ভাষায় স্বচ্ছন্দ, হিন্দি ছাড়াও দুটি হলিউডের ইংরেজি ছবি এবং একাধিক ফরাসি ছবিতে অভিনয় করেছেন। অসংখ্য পুরস্কারের সঙ্গে ভারত সরকার প্রদত্ত পদ্মভূষণ সম্মানও পেয়েছেন। অসামান্য অভিনেত্রী, বয়স ও একটি শুটিং কালীন দুর্ঘটনার দরুন হিপবোন ভেঙে যাওয়ার কারণে অবসর গ্রহণে বাধ্য হবার আগে পর্যন্ত নিজের তারকা স্থিতি বজায় রেখে রুপোলি পর্দায় দাপটে রাজত্ব করে গেছেন। তিনটি বৈধ বিবাহ, প্রেমিকের সংখ্যা অগুনতি। প্রথম স্বামী বাঙালি। তিনি বিয়ের দুমাসের মধ্যেই আত্মহত্যা করেন, কারণ অদ্যাবধি অজ্ঞাত৷ দ্বিতীয়জন ইংরেজ, তাঁর সঙ্গে আইনসঙ্গত বিচ্ছেদ হয়ে যায় পাঁচ বছর বিবাহিত জীবন যাপনের পর। শেষ স্বামী অঁদ্রে মিশেল নামক এক ফরাসি আর্কিটেক্ট। তিনিও আর ইহজগতে নেই। তাঁরই ঔরসে একটি মাত্র কন্যাসন্তান হয় ললিতার। এই মহিলা বিয়ে করেছিলেন একজন পারসি ব্যবসায়ীকে - শ্রী ফিরোজ রুস্তমজি উমরিগড়। তাঁদেরও একটি মাত্র কন্যা। শ্রী ও শ্রীমতী উমরিগড় উভয়েই একটি বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। অতীতের প্রজ্বলন্ত তারকা বর্তমানে পণ্ডিচেরিতে প্রায় অজ্ঞাতবাসে। একমাত্র সঙ্গী দৌহিত্রী সরোজিনী।

“কুলকার্নি, ললিতা মিশেলের সম্বন্ধে কতটুকু জানো বলো দেখি?” চোখ না খুলেই জিজ্ঞাসা করে শৌভিক।

“জ়িরো। নাথিং। নাম ছাড়া আর কিসসু না। বেঁচে আছেন যে তাই জানতাম না। বয়স কত হবে মহিলার এখন, একশো?” 

“নাহ্ অতটাও না। নব্বইয়ের কিছু বেশি। কান, ভেনিস, কোনো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালই বাদ যায়নি। এককালে কান ফেস্টিভ্যালে রেড কার্পেটেও হেঁটেছেন এবং কাঁপিয়েছেন।“

“তখন আমি জন্মাইনি দাদা। আপনিও না।“ এবার কুলকার্নি চোখ বোজে। 


হোটেলে পৌঁছে ফোন লাগাল শৌভিক। ওপার থেকে একটা নরম, একটু ভীরু ভীরু কণ্ঠ তার সঙ্গে শুদ্ধ, অথচ একটু অন্যরকম ইংরেজিতে কথা বলে। ঠিক পুরোপুরি ইংরেজি ধরনের নয়, একটু যেন কীরকম অপরিচিত বাক্যগঠনের ধারা। উচ্চারণটা একটু ভারতীয়, একটু নরম ইউরোপিয়ান। কোথাও একটু বাংলারও রেশ আছে কি? এ নিশ্চয়ই নাতনিটি হবে, শৌভিক আন্দাজ করে।

 “আপনারা বরং চারটে নাগাদ আসুন। ততক্ষণে ওঁর বিশ্রাম নেওয়া হয়ে যাবে, তৈরি হবার সময় পাবেন, হয়তো তখন আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হবেন। তবে একটা কথা আগেই বলে রাখি, আপনারা কষ্ট করে এসেছেন এত দূর থেকে, ইন্টারভিউ যে পাবেনই এমন কোনো গ্যারান্টি কিন্তু আমি দিতে পারছি না আপনাদের।’’ একটু থেমে মেয়েটি আবার বলে, “এতদিন পরে মিডিয়ার আবার ওঁর কথা মনে পড়েছে, পত্রিকায় ইন্টারভিউ??? খুবই উত্তেজিত হয়ে আছেন উনি। আরও একটা কথা, প্লিজ় মনে রাখবেন, বয়েস অনেক হয়েছে ওঁর, একটু আনপ্রেডিক্টেবল ব্যবহার করলে কিছু মনে করবেন না আপনারা।’’

চারটের বেশ কিছুটা পরেই পৌঁছল ওরা। হয় মেয়েটির পথনির্দেশ খুব একটা স্পষ্ট ছিল না, নয় ওরা ঠিকঠাক বুঝতে পারেনি। গুগল নেভিগেশনেও বিশেষ সুবিধে করা যাচ্ছিল না, কারণ একে ড্রাইভারের সঙ্গে কথাবার্তায় ভাষা বিশাল সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল, তার ওপর তিনি যান্ত্রিক ইনস্ট্রাকটরের হুকুম শুনতে রাজিও ছিলেন না।

 পড়ন্ত রোদে একতলা পুরোনো বাংলো প্যাটার্নের বাড়িটাকে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছিল। দরজার ঘণ্টি বাজানোর আগেই নাগেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিল। 

ফিটফাট পোশাক পরা একজন মধ্যবয়সী মহিলা ওদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। চেহারা থেকে স্থানীয়ই মনে হয়। সম্ভবত আয়া বা হাউসকিপার গোছের কেউ হবেন। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে ওদের বসতে বলে বাড়ির ভেতরে গেলেন মহিলা।

নাগেশ বসেনি। ঘুরে ঘুরে চারদিক দেখছিল সে। ঘরটা বেশ বড়ো। এবং একটা দীর্ঘ  অভিনয় জীবনের অজস্র ছোটোবড়ো স্মৃতিচিহ্নে ঠাসা। আর ছবি। অসংখ্য ছবি। চারটে দেওয়াল মোড়া ললিতা মিশেলের বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন ভঙ্গির ছবিতে। তেলরং, জলরং, স্কেচ, ফোটোগ্রাফ, পোস্টার। বিভিন্ন পোশাকে, বিভিন্ন ভঙ্গিতে, বিভিন্ন মেজাজে। এককালে নিঃসন্দেহে অপরূপা ছিলেন মহিলা।

প্রায় শব্দহীন পায়ে এক দীর্ঘাঙ্গী তরুণী এসে ঢোকে ঘরে। তার ত্বকের স্বাভাবিক অভারতীয় ফ্যাকাশে গোলাপির ওপর দক্ষিণ ভারতের সূর্যের তামাটে সোনালি ছাপ। লালচে বাদামি চুল টেনে ঘাড়ের কাছে একটা ক্লিপ দিয়ে আটকানো। পরনে সাধারণ সুতির সালোয়ার কামিজ। পায়ে সস্তা হাওয়াই চটি। অদ্ভুত স্বচ্ছ সবুজাভ দু চোখ তুলে সরাসরি শৌভিকের দিকে তাকায় সে।

চোখধাঁধানো তো নয়ই, এমন কি মোটামুটি সুন্দরীও বলা যাবে না তাকে কোনও মতেই। অথচ শৌভিক খুব সচেতনভাবে তার উপস্থিতিটা অনুভব করছিল। অসম্ভব শান্ত, প্রায় নিশ্চল, নীরব একটা উপস্থিতি। চোখে লেগে থাকা সামান্য হাসির কণা, যা আদৌ তার ঠোঁট অবধি পৌঁছচ্ছিল না।

“আমাদের দেরি হয়ে গেল একটু।’’ শৌভিকই কথা বলে। এই নিঃশব্দ স্থির চেয়ে থাকায় তার সামান্য অস্বস্তি হচ্ছিল। 

“হ্যাঁ, মুড খারাপ হয়েছে কিছুটা। বেলা দুটো থেকে মেকআপ শুরু করেছিলেন উনি। আপনারা একটু অ্যাপলজেটিক ভাব দেখাতে পারলে ভালো হত, যদি কিছু মনে না করেন।“

পেছন থেকে নাগেশের হালকা কাশির আওয়াজ আসে। শৌভিক তাড়াতাড়ি পরিচয় করায়, “ইনি নাগেশ। নাগেশ কুলকার্নি। ফোটোগ্রাফার।“

মেয়েটির মুখে অপ্রতিভ বিড়ম্বনার ছোঁওয়া লাগে। 

“না না, ছবি তো তোলা যাবে না। ছবির কথা তো কিছু বলা হয়নি আমাদের। ছবি হবে না, প্লিজ়।“

“পত্রিকা আমায় পয়সা দিয়ে পাঠিয়েছে ললিতা মিশেলের ছবির জন্যই।“ নাগেশ শক্ত গলায় বলে। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, শৌভিক কাঁধে হাত রেখে থামায় তাকে। হালকা বারণের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে প্রায় দেখা না যাওয়ার মতো করে একটা চোখ আলতো বন্ধ করে।

“ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমরা ইন্টারভিউটা নিয়েই এগোই তো এখন। ছবির ব্যাপার পরে চিন্তা করা যাবে।“

“আপনারা বসুন। আমি নিয়ে আসছি ওঁকে।“

ভেতরের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ থামে সরোজিনী। কেমন যেন আর্ত একটা মুখ ঘোরায় ওদের দিকে।

“ওঁকে আঘাত করবেন না প্লিজ়, এইটুকুই অনুরোধ।“


“দাদা, ছবি তো নিতেই হবে। কাগজের লোক তো আমার গর্দান নেবে নইলে।“ কুলকার্নি ছটফট করছিল।

“ওই বড়ো অয়েল পেইন্টিংটারই একটা ছবি নাও আপাতত। আর নাতনি যদি এক সেকেন্ডের জন্যও দিদিমাকে একা ছাড়ে তাহলে দু একটা ক্যান্ডিড চেষ্টা কোরো নাহয়। কপাল ভালো থাকলে বুড়ি বুঝতেও পারবে না হয়তো। এখন যাও, চটপট কয়েকটা স্ন্যাপ নিয়ে ওই দিকটায় দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়াও গে যাও। ক্যামেরা যেন একদম রেডি থাকে।“

দরজার ওপাশ থেকে একটা বাচ্চাদের মতো নালিশভরা গলার আওয়াজ কানে আসছিল। ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ আর বাংলা মেশানো অদ্ভুত একটা ভাষায় অজস্র অভিযোগভরা গলা। ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছিল আওয়াজটা। ললিতা ক্লান্ত, ললিতার ঘুম পেয়েছে, ললিতা মোটেও কতগুলো অজানা অচেনা জার্নালিস্টের জন্য সারাদিন ধরে অপেক্ষা করে থাকবে না। ললিতার নিজের নাতনিই যদি ললিতাকে আগলে রাখতে না পারে তবে ললিতার মরে যাওয়াই ভালো।

আর এত অভিযোগের স্রোতের মাঝে মাঝে অন্য একটা নরম রেশমের মতো কোমল নিচু আদরে ভরা গলার হালকা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া। “রাগ করে না, অত রাগ করে না লক্ষ্মী সোনা আমার। মা শেরি, মা বেল, আমার মিষ্টি সুন্দরী নানি…”

দরজাটা খুলে গেল। সরোজিনী একটা হুইলচেয়ার ঠেলে আনছিল। চেয়ারে বসা মূর্তিটির সঙ্গে শুধু চামড়ায় মোড়া একটি কঙ্কালের বিশেষ পার্থক্য নেই। শুকনো, শীর্ণ দেহে জড়ানো ভারি ব্রোকেড বেনারসির ভারে যেন আরওই ঝুঁকে পড়েছেন ললিতা মিশেল। কোলে ফেলে রাখা কোঁচকানো পুরনো কাগজরঙা দু হাতের প্রতিটি আঙুলে ঝলসাচ্ছে বহুমুল্য পাথর বসানো আংটি। 

মুখের দিকে এক নজর তাকায় শৌভিক। প্রসাধনের পুরু প্রলেপ বলিরেখার ভাঁজে ভাঁজে বসে গিয়ে আরও প্রকট করে তুলেছে সেগুলোকে। কোটরে ঢোকা চোখের পাতায় রুপোলি নীল আইশ্যাডো, অস্বাভাবিক লম্বা ফলস ল্যাশের ওপর ম্যাসকারার মোটা কোটিং। তারও ওপরে পঞ্চাশের দশকের তীক্ষ্ণ কালো রেখায় আঁকা সরু ভ্রূ। শুকিয়ে যাওয়া পাতলা ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক। মাথায় কুচকুচে কালো বুফঁ স্টাইলের ফোলানো ফাঁপানো উইগ।

শৌভিক এগোয়। কী ভেবে নিচু হয়ে প্রণামের ভঙ্গিতে ঝোঁকে। বেনারসির জরির পাড়ের নিচ থেকে উঁকি দেওয়া ললিতা মিশেলের পায়ের নখেও লাল পালিশ ঝকমক করছে।

গলায় একটা কৈফিয়তের সুর এনে দ্রুত কথা বলতে থাকে শৌভিক। সত্যিই তার দেরি হয়ে গেছে আসতে, খুবই অন্যায় হয়েছে তার এটা, বলতে গেলে ললিতা মিশেলের মতো অভিনয় সম্রাজ্ঞীর অসম্মানই করেছে সে প্রায়। কিন্তু মাদাম কি তাকে ক্ষমা করে দেবেন না? তাঁর অভিনয় জীবনের কিছু কাহিনি, কিছু ঘটনা, তাঁর সহঅভিনেতাদের কিছু স্মৃতি কি তার সঙ্গে ভাগ করে নেবেন না? যে ললিতা মিশেলের নাম ছোট থেকে শুনে শুনে তার বড়ো হওয়া, আজ অবিশ্বাস্যভাবে সেই কিংবদন্তির সামনেই দাঁড়িয়ে সে এখন। শুধু তাঁর মুখ থেকে নিজের নায়িকাজীবনের কিছু কাহিনি শুনতে পেলেই আর কিছু চাওয়ার থাকবে না তার।

হুইলচেয়ারে ছোট্ট হয়ে বসে ছিলেন ললিতা, মুখে বিরক্ত অভিমান।

“কী বলছে ছেলেটা, সরো? এত কথা কেন বলে ও? কিচ্ছু বুঝতে পারছি না আমি, কিচ্ছু না।“ বাচ্চাদের মতো হাত নাড়েন ললিতা।

“আমি কাউকে কোনো ইন্টারভিউ দেব না। সরো, কেন এইসব সস্তা জার্নালিস্টদের আমার কাছে আসতে দিস তুই?”

বিরক্তি সরে গিয়ে নিজের ওপরই করুণার একটা অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে ললিতার মুখে। মরতে বসা বুড়ি অভিনেত্রীর কথা কে-ই বা পড়বে? কেনই বা পড়বে? আধুনিক দুনিয়া তো কবেই ভুলে গেছে তাকে। আজকের পৃথিবী শুধু ছুটছে, অন্ধ নেশায় লক্ষ্যহীন ছুটছে, সত্যিকারের আর্টের কদর জানে আজ কেউ।

ছটফট করতে থাকা হাতটা আলতো করে নিজের মুঠোয় তুলে নেয় সরোজিনী। “নানি, তোমার মনে আছে  সেই যেবার মস্কোয় তোমার ছটা ছবি একসঙ্গে দেখানো হয়েছিল? তুমি গল্প করেছিলে আমায়। তোমার অপেক্ষায় মস্ত লাল গোলাপের তোড়া নিয়ে দাঁড়িয়েছিল এক ডিউকের ছেলে, কার্পেটে হাঁটু গেড়ে বসে তোমায় হিরের আংটি পরিয়ে দিতে চেয়েছিল এক মুকুটহীন রাজা। মনে পড়ে, নানি? ক্রিস্টালের ঝাড়বাতির তলায় গ্র্যান্ড বলরুমে তোমার সেই নাচ?”

শৌভিক রেকর্ডারটা অন করে দেয়। একটা প্রশ্নও করে না সে। সরোজিনীর মধুর মতো উষ্ণ নরম কণ্ঠস্বরের জাদুতে আস্তে আস্তে ঘ্যানঘ্যানে বাচ্চার খোলস ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে থাকেন অতীতদিনের অভিনয় সম্রাজ্ঞী। বিনা প্রশ্নেই শৌভিকের চোখের সামনে পরতে পরতে খুলে যেতে থাকে সত্যিকারের বাঁচার মতো করে বেঁচে নেওয়া এক আশ্চর্য জীবনের এক একটা উজ্জ্বল অধ্যায়। যে জীবনে শত উন্মাদনা, শত ঐশ্বর্যের হাতছানি, শত অনুরাগীর আকুল নিবেদন ছাপিয়ে স্থির শিখার মতো জেগে থাকে ললিতার একমাত্র ভালোবাসা, অভিনয়। যার সঙ্গে কোনোদিন বিশ্বাসঘাতকতা করার কথা ভাবতেও পারেননি তিনি।

কতক্ষণ রেকর্ডার চলেছিল খেয়াল নেই। একসময় আস্তে আস্তে ক্লান্ত হয়ে থেমে আসে ললিতার গলা। সরোজিনী হালকা ইশারা করে শৌভিককে। রেকর্ডার অফ করে শৌভিক।

“সরো, ছেলেটা তো কিচ্ছু লিখল না। সব কথা মনে থাকবে ওর? ঠিকঠাক লিখতে পারবে সব?”

“রেকর্ড করে নিয়েছি মাদাম। শুনবেন একবার?”

“শুনব? নাহ্।“ শব্দ করে শ্বাস ফেলেন ললিতা। ক্লান্ত, উদাস একটা ভাব টেনে আনেন অভিব্যক্তিতে, শরীরের ভাষায়। বোঝাই যায় অভিনয় করছেন এখন। “কী হবে শুনে? যে জীবন ফেলে এসেছি তার গল্প আর শুনতে ভালো লাগে না। সরোজ বেবি, এই চার্মিং ইয়াং ম্যানটির জন্য কফির ব্যবস্থা করোনি বুঝি? ভেরি রুড অফ ইউ ডার্লিং। যাও তো, যাও। ভালো করে কফি বানিয়ে আনো আমাদের জন্য, যাও। তুমি কত চমৎকার কফি বানাতে পারো জানুক তো তোমার গেস্ট।“

কুলকার্নির উপস্থিতি টেরও পাননি ললিতা। রেকর্ডার চলতে চলতে সাত আটটা হালকা ক্লিক কানে এসেছিল শৌভিকের, কিন্তু ললিতা শোনেননি।

শৌভিকের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন ললিতা। গর্তে ঢোকা চোখে কীরকম একটা ধূর্ত চাউনি।

“আমার নাতনিটিকে কেমন লাগল, ইয়ং ম্যান?”

অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে সামান্য হকচকিয়ে গেলেও সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে শৌভিক।

“মিস উমরিগড়?”

“সরোজিনী। উমরিগড়কে ও চেনে না, শুধু পদবিটুকুই যা বাধ্য হয়ে ব্যবহার করতে হয়। এক বছর বয়সে মারা গিয়েছিল ওর মা, আমার একমাত্র মেয়ে। সেই সঙ্গে ওর বাপও, মানে উমরিগড়। তখন থেকে আমার কাছেই বড়ো হয়েছে সরোজ। আমার দেখাশোনা করতে করতেই সাতাশ বছর বয়স হয়ে গেল ওর। জীবনের গোল্ডেন পিরিয়ড, পুরো যৌবনকাল শেষ হয়ে গেল মেয়েটার, এখনও না কোনো বয়ফ্রেন্ড, না অ্যাডমায়ারার। আনন্যাচারাল না, বলো?”

সেই একই মিটমিটে ধূর্ত শেয়ালের চাউনি ললিতার চোখে। ঠিক কী বলতে চাইছেন মহিলা ধরতে পারছিল না শৌভিক। 

“একটা কথা বলি তোমাকে ইয়ং ম্যান। একটা অনুরোধ।“ শুকনো হাতে শৌভিকের হাতটা হঠাৎ সজোরে আঁকড়ে ধরেন ললিতা।

“বলুন না।“ অস্বস্তি চেপে উত্তর দেয় শৌভিক।  মহিলা ঠিক কোন দিকে যেতে চাইছেন স্পষ্ট করে ধরে উঠতে পারছিল না সে।

“আমার নিজেকে বড়ো অপরাধী লাগে আজকাল, জানো। মরতে বসা দিদিমার সেবা করতে গিয়ে নিজের বেস্ট সময়টাই হারিয়ে ফেলছে সরো। তুমি একটা কাজ করবে? আজ রাতে ওকে নিয়ে একটু বেরোবে? কোথাও ডিনারে গেলে হয়তো, কিংবা একটা ফিল্ম? কিংবা কোনো ক্লাবে, একটু ডান্স টান্স? আমি, আমি খরচ দেব, তোমাকে নিজের পকেট থেকে এক টাকাও খরচা করতে হবে না, শুধু ওকে নিয়ে একটু সময় কাটাবে প্লিজ? কয়েক ঘণ্টার জন্য একটু মুক্তির স্বাদ দেবে মেয়েটাকে?”

“মহিলা কি নিজের নাতনির দালালি করছেন নাকি?” পেছন থেকে কুলকার্নি ফিসফিস করে। 

অবিশ্বাস্য লাগছিল শৌভিকের। এইরকম খোলাখুলিভাবে এই ধরনের কথা কেউ বলতে পারে, তাও নিজের নাতনির সম্বন্ধে, ভাবতেও অবাক লাগছিল তার।

খুব সাবধানে উত্তর দেয় সে।

“”সরি মাদাম মিশেল, আজ রাতে আমার অন্য এক জায়গায় যাওয়ার আছে। আগে থেকেই ঠিক ছিল। আমায় মাফ করবেন।

মাদাম মিশেলের চোখ ক্রোধে ঝিকিয়ে ওঠে। ঠোঁট বেঁকে যায় নিচের দিকে।

“ওহ্। তাই? মানে আমি একটা অন্যের ব্যাপারে নাকগলানো বুড়ি, তাই তো? আমার কথা পছন্দ নয়।  তো করো তোমাদের যা মনে চায়। সরোজ, সরোজ।“ জোরে জোরে ডাকতে থাকেন ললিতা। তাঁর শ্বাস দ্রুত পড়ছিল, হাত কাঁপছিল থরথর করে।

সরোজিনী ছুটে এসে দাঁড়ায়, তার চোখে প্রশ্ন।

“আমাকে নিয়ে চলো, নিয়ে চলো এখান থেকে। খাব না আমি কফি, কিচ্ছু খাব না। চলে যেতে বলো এই লোকটাকে।“ বাচ্চাদের মতো মেঝেয় পা ঠোকেন ললিতা মিশেল।

হুইলচেয়ারটা ঠেলে ঘরের বাইরে নিয়ে যায় সরোজনী। এবং কিছুক্ষণ পরেই আবার ফিরে আসে। শৌভিক কিছুটা হতবুদ্ধি হয়েই বসেছিল। কুলকার্নিও চুপ।

“কিছু মনে করবেন না, প্লিজ়। আমি তো আগেই বলেছিলাম, নানি খুব মুডি, আনপ্রেডিক্টেবল। সরি, সো সরি।’’

“কোনো ব্যাপার না। আমাদের কাজ হয়ে গেছে। যা পেয়েছি যথেষ্ট।’’ শৌভিক হাত জোড় করে।

“আপনি রোজ এ জিনিস সহ্য করেন কী করে?” কুলকার্নি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না।

নরম দুটি চোখে হালকা হাসি খেলে যায়।

“আপনারা বুঝবেন না। বসুন, কফিটা হয়ে গেছে।’’

“না না, ব্যস্ত হবেন না। আমাদের আরো কয়েকটা জায়গায় যাওয়ার আছে আসলে।’’ শৌভিক উঠে দাঁড়ায়।

জোর করে না সরোজিনী। দরজা অবধি এগিয়ে দেয় ওদের।

“আমার অনুরোধটা মনে থাকবে তো? প্লিজ় ওঁকে আঘাত করে কিছু লিখবেন না আপনার লেখাটায়।’’

নো হার্টস অ্যান্ড ফ্লাওয়ার্স। সমীর দাভের গলাটা কানে বেজে ওঠে শৌভিকের।


গাড়িতে বসে ফেটে পড়ে কুলকার্নি।

“এরকম দালালি দেখেছেন কখনো আগে দাদা? আপনার ঘাড়ে ওই ঢ্যাঙা নাতনিকে ঝোলাতে চাইছিল বুড়ি। পাগল না কি?”

“খুব অদ্ভুত লাগল আমারও ব্যাপারটা।“ শৌভিক আস্তে আস্তে বলে।

“আর কী বিশ্রীভাবে প্রেজেন্ট করল পুরো জিনিসটা। নাতনির জন্যও কী ভীষণ ইনসাল্টিং।’’

এটাই খুব আশ্চর্য লাগছিল শৌভিকের। এত মোটা দাগের প্রেজেন্টেশন ললিতা মিশেলকে মানাচ্ছিল না। যে ললিতা মিশেল তাঁর সূক্ষ্ম অভিনয়ের জন্যই প্রসিদ্ধ ছিলেন, তিনি নিজের নাতনিকে এইভাবে একজন স্বল্পচেনা, বা অচেনাই বলতে গেলে, পুরুষের কাছে গছাবেন? হিসেবটা মিলছিল না ঠিক।

“কুলকার্নি, আমি আর বেরোচ্ছি না আজ। তুমি ঘুরেফিরে এসো।’’

“একা একা রুমে বসে কী করবেন দাদা? চলুন না।’’

“নাহ্। একটু লেখাটা নিয়ে বসি। আউটলাইনটা করে রাখি অন্তত।’’


ঘরে গিয়ে স্নান করে জামাকাপড় পাল্টালো শৌভিক। কিছুক্ষণ নিছক চোখ বুজে শুয়ে থেকে কেটে যেতে দিল সময়। তারপর একটা ক্যাব ধরে আবার পৌঁছল ছেড়ে আসা ঠিকানায়।

দরজা খুলে নিজের অবাক হওয়াটা লুকোতে পারেনি সরোজিনী।

“আপনি?”

“বোঁসোয়া মিস উমরিগড়। গুড ইভনিং। আপনার নানির কথা রাখতে এলাম।’’

“মানে?” সরোজিনীর মুখ লালচে হয়ে উঠছিল।

“আপনাকে ডিনারে নিয়ে যেতে বলেছেন আপনার নানি। মে আই হ্যাভ দ্য প্লেজ়ার?”

“আবার?” সরোজিনী দু হাতে মুখ ঢেকে ফেলল? তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিল।

শৌভিক অপ্রস্তুতে পড়ে গেল। সরোজিনী কেঁদে ফেলবে সে ভাবেনি।

“মিস উমরিগড়? সরোজিনী?”

হাত সরায় সরোজিনী। শৌভিক অবাক হয়ে দেখে উচ্ছ্বসিত হাসিতে তার চোখমুখ ছলছল করছে।

“আবার কাণ্ডটা করেছে নানি? মিস্টার চক্রবর্তী, আপনি একমাত্র লোক যে সত্যি সত্যি নানির কথা শুনে আবার ফিরে এলেন।’’

“উনি আগেও এরকম করেছেন?” শৌভিকের সব গুলিয়ে যাচ্ছিল।

“অনেকবার। কোনো ইয়ং ম্যানকে দেখে ওঁর আমার প্রতি ইন্টারেস্টেড মনে হলেই এই ট্রিকটা খেলে দেয় নানি।“

“ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে?”

“একদম। চোখে একটা হিসেবি, ধান্দাবাজ দিদিমা মার্কা চাউনি আনে। ব্যস। ওতেই কাজ হয়ে যায়।’’

সেই গম্ভীর সরোজিনীকে আর খুঁজে পাচ্ছিল না শৌভিক। এই সরোজিনী বাচ্চা মেয়ের মতো হাসছিল।

“আপনার এমব্যারাসড লাগে না?”

“একটুও না। আগে লাগত, এখন তো জানি নানির ব্যাপারটা।’’

“আজ কিন্তু একটু বেশিই চড়া হয়ে গেছিল ওঁর অভিনয়।’’

“বয়স হয়েছে নানির। সেই সূক্ষ্মতা আর কী করে থাকবে বলুন। এক মিনিট। আসবেন আমার সঙ্গে?”

“কোথায়?”

“আসুনই না।’’

সরোজিনী পা টিপে টিপে শৌভিককে নিয়ে যায় ভেতরের ঘরে। একটা মৃদু গোলাপি আলো জ্বলছিল ঘরটায়। ঠিক মাঝখানে চওড়া একটা খাট। খাটে ঘুমিয়ে ছিলেন এককালের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী মাদাম ললিতা মিশেল। হাতির দাঁতের মতো ত্বক এখন মেকআপহীন, পাতলা সাদা চুল আঁচড়ে সরু বেণী করা। বহু প্রাচীন কোনো সুন্দরীর তেলরঙে আঁকা ছবির মতো দেখাচ্ছিল ঘুমন্ত মাদাম মিশেলকে।

“অপূর্ব।’’ ফিসফিস করে বলে শৌভিক। “একটা ছবি নিতে পারি ওঁর?”

“বিরক্ত না করে যদি পারেন, নিন।’’

একটা নয়, বেশ কয়েকটা ছবিই নেয় শৌভিক তার ফোনে।

আস্তে আস্তে মাদামের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে ওরা।

“নানি এরকমই। এটাই আসল নানি। বয়স আর ভাঙা হিপবোনের ব্যথা নানিকে ছেয়ে ফেলার আগে, আমার চিন্তা নানিকে কুরে কুরে খাওয়ার আগে নানি এরকমই ছিল।’’ খুব নিচু গলায় বলে সরোজিনী।

“আপনি সত্যি বেরোবেন না আমার সঙ্গে?”

“আজ না। আজ চিন্নাম্মার অফ, নানিকে একা রেখে আমি যেতে পারব না। আমার না থাকার সময়টুকুতে যদি নানির কিছু হয়ে যায়, নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না কোনো দিন।’’

কেন যেন সরোজিনীকে ছেড়ে হোটেলে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিল না শৌভিকের।

“একটু সামনের রাস্তায় হাঁটতে পারি তো আমরা? জাস্ট পাঁচ মিনিট?”

“আচ্ছা বেশ। চলুন।’’


সমুদ্রের দিক থেকে হাওয়া আসছিল ঝোড়ো। বাতাসে অল্প অল্প বালি।

“সেই এক বছর বয়স থেকে নানির সঙ্গে আছি, জানেন। মা বাবাকে মনেও নেই। শুনেছি বাবা নাকি নানিকে পছন্দ করতেন না। মাকে আসতে দিতে চাইতেন না নানির কাছে। এই জীবনকে খারাপ ভাবতেন তিনি। কিন্তু নানির মতো বাঁচতে-ভালোবাসা মানুষ আর দুটো দেখিনি আমি। আর ভালোবাসতে জানা মানুষও।’’

সরোজিনীর গলায় এক অদ্ভুত মমতা গলে গলে পড়ছিল।

“তারপর নানির বয়স হতে শুরু করল। আস্তে আস্তে শরীরের ক্ষমতা কমতে লাগল, আশেপাশের চেনাজানা মানুষজন একে একে চলে যেতে থাকল, টাকাপয়সা ফুরোতে লাগল। গয়নাগুলো বিক্রি হয়ে গেল একে একে।’’ হঠাৎ জোরে হেসে ওঠে সরোজিনী।

“কী হল?”

“আজ যা দেখলেন নানির হাতে গলায়, সব কিন্তু নকল। মাদাম মিশেল গয়না না পরে ইন্টারভিউ দেবে, এমনটা হতেই পারে না। অতএব নকল গয়নার পুরো সেট। চলুন, ফেরা যাক।’’

গেটের সামনে এসে দাঁড়ায় সরোজিনী।

“থ্যাংক ইউ মিস্টার চক্রবর্তী। নানির নাতনিকে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।’’



সমীর দাভের টেবিলে পুরো সিরিজের ছবির প্রিন্টগুলো ছড়ানো ছিল। ললিতা মিশেলের পরে আরও চারজনের ইন্টারভিউ নিয়েছিল শৌভিক। সবখানেই ছবি নিয়েছে কুলকার্নি।

“ধারালো রাখতে বলেছিলাম তোমায় শৌভিক। স্পেশালি ললিতা মিশেলের আইটেমটা।’’

“সরি দাভে স্যর। হল না।’’

দাভে মুখ তোলেন।

“ভাগ্যিস হয়নি। দ্যাট ওয়ান ইজ় দ্য বেস্ট অফ দ্য লট। ছবি কোনটা যাবে দেখে বলো এবার।’’

কুলকার্নির তোলা রঙিন মুখোশের মতো ছবিগুলো বাদ করে দেয় শৌভিক। তেলরঙের বড়ো পোর্ট্রেটের ছবিটা, আর নিজের তোলা ঘুমন্ত ললিতার ছবিদুটো এগিয়ে দেয় দাভের দিকে।

“এই দুটো।’’


আর্টিকলটা বেরোনোর দেড় মাস পরে ঘুমের মধ্যে নিঃশব্দে চলে গেলেন ললিতা মিশেল। খবরটা বিশেষ কোথাওই বেরোয়নি। টিভিতেও কয়েকটা মাত্র চ্যানেলে খবরের তলা দিয়ে একটা স্ক্রোল ছাড়া আর কোনো কভারেজ ছিল না। 

সাতদিন পরে শৌভিক কাউকে কিচ্ছু না বলে হাতের কাজগুলো বাতিল করে উড়ে গেল পন্ডিচেরি।

“আপনি?”

সরোজিনীর অবাক চোখে জল ছিল না, কিন্তু অনেক কান্নার ছায়া জড়িয়ে ছিল ঘন হয়ে।

“নানি আপনার আর্টিকলটা পড়ে খুব খুশি হয়েছিলেন, জানেন তো। আমি পড়ে শুনিয়েছিলাম নানিকে, চলে যাবার এক সপ্তাহ আগে। নানি বলেছিল যে আপনি নানির ভেতরটা বুঝতে পেরেছিলেন।’’

“একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

“কী?” 

“উনি হাসেননি লেখাটা পড়ে?”

সরোজিনীর মুখ আবার আগের মতো লাল হতে শুরু করছিল।

“আপনি কী করে জানলেন?”

“অত চড়া দাগের অভিনয় করার মতো অ্যাকট্রেস ললিতা মিশেল নন যে। উনি চেয়েছিলেন যেন আমি ওঁর ইচ্ছেটা ধরে ফেলি। আমাকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন উনি, তাই না? সরোজিনী?”

সরোজিনী চুপ করে ছিল।

“বলবে না?”

“আপনি একমাত্র মানুষ যাকে নানি তাড়াতে চায়নি। আমি যখন বললাম যে, সেই রাতেই আপনি এসেছিলেন আবার, নানি ভীষণ খুশি হয়েছিল। আমাকে বলল, ডার্লিং, আমার টাচ এখনও নষ্ট হয়নি, বুঝেছ?”

“সরোজিনী।’’

স্বচ্ছ সবুজ চোখ তুলে শৌভিকের দিকে তাকায় সরোজিনী।

“আপনি কি সত্যিই ফিরে এসেছেন?”

নিজের হাতটা নির্দ্বিধায় বাড়িয়ে দেয় শৌভিক।

“ললিতা মিশেল মানুষ চিনতে ভুল করেন না সরোজিনী। করেননি।’’

এক লহমা সময় নেয় সরোজিনী। তারপর খুব আলতো করে নিজের হাতটা শৌভিকের বাড়ানো হাতের উষ্ণতায় সঁপে দেয় সে। 

সমুদ্রের নোনা হাওয়া তাদের ঘিরে ঘিরে পাক খায়।


অলঙ্করণঃ ডাঃ সায়ন্ন্যা দাশদত্ত



লেখক পরিচিতি



অদিতি সরকারের লেখাপড়া ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে, পেশা বাণিজ্যিক অনুবাদ। প্রথম ছোট গল্প প্রকাশ পেয়েছিল সানন্দা পত্রিকায়, ২০০৯ সালে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত সানন্দা, উনিশ কুড়ি, দেশ, ফেমিনা, বৃশ্চিক ইত্যাদি একাধিক প্রথম সারির পত্রিকায় ও সংকলনে গল্প প্রকাশিত হয়ে চলেছে।শুধু বড়দের লেখাই নয়, ছোটদের জন্যও গল্প বেরিয়েছে আমপাতা জামপাতা, রং বেরং প্রভৃতি মুদ্রিত পত্রিকায় এবং জয়ঢাক, ম্যাজিক ল্যাম্প, একপর্ণিকার মতো জনপ্রিয় ওয়েব ম্যাগাজিনে।প্রথম গল্প সংকলন 'মেঘ বৃষ্টি রোদ্দুর' প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮ সালে কলকাতা বইমেলায়।